বরিশাল: গ্রীষ্মকালের ন্যায় বরিশালে বিদ্যুতের এখন তেমন চাহিদা নেই। তার পরেও বিদ্যুত বিভ্রাটে নাকাল বরিশালের মানুষ। হঠাৎ করেই জাতীয় গ্রিড থেকে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। গত এক মাস ধরে নগরীতে এলাকাভিত্তিক ঘন্টার পর ঘন্টা লোডশেডিংয়ের ফলে জনজীবন ওষ্ঠাগত। বিদ্যুতের অভাবে কল-কারখানার উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। গ্রামগঞ্জে পল্লীবিদ্যুত সমিতির গ্রাহকরা দিনে ঘন্টাচারের বিদ্যুত পেলেও তা লো-ভোল্টেজের কারনে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারছেন না। ভুক্তভোগীরা জানান, গত এক মাস ধরে নগরীর বটতলা, গোড়াচাঁদ দাস রোড, চৌমাথা, নবগ্রাম রোড, নথুল্লাবাদ, কাশীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় দিনে ৫ থেকে ৭ বার বিদ্যুত আসা-যাওয়া করে। ভোরে ফজরের নামাজ পড়তে গিয়েও বিদ্যুতবিহীন অবস্থার মোকাবেলা করতে হয়। নগরীর চৌমাথা ও হাতেম আলী কলেজ এলাকার একই অবস্থা। এ এলাকার মানুষ বিদ্যুত বিভ্রাটের কারণে রাতে ঘুমাতে পারেন না।
কাশীপুরসহ নগরীর দক্ষিণ অংশের বাসিন্দারাও নাকাল বিদ্যুত সংকটে। ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অপসোনিনের একাধিক কারখানা, মেডিমেট, কেমিস্ট ও রেফকো ল্যাবরেটরিজের উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। অমৃত ফুড, ফরচুন সুজ, এ্যাংকর সিমেন্ট, খান জুটেক্স ছাড়াও বিসিক শিল্প এলাকার কল-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যুত বিভ্রাটের কারণ সম্পর্কে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) প্রকৌশলী এবং ৩৩ কেভি গ্রিড সঞ্চালন লাইনের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় গ্রিড লাইন থেকে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার কারণে এ সংকট তৈরি হয়েছে। ওইসব কর্মকর্তারা আরও জানান, বরিশালে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১৫০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে জাতীয় গ্রিড থেকে পিক-আওয়ারে ৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুত সরবরাহ করা হতো। গত এক মাস পূর্বে হঠাৎ করে সরবরাহ ২০ মেগাওয়াট কমিয়ে ৭০ মেগাওয়াটে নিয়ে আসা হয়েছে। আর দিনের বেলায় আগে ৮০ থেকে ৮৫ মেগাওয়াট নিয়মিত সরবরাহ করা হতো।
প্রয়োজন হলে ৯০ মেগাওয়াট পর্যন্ত নেওয়া যেত। দিনে ৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুত পেলে বিন্দুমাত্র অভাব থাকে না। বর্তমানে দিনের সরবরাহ প্রায় ৩০ মেগাওয়াট কমিয়ে ৬০ মেগাওয়াট করা হয়েছে। হঠাৎ করে বিশাল এই বিদ্যুত ঘাটতি মোকাবেলায় হিমশিম খেতে হচ্ছে স্থানীয় বিদ্যুত বিক্রয় ও বিতরণ কর্তৃপক্ষকে। তারা এ সরবরাহ কমানোর ধাক্কা সামাল দিতে এলাকাভিত্তিক ঘন্টার পর ঘন্টা লোডশেডিং দিয়ে যাচ্ছেন। সূত্রমতে, সন্ধ্যা হলেই নগরজুড়ে অন্ধকার জেঁকে বসে। শিল্প উৎপাদনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার বিঘœ সৃষ্টি হয়। আগামী ১ নভেম্বর শুরু হচ্ছে জেএসপি পরীক্ষা, তার কিছুদিন পরই শুরু হবে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষাও ঘনিয়ে আসছে। এসব পরীক্ষার্থীদের পড়াশুনা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। গভীর রাতে বিদ্যুত বিভ্রাট ও রাতভর বিদ্যুত না থাকার ব্যাপারে প্রকৌশলীরা জানান, সার্কিটে ত্রুটি দেখা দেওয়ায় কয়েকটি এলাকায় বেশি সমস্যা হয়েছে।
বর্তমানে তেমন কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি নেই। নগরীতে যখন দিন-রাত বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার খেলা চলে তখন জেলার প্রতিটি উপজেলার গ্রামগুলো একেবারেই বিদ্যুতবিহীন। পল্লীবিদ্যুত সমিতির এসব গ্রাহক দিনে চার ঘন্টাও বিদ্যুত পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন। নগরীর পার্শ্ববর্তী চরমোনাই, চরকাউয়া, ডিঙ্গামানিক, চরবাড়িয়া, শায়েস্তাবাদ ও চাঁদপুরা এলাকায়ও বিদ্যুতের বেহালদশা। এসব গ্রামের বাসিন্দারা জানান, শুধু গভীর রাতে তাদের বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়। সারাদিন বিদ্যুত থাকে না। এসব এলাকার জনপ্রতিনিধিরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এবার তারা কোরবানির ঈদের দিনেও বিদ্যুত পাননি। চরমোনাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈয়দ ইসহাক মাওলানা আবুল খায়ের জানান, কোরবানির আগের দিন বেলা চারটায় বিদ্যুত চলে যায়। সারারাত বিদ্যুত আসেনি।
ঈদের দিন সকাল ৭টায় বিদ্যুত এসে আবার আটটায় চলে যায়। সকাল ৯টায় বিদ্যুত এসেছিল ৫ মিনিটের জন্য। এরপর সারাদিনের মধ্যে বেলা চারটায় বিদ্যুত এসে ঘন্টাখানেক ছিল। এখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বর্তমানে দপদপিয়া এলাকায় নির্মিত সামিট পাওয়ার লিমিটেড বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন ১২৫ মেগাওয়াট এবং গ্যাস টারবাইন থেকে ৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুত জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। বরিশাল থেকে দেড়শ মেগাওয়াট উৎপাদিত বিদ্যুত জাতীয় গ্রীডে যুক্ত হলেও বরিশালের মানুষ বিদ্যুত পাচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদ্যুত বিভ্রাটে জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন গৌরনদী পৌর এলাকাসহ ইউনিয়ন পর্যায়ে গ্রামাঞ্চলের গ্রাহকেরা। তারা যাওবা বিদ্যুত পাচ্ছেন তা লো-ভোল্টেজের কারণে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ব্যবহার করতে পারছেন না।
গ্রাহকের এ সমস্যা থেকে পরিত্রান দিতে কোরবানির ঈদের আগের দু’দিন স্থানীয় পল্লী বিদ্যুতের জোনাল অফিসের কর্মকর্তারা পৌর এলাকার গেরাকুল মহল্লার সাড়ে ৩৭ কেভি ট্যান্সফরমার পরিবর্তন করে গ্রাহকদের লো-ভোল্টেজের কবল থেকে মুক্ত করতে পারেননি। জোনাল অফিসের কর্মকর্তারা জানান, আশির দশকে নির্মিত বিদ্যুতের লাইনগুলো পুরনো হয়ে যাওয়ায় সঠিকভাবে বিদ্যুতের ভোল্টেজ পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। এমতাবস্থায় ওই এলাকায় নতুন করে এল্টি লাইন করা না হলে গ্রাহকের এ সমস্যা থেকেই যাবে। তবে কবে নাগাদ এল্টি লাইন করা যাবে তার কোন সদুত্তর দিতে পারেননি ওই কর্মকর্তারা। গতকাল মঙ্গলবার রাতে গৌরনদীতে বহুবার লোডশেডিংয়ের কবলে পড়তে হয়েছে বিদ্যুত গ্রাহকদের।
বরিশালের খবর