বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ০৫:৩৭ অপরাহ্ণ, ০৫ ডিসেম্বর ২০১৬
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শরীয়তপুরের রাজাকার পলাতক ইদ্রিস আলী সরদার ওরফে গাজী ইদ্রিসকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পালং উপজেলার রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটির নেতা ইদ্রিসের বিরুদ্ধে শরীয়তপুর-মাদারীপুরে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, আটক, নির্যাতন, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও হিন্দুদের দেশান্তরে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের চারটি অভিযোগ আনা হয়। এসব অভিযোগের সবগুলোই প্রমাণিত হওয়ায় সর্বোচ্চ এ সাজা দেন ট্রাইব্যুনাল।
এর মধ্যে প্রথম দু’টি অভিযোগে হত্যা, নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের দায়ে মৃত্যুদণ্ড, তৃতীয় অভিযোগে হত্যার দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং চতুর্থ অভিযোগে পরিকল্পিত দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করার দায়ে সাত বছরের কারাদণ্ড পেয়েছেন ইদ্রিস।
ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা গুলি করে আসামি ইদ্রিস আলী সরদারের সাজা কার্যকরের আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
সোমবার (০৫ ডিসেম্বর) সকালে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে এ রায় দেন চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বিচারিক প্যানেলের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ারদী।
সকাল দশটা ৫০ মিনিট থেকে ৪৮৬ পৃষ্ঠার রায়ের প্রথম অংশ পড়ে শোনান বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম। পরে রায়ের মূল অংশ অর্থাৎ সাজা ঘোষণা করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক।
শুরুতে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান তার সূচনা বক্তব্যে বলেন, এ রায় দেওয়া হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে।
এ মামলার দুই আসামির মধ্যে সোলায়মান মোল্লা ওরফে সোলেমান মৌলভী গ্রেফতারের পর অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ায় তাকে মামলার দায় থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার ২৭তম রায়। সব মিলিয়ে এসব রায়ে ৫১ যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে ২৮ জন মৃত্যুদণ্ডাদেশ এবং বাকি ২৩ জন আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন। সর্বোচ্চ আদালতে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পর ইতোমধ্যেই কার্যকর হয়েছে ছয় শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি।
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ইদ্রিস আলী সরদার (৬৭) শরীয়তপুরের পালং উপজেলার মাহমুদপুরের মৃত হামিক আলী সরদারের ছেলে। মারা যাওয়া সোলায়মান মোল্লা (৯০) একই উপজেলার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাশিপুর মুসলিম পাড়ার মৃত চাঁন মোল্লার ছেলে।
ইদ্রিস আলী ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে সোলায়মানের নেতৃত্বে মানবতাবিরোধী নানা অপরাধ করেন। তিনি ১৯৬৯ সালে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা ছিলেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও ইদ্রিস ইসলামী ছাত্রসংঘের সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
অন্যদিকে সোলায়মান মোল্লা ১৯৬৩ সালের পর মুসলিম লীগের নেতা হিসেবে শরীয়তপুর জেলার পালং থানার সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে সহযোগিতা করতে শান্তি কমিটি এবং সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী গঠন করেন। এরপর স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মাদারীপুর-শরীয়তপুরে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধে নেতৃত্ব দেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তারা মাদারীপুরের এআর হাওলাদার জুট মিলে রাজাকার হিসেবে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নেন। তাদের সহায়তায় পাকিস্তানি সেনারা এলাকার কয়েকশ’ নারী-পুরুষকে গুলি করে হত্যা করে। নারীদের হত্যার আগে ক্যাম্পে নিয়ে ধর্ষণ ও পৈশাচিক নির্যাতন চালায়।
যে অভিযোগে যে সাজা
রায়ে প্রমাণিত হয়েছে, একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে শরীয়তপুর সদর উপজেলার তখনকার পালং থানার আংগারিয়া, কাশাভোগ, মানোহর বাজার, মধ্যপাড়া, ধানুকা, রুদ্রকরসহ হিন্দু প্রধান এলাকাগুলোতে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালায় রাজাকাররা। ওইসব গ্রামের নয়জনকে হত্যায় সহায়তা করেন আসামিরা। তারা শহীদদের অবস্থান দেখিয়ে দেন, আর পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। তিন শতাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ধর্ষণ চালান তারা।
প্রমাণিত চারটি অভিযোগের মধ্যে প্রথম অভিযোগে ২০০ জনকে হত্যা ও দ্বিতীয় অভিযোগে বহু মানুষকে হত্যা এবং নারী ধর্ষণ ও নির্যাতনের দায়ে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন ইদ্রিস আলী। তৃতীয় অভিযোগে চারজনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যার দায়ে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং চতুর্থ অভিযোগে পরিকল্পিত দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করার দায়ে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
আসামিপক্ষের আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম জানান, অপরাধ ও সাজার বিষয়ে একমত হলেও একজন বিচারপতি সর্বোচ্চ সাজা এক ও দুই নম্বর অভিযোগের কোন অপরাধের দায়ে দেওয়া হবে, সে বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন।
প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২২ মে আসামিরা দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ১০০ থেকে দেড়শ’ জন সদস্যসহ শরীয়তপুর জেলার পালং থানা এলাকায় কয়েকটি গ্রামে হামলা চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কৃষক আব্দুস সামাদসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় ২০০ মানুষকে গুলি করে হত্যা ও বাড়ির মালামাল লুট করেন।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ২৬ মে পালং থানার মালোপাড়া ও রুদ্রকর গ্রামে হামলা চালিয়ে মঠের পুরোহিতকে গুলে করে হত্যা ও গ্রামগুলো থেকে মামালাল লুট ও আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করেন আসামিরা। মালোপাড়া থেকে ৩০/৪৫ জন নারী ও পুরুষকে ধরে মাদারীপুর পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে তিনদিন আটকে রেখে নারীদের ধর্ষণ করে ছেড়ে দেন। কিন্তু পুরুষদের গুলি করে হত্যা করেন।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ২৬ জুন একই থানার শৈলেন্দ্র কৃষ্ণ পালের বাড়িতে হামলা চালিয়ে দুইজনকে হত্যা করে ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের নির্যাতন করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেন আসামিরা।
চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আসামিরা দখলদার বাহিনীর সহায়তায় এলাকায় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনসহ বিভিন্ন অপরাধ করেন। এ সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ করার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ভয়-ভীতি ও আতঙ্কের সৃষ্টি করে পালং থানার এক থেকে দেড় হাজার মানুষকে দেশত্যাগ করে ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য করেন।
মামলার পূর্বাপর
গত বছরের ১৪ জুন সোলায়মান-ইদ্রিসের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। ওইদিনই রাতে গোয়েন্দা পুলিশ সোলায়মান মোল্লাকে গ্রেফতার করলেও ইদ্রিস সরদার পলাতক। গত ২৫ অক্টোবর অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মারা যান সোলায়মান।
গত বছরের ২৯ অক্টোবর তাদের বিরুদ্ধে সাত খণ্ডে ৮৫২ পাতার তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রসিকিউশনে হস্তান্তর করেন তদন্ত সংস্থা।
এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত বছরের ১৬ নভেম্বর প্রসিকিউশন দুই আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর ২২ ডিসেম্বর এ অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।
গত ০২ মে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের চারটি অভিযোগে সোলায়মান-ইদ্রিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল।
গত ০২ নভেম্বর মামলার সর্বশেষ ধাপ উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণা অপেক্ষমান (সিএভি) রাখেন ট্রাইব্যুনাল।
প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, হৃষিকেশ সাহা ও সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি রাষ্ট্রপক্ষে এবং সোলায়মানের পক্ষে তার আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম ও পলাতক ইদ্রিসের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আব্দুশ শুকুর খান যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।
২০১০ সালে শরীয়তপুরের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ তালুকদার রাজাকার সলেমান ও ইদ্রিস আলী সরদারসহ আরও সাতজন রাজাকারের (তাদের অনেকেই মারা গেছেন) বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেন।