বার্তা পরিবেশক, বরগুনা::: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদারদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য বরগুনার ওয়্যারলেস স্টেশন গুঁড়িয়ে দিতে গিয়েছিলেন কিশোর ফারুকুল ইসলাম ও তার বড় দুই ভাই। তবে তারা ধরা পড়ে যান। এরপর ফারুকুলের সামনেই বরগুনার কারাগারে অর্ধশত বন্দির সঙ্গে তার এক ভাইকেও গুলি করে হত্যা করে পাক হানাদাররা। চোখের সামনে বুলেটের আঘাতে হানাদাররা ছিন্ন ভিন্ন করে দেয় ফারুকুলের আরেক ভাইয়ের বুক, পেট। মেঝেতে বয়ে যায় রক্তের শ্রোত। গুলির আঘাতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন ফারুকুলও। তবে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তিনি।
বেঁচে যাওয়া কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ফারুকুল ইসলাম জানান, মোট পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে মোশারেফ হোসেন সানু, নাসির উদ্দিন এবং ফারুকুল ইসলাম ছিলেন পিঠাপিঠি। পড়া শেষে প্রতি রাতেই ছোট দুই ভাই নাসির এবং ফারুকুলকে একাত্তরের প্রেক্ষাপট বোঝাতেন মোশারেফ হোসেন সানু। একপর্যায়ে তারা তিনজনেই বরগুনার ওয়্যারলেস স্টেশন গুঁড়িয়ে দেয়ার শপথ নেন। সেজো ভাই সানু বিয়ে করেছেন মাস তিনেক হয়েছে। নাসির তখন মেট্রিক পরীক্ষার্থী। আর কিশোর ফারুকুল পড়েন ক্লাশ নাইনে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতেন সানু। পরে সকল নির্দেশনা ছোট দুই ভাইয়ের সঙ্গে শেয়ার করতেন তিনি।
একদিন সানু জানালেন, বরগুনার ওয়্যারলেস স্টেশন থেকেই রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের সকল তথ্য পাঠিয়ে দেয় পটুয়াখালীর হানাদার ক্যাম্পে। তাই ওই ওয়্যারলেস অফিসটিই আগে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। এরপর অস্ত্র না থাকায় পরিকল্পনা করা হয় ওয়্যারলেস মেশিনটি আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার।
তিনি আরও জানান, ১৯৭১ এর ২১ মে সকাল ৮টার দিকে তিন ভাই মিলে ওয়্যারলেস অফিসে যান। সে সময় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা অহিদুল ইসলাম পান্না, গিয়াস উদ্দিনসহ আরও বেশ কয়েকজন ছিল তাদের দলে। ওয়্যারলেস অপারেটর মফিজের কাছে চাবি চাইলে তিনি তা দিতে অস্বীকার করেন। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে গোপনে ওঁৎ পেতে থাকা তৎকালীন ওসি আনোয়ার হোসেন ও তার দল তাদের ঘিরে ফেলে। এ ঘটনায় অন্য সবাই পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও ধরা পড়ে যান তিন ভাই। এরপর তাদের আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় বরগুনা জেলখানায়। সেখানে তিন ভাইয়ের পায়েই লোহার বেড়ি পরিয়ে দেয়া হয়।
এরপর ২৮ মে পটুয়াখালী থেকে ১০০ পাকিস্তানি সৈন্য আসে বরগুনায়। ২৯ মে সকাল ১০টায় ওসি আনোয়ারসহ জেলাখানায় আসে মেজর নাদের পারভেজ। তিন ভাইকে দেখিয়ে তাদের আটকের কারণ ব্যাখ্যা করে ওসি আনোয়ার। এ সময় ফারুকুলের ভাই সানু মেজর নাদের পারভেজের সঙ্গে দু-তিন মিনিট উর্দুতে কথা বলেন। এরপরেই মেজর নাদের পারভেজ অপর দুই ভাই নাসির এবং ফারুকুলকে গুলির নির্দেশ দিয়ে বড় ভাই সানুকে ধরে নিয়ে বাইরে চলে যায়।
তারপর বিভিন্ন সময় আটক অর্ধশত মানুষকে জড়ো করে ২৯ মে সকাল ৯টা থেকে শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ৩৮ জনকে হত্যা করল ওরা। সবশেষে নিয়ে যাওয়া হল দুই ভাই নাসির এবং ফারুকুলকে। তাদের দু’জনকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়া হল লাশের স্তূপের ওপর। তারপরই গুলি। গুলি খেয়ে পড়ে গেলেন দুজনেই। ফারুকুলের পিঠ ছুলে যায় বুলেটের আঘাতে। তবে বুলেট তাকে ভেদ করেনি।
কিছুক্ষণ সংজ্ঞাহীন থাকার পর কিশোর ফারুকুল বুঝলেন তিনি বেঁচে আছেন। তবুও মরার মত পড়ে থাকলেন তিনি। তার পিঠের ওপর দাঁড়িয়ে সকল লাশের ওপর বেয়নেট চার্জ করতে থাকল ওরা। উদ্দেশ্য গুলি খেয়েও কেউ বেঁচে না যায় তা নিশ্চিত হওয়া। এক সময় সকলের মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে যায় হানাদাররা।
মিনিট চার পাঁচ কেটে গেলে কোথায় যেন একটু নড়াচড়া অনুভব করলেন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ফারুকুল। দেখলেন, তার সেই সহোদর নাসিরকে। ভাই নাসির ফারুকুলের পায়ের বেড়ি ধরে টানছেন আর বলছেন, ফারুক তুই কি বেঁচে আছিস? তড়িঘড়ি করে উঠে বসে ফারুকুল বললেন, ‘হ্যা দাদা, আমি বেঁচে আছি। আমার গায়ে কোনো গুলি ঢোকেনি।’
এরপর দেখলেন বুলেটের আঘাতে নাসিরের পেটের নাড়িভুড়ি বেরিয়ে এসেছে বাইরে। ফারুকুল তা পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে চেপে ধরে রাখার চেষ্টা করলেন। ফারুকুলের দু’গালে দু’টো চুমু দিলেন ভাই নাসির। বললেন, ‘কোনো লাভ নেই। আমি বাঁচবো না। দোয়া করি, আল্লাহ যেন তোকে বাঁচিয়ে রাখেন। তুই যদি বেঁচে যাস, মাকে দেখে রাখিস।’ এরপরেই সে বলল, ‘আমাকে একটু পানি দে ভাই।’ কিশোর ফারুকুল বললেন, ‘পানি পাব কোথায়, চারিদিকে শুধু রক্ত আর রক্ত!’ মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকা সহোদর নাসির আবারও বললেন, ‘ফারুক, মরার সময় একটু পানিও পাব না!’
এরপর আর কোনো শব্দ বের হচ্ছিল না নাসিরের মুখ দিয়ে। শুধু বিড়বিড় করে কি যেন বলছিল। চোখের সামনে একসময় নিথর হয়ে গেল আপন ভাই নাসির। এরপর ভাই নাসিরের দু’চোখ বন্ধ করে দিলেন তিনি। এরপর তার মনে পড়ল অপর সহোদর সানুর কথা। মেজর নাদের পারভেজ যাকে নিয়ে গেছে। কোনো বধ্যভূমিতে তার মৃত্যু হয়েছে তা কে জানে। নিশ্চয়ই মৃত্যুর সময় তাকেও পানি দেয়নি কেউ।
এভাবে ভাবতে ভাবতে যখন আবারও জ্ঞান হারাতে যাচ্ছিলেন তখন, মৃত্যুর স্তূপে আবারও একটু নড়চড় অনুভব করলেন ফারুকুল। দেখলেন বয়স্ক একজন উঠে বসেছেন। চোয়ালের এক পাশে গুলি লেগে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। বিভৎস মুখমণ্ডল নিয়ে উঠে বসেছেন। কিশোর ফারুকুলকে বসা দেখে উদভ্রান্তের মত বলতে থাকলেন- ‘আমি বেঁচে আছি বাবা। আমি বাঁচবো।’
মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে বৃদ্ধের সে কি আকুতি চেহারায় নয়, কণ্ঠ শুনে কিশোর ফারুকুল তাকে চিনতে পারলেন। তিনি বরগুনার সবার পরিচিত কেষ্ট ডাক্তার। ফারুকুল বললেন, ‘কোনো নড়াচড়া না করে মৃতের মত পড়ে থাকেন। আপনার পায়ে বেড়ি নেই তাই আপনার বাঁচার সুযোগ আছে। সকল লাশের সঙ্গে আপনাকেও নিয়ে যখন মাটি চাপা দিতে যাবে তখন পালানোর চেষ্টা করবেন।’ বুলেটের যন্ত্রণায় ছটফট করা সে বৃদ্ধ ফারুকুলের কথা শুনেছিলেন। তবুও তার শেষ রক্ষা হয়নি। পরে জানা গেছে, মাটি চাপা দেয়ার সময় তিনি লাশের স্তুপ থেকে দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করেছিলেন। আর রাজাকাররা তখন তাকে কোদাল দিয়ে নৃসংশভাবে পিটিয়ে মেরেছিল।
মিনিট বিশেক পরে আবারও পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। স্থানীয় দু’জন রাজাকার এল। ফারুকুল তাদের চেনেন। তার সঙ্গে তাদের বিশেষ কোনো শত্রুতা ছিল না। তাদের উদ্দেশ্যে বুঝতে পারলেন ফারুকুল। তবুও তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘ভাই, আমি মরিনি। আমাকে বাঁচান।’ তারা বলল, ‘দ্যাখ, আমাদের কিছুই করার নেই। তোর বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। তারা যে সিদ্ধান্ত দেবেন, তাই হবে।’
ওই দুই রাজাকার চলে যাওয়ার মুহূর্তের মধ্যেই ফারুকুলের চারপাশে ৪০/৫০ জন পাকিস্তানি সৈন্য ছুটে এসে তার দিকে টমিগান তাক করে রাখল। একটু পরেই এল জল্লাদ ইকবাল। ইশারায় সবাইকে গান সরিয়ে নিতে বলল। ওরা তাকে উঠিয়ে ক্যাপ্টেনের কাছে নিয়ে গেল।
এরপর ক্যাপ্টেন তাকে জিজ্ঞেস করল। তোমার কাছে কোনো তাবিজ/কবচ আছে কিনা?। ফারুকুল উর্দু ভালো বুঝতেন না। তবুও অনুমানে তিনি বুঝতে পারলেন। উত্তর দিলেন, ‘না’। এরপর তাকে চেক করা হল। কিছুই পেল না ওরা।
ফারুকুলের সারা শরীর রক্তমাখা ছিল। পাক হানাদারারা তাকে গোসল করতে বললেন। গোসল করলেন ফারুকুল। তাকে স্টিলের একটি মগে এক কাপ গরম চা খেতে দেয়া হল। দেয়া হল এক প্যাকেট সিগারেট। চা-সিগারেটে তার অভ্যাস ছিল না। তারপরও তাকে তা খেতে বাধ্য করা হল। এরপর তাকে অন্য একটি কক্ষে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
এরপর ৩০ মে। এক এক করে আরও ১৭ জনকে গুলি করে হত্য করল ওরা। ফারুকুলের কক্ষের দরজা খুলল। তাকে টানাহেঁচড়া করে মৃত্যুপুরীর দিকে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। ফারুকুল বললেন, ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলতে চান তিনি। কিন্তু ওরা তার কথা শুনল না। সবাইকে ধাক্কা মেরে ছুটলেন ফারুকুল। ক্যাপ্টেন দূর থেকে তা দেখল। ফারুকুল চিৎকার করে বললেন, ‘আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই স্যার’। এরপর আকস্মিকভাবে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন ফারুকুল। তাকে ডাক্তার দেখানো হল। ডাক্তাররা তার অবস্থা সংকটাপন্ন বলে জানালেন।
এদিকে তিন সন্তানকে হারিয়ে ফারুকুলের পাগল প্রায় মা অমেরুননেছা বরগুনার তৎকালীন এসডিও আনোয়ার সাহেবের সঙ্গে দেখা করে ফারুকুলের মুক্তির জন্য হাতেপায়ে ধরলেন। এতে এসডিও সাহেবের দয়া হল। তিনি ফারুকুলের মায়ের অবস্থা দেখে পটুয়াখালীতে মেজর নাদের পারভেজের কাছে তার মুক্তির জন্য অনুরোধ জানালেন। এসডিও সাহেবের চেষ্টায় এক সময় মুক্তি পায় কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ফারুকুল। মুক্তি পেয়ে অনেকদিন অসুস্থ ছিলেন তিনি। এ অবস্থায় পুনরায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বিভিন্ন অপারেশনে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারেননি তিনি।
এর বেশকিছু দিন পর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী অভিযানে একসময় আত্মসমর্পণ করে বরগুনার রাজাকার আর আলবদররা। সর্বশেষ অপারেশনে বরগুনার আমতলী থানায় যুদ্ধ করতে করতে ধরা পড়ে ওসি আনোয়ার। সেসময় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জুলফিকার লোক পাঠিয়ে ডেকে নেন ফারুকুলকে। ফারুকুলকে তিনি বললেন, ‘ফারুক তোমার ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নাও। তুমি যা বলবে, আজ তাই হবে।
এরপর ওসি আনোয়ারসহ রাজাকার মোতালেব মাস্টার, হোসেন মাস্টার এবং কাওসারকে নিয়ে তারা বরগুনার বর্তমান বিদ্যুৎ অফিসের উত্তর দিকে নদীর পাড়ে নিয়ে যান। সেখানে ছুরি দিয়ে ওসি আনোয়ারের পেটে আঘাতের পর আঘাত করতে থাকেন ফারুকুল। এরপর পানি পানি বলে চিৎকার করলে ফারুকুল বলেন, ‘আনোয়ার! ঐ দ্যাখ, দুহাত দুরেই খাকদন নদী। অনেক পানি সেখানে। কিন্তু তা তোর মত বেইমানের জন্য নয়।’ এরপর লাথি দিয়ে তার দাঁত ভেঙ্গে দেন ফারুকুল। মৃত্যু হয় ওসি আনোয়ারের।
এ বিষয়ে বরগুনা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ৭১ এর বরগুনা জেলা সভাপতি আনোয়ার হোসেন মনোয়ার বলেন, গণ গ্রেফতারের খবর পেয়ে আমিসহ মুক্তিযোদ্ধারা বরগুনার বেতাগী উপজেলার কুমড়াখালি গ্রামে একত্রিত হয়ে ফারুকুলসহ অন্য বন্দিদের মুক্ত করার জন্য পরিকল্পনা করছিলাম। কিন্তু এরই মধ্যে হানাদাররা গণহত্যা চালায়। তাই আমরা এক প্রকার নিশ্চিত হয়েছিলাম- ফারুকুলসহ তার কোনো ভাই-ই বেঁচে নেই। পরে ফারুকুলের বেঁচে থাকার খবর আমরা যখন পাই, তখন আমরা বিস্মিত হই। পরে ফারুকুলের কাছ থেকে তার বেঁচে থাকার ঘটনা আমরা জেনেছি এবং খোঁজ নিয়ে এ ঘটনার সত্যতাও পেয়েছি।
শিরোনামবরগুনা