১০ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

সংবিধান সংস্কার দ্বাড়া রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ করা প্রয়োজন?

Sumon Hossain

প্রকাশিত: ১১:১৪ পূর্বাহ্ণ, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক,ঢাকা:: জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে সংবিধান সংস্কারের প্রসঙ্গ উঠেছে। আমাদের সংবিধান সংস্কার কেন জরুরি?

হাসনাত কাইয়ুম: অভ্যুত্থানের অনেক আগে থেকে আমরা এ কথাটি বলে আসছি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট যা-ই বলুন না কেন, সব সংকটের শিকড়ের ব্যাপার হলো সংবিধানের ক্ষমতাকাঠামো। এ সংবিধান যেসব লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে নির্ধারণ করেছিল, একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধের যে ঘোষণাপত্র ছিল—সবকিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে এ ক্ষমতাকাঠামো। বাংলাদেশের সংবিধানের মূল নীতি মূলত চারটি। এর বাইরে আরও অনেক নীতি আছে। নতুন রাষ্ট্র পত্তনের যে দর্শন ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেসব বাস্তবায়নের জন্য যে ধরনের ক্ষমতাকাঠামো দরকার, সংবিধানে আছে তার বিপরীত। সংবিধানের মূলনীতিতে ‘গণতন্ত্র’-এর কথা বলা হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা এক ব্যক্তি বা একটি পদে সোপর্দ করা হয়েছে। সেখানে কোনো ধরনের জবাবদিহির ব্যবস্থা রাখা হয়নি।

আরেক মূলনীতি হিসেবে ‘সমাজতন্ত্র’ আছে। তবে লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি, লুটপাট, পাচার—সবকিছু করা যাবে, কিন্তু কেউ এতে বাধা দিতে পারবে না। সে জন্য আমরা বলছি, বাংলাদেশের মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, মুক্তিযুদ্ধের যে অঙ্গীকার ছিল, সেটা বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধানের ক্ষমতাকাঠামোকে যেভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে, সেটাকে পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন-উপযোগী ক্ষমতাকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। বিগত ৫৩ বছরে এটা করা হয়নি। জনগণ বহু আন্দোলন করেছে, বিজয়ী হয়েছে কিন্তু বিজয়ের ফল বেহাত হয়ে গেছে। জনগণের সম্পদ, স্বাধীনতা, সম্মান লুণ্ঠিত হয়েছে। এর সবই হয়েছে আইনের মাধ্যমে, সংবিধানের ক্ষমতা দিয়ে। তাই সংবিধানের এই অন্যায্য ক্ষমতাকে পরিবর্তন করতে হবে। সংবিধান সংশোধন করে করা যাবে না, আবার এটা করার জন্য আপাতত পুরো সংবিধান ফেলে দেওয়ারও দরকার নেই। সংবিধানের ক্ষমতা অংশটাকে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী করে পুনর্বিন্যাস করলেই চলে। এ পরিবর্তন করাটাকেই আমরা সংবিধানের সংস্কার বলি। এটাই এখানকার মানুষের সমস্যা সমাধানের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উত্থানের মূলে সংবিধান। অন্যদিকে ৭২-এর সংবিধানে ফেরত যাওয়ার কথাও কোনো কোনো দল বা ব্যক্তি বলে থাকেন। সংবিধান নিয়ে এই ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

হাসনাত কাইয়ুম: এগুলো পুরোনো তর্ক। আমরা আমাদের ‘সংবিধান পর্যালোচনা’ বইয়ে এসব বক্তব্যের অসারতা দেখিয়েছি। দেশের যে নির্বাচনব্যবস্থা, সেটা ’৭২ সাল থেকেই কাজ করছে না। যে ক্ষমতায় থাকবে, তার মতো করেই নির্বাচনটা হবে। আর ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে গেলে তো ১২৩ (৩) অক্ষতই থাকবে। এ বিধানটা হলো, যে ক্ষমতায় থাকবে, তারা ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করতে পারবে। যে ক্ষমতায় থাকে, তার কাছে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে। এভাবে হলে তো নির্বাচনের কোনো অর্থ থাকে না। ’৭২-এর সংবিধানে ফেরত গেলে যদি এ সমস্যার সমাধান হতো, তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি থাকত না। এ তর্কটা তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে।যাঁরা একসময় এ আন্দোলনটা করতেন, তাঁরাই সেখান থেকে সরে এসেছেন। ড. কামাল হোসেন নিজেই স্বীকার করেছেন, এ সংবিধানের পরিবর্তন দরকার।

বাংলাদেশের সংবিধানে কী কী গুরুতর ত্রুটি আছে, যেগুলো রাষ্ট্র-চরিত্রকে স্বৈরাচারী ও গণবিরোধী করে তুলছে বারবার?
হাসনাত কাইয়ুম: আপাতত তিনটা বিষয় নিয়ে কথা বলা যায়। কেউ স্বৈরতন্ত্রী মানে, তাঁর ইচ্ছাই তন্ত্র, তিনি যা মনস্থ করেন তা-ই করতে পারেন, আইন-কানুন তেমন করেই তৈরি হয় বা থাকে, তাঁকে কৃতকর্মের জন্য কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। সারা পৃথিবীতে যেসব দেশে ন্যূনতম গণতন্ত্র আছে, সেসব দেশে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের একটা পদ্ধতি থাকে, সেটা নির্বাচন। কিন্তু বাংলাদেশে যাতে নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার হাতবদল হতে না পারে, সে ব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবেই করা হয়েছে ১৯৭২ সাল থেকে।বিষয়টা এ রকম না যে সেটা এরশাদ ক্ষমতায় এসে করে দিয়েছেন। এটা সাংবিধানিক কাঠামোর মাধ্যমেই করা হয়েছে।

এ সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রধানমন্ত্রীকে ‘ইমপিচ’ বা অপসারণ করার কোনো ব্যবস্থা সংবিধানের কোথাও নেই। ৭০ অনুচ্ছেদে বরং উল্টোটা আছে, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধাচরণ করলে, বিরুদ্ধে ভোট দিলে, সেই ব্যক্তির সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে। এই যে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন—বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ বা সংসদ এবং প্রশাসন বা সরকার, এই তিনটাকে যখন একজনের ইচ্ছাধীন করা হয়, যেসব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোও যখন বন্দী করা হয়, তখন এই ক্ষমতাই স্বেচ্ছাচারিতার জন্ম দেয়, গণতন্ত্র বিকাশের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। জবাবদিহিহীন, ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন সবকিছুই বাধা। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী সংবিধানের ঊর্ধ্বে, সংবিধান তাঁর অধীনে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেউ সংবিধান বা আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন না। থাকলে দেশে কোনো প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীর হাতে যদি তিন ভাগের দুই ভাগ সংসদ সদস্য থাকেন, তাহলে তাঁর কতটা ক্ষমতা—সেটা তিনি নিজেও জানেন না। তাঁর যখন যেটা ইচ্ছে, তিনি তখন সেটা করতে পারবেন। এ ধরনের ক্ষমতাতন্ত্র কখনো গণতন্ত্রের সঙ্গে যেতে পারে না। এভাবে একজনের কাছে ক্ষমতা দেওয়া, যেটা ’৭২ সাল থেকে চলে আসছে, বাংলাদেশের রাজনীতির মূল সংকটের প্রাণভোমরা এটাই।

শুধু কি সংবিধানের সংস্কার করলেই সমস্যার সমাধান হবে, নাকি রাজনৈতিক দলেরও সংস্কার দরকার।
হাসনাত কাইয়ুম: অবশ্যই রাজনৈতিক দলেরও সংস্কার দরকার। সেই সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনার আইনকানুনসহ অনেক কিছুর সংস্কার দরকার। কিন্তু আমাদের কোনো না কোনো পয়েন্ট থেকে শুরু করতে হবে এবং সে শুরুটা এমন হতে হবে, যেটা অন্যান্য সংস্কারের পথকে সহজ ও সুগম করবে। যেহেতু ক্ষমতার বৈধ এবং লিখিত উৎস হলো সংবিধান, সেহেতু সংবিধান দিয়েই সংস্কার শুরু করতে হবে। আগে রাজনৈতিক দলের সংস্কার করে, সংবিধান সংস্কারে পৌঁছা কঠিন হবে বা প্রায় অসম্ভব এই কারণে যে সংবিধান তথা রাষ্ট্র বা সরকার একপদকেন্দ্রিক থাকলে সেই রাষ্ট্র বা সরকার পরিচালনা করতে একপদকেন্দ্রিক দলই লাগবে, দল গণতান্ত্রিক হলে তারা সরকার টিকিয়ে রাখতে পারবে না। বাংলাদেশে যেসব রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় ছিল, রাষ্ট্রে এক ব্যক্তি যেমন প্রধান, তেমনি সেসব দলেও এক ব্যক্তিই প্রধান। অবশ্যই রাজনৈতিক দলের সংস্কার লাগবে।

রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন প্রতিষ্ঠার প্রথম থেকে রাষ্ট্র ও সংবিধান সংস্কারের কথা বলে আসছে। অন্যদের সংস্কারের সঙ্গে আপনাদের সংস্কারের পার্থক্য কোথায়?

হাসনাত কাইয়ুম: আমরা আসলে পার্থক্যের জায়গায় কাউকে দেখতে চাই না। আমরা দীর্ঘদিন একা একাই বলে আসছি। এখন দেশের বেশির ভাগ মানুষ বলছেন। আমরা এত দিন শুধু রাষ্ট্রের সংস্কারের প্রয়োজনের কথা বলে আসছি, এখন দেশবাসী সেই প্রয়োজনটা উপলব্ধি করছেন এবং প্রয়োজনীয়তা মেনে নিয়ে সংস্কার করার দাবি তুলছেন। কিন্তু রাষ্ট্রের কোন কোন ক্ষেত্র সংস্কার করতে হবে এবং কোন পথে সংস্কার করা হলে সেটা টিকে থাকবে_এই বিষয়গুলো নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি, তাই এ বিষয়ে ঐকমত্যও গড়ে ওঠেনি।যখন অধিকাংশ মানুষ এ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করবে, ঐকমত্যে পৌঁছাবে, তখনই সেটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। সমাজের মধ্যে এ আলাপটা ছড়িয়ে পড়ুক। আর এই আলাপটা করার জন্য বাংলাদেশে এখন একটা উর্বর পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

সংবিধান সংশোধনে আপনার পরামর্শ কী?
হাসনাত কাইয়ুম: আমরা সংশোধন চাইছি না, সংস্কার চাইছি এ কারণে যে আমরা ত্রয়োদশ সংশোধনীর অভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষণ করেছি। দীর্ঘ আন্দোলনে বিজয়ী হওয়ার পরে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা যুক্ত করা হলো। কিন্তু বিষয়টা উচ্চ আদালতে নেওয়ার পর বলা হলো, এই সংশোধনী সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী এবং তা বাতিল করা হলো। এখানে একটা টেকনিক্যাল সমস্যা আছে, মানে কত দূর পর্যন্ত পরিবর্তন হলে সেটা সংশোধনী হয় আর কত দূর পর্যন্ত পরিবর্তন করলে সেটাকে পরিবর্তন বলে, এটা নির্ধারণের ক্ষমতা আদালতের হাতে। এ ধরনের এখতিয়ারের দোহাই দিয়ে আমাদের অনেক রক্তদানের মধ্য দিয়ে যে ত্রয়োদশ সংশোধনী আনা হয়েছিল, সেটাকে নাই করে দেওয়া হয়েছে।

সে জন্য আমরা বলি, যেভাবে প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতাহীন করা হয়েছে এবং সংসদকে যেভাবে ক্ষমতাহীন করা হয়েছে, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বিচার বিভাগকে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে আনা হয়েছে কিংবা রাষ্ট্রের বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে নির্বাহী বিভাগের অধীনে নিয়ে আসা হয়েছে—এ বিষয়গুলোকে আর সংশোধনীর মাধ্যমে ঠিক করা যাবে না। এটার জন্য সংস্কার লাগবে। এ জন্য আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে দুটি। এক. জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করার জন্য টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের নির্বাচন কীভাবে হবে? তার জন্য একটা টাস্কফোর্স হতে পারে। বাংলাদেশের সংসদ বা আইন বিভাগ কীভাবে পরিবর্তিত হবে, তা নির্ধারণের জন্য একটা টাস্কফোর্স গঠিত হতে পারে। যে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এটা গঠিত হবে, তাঁরা একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মতামত দেবেন।

দুই. পাশাপাশি সরকার আর একটা বা একাধিক কমিশন গঠন করতে পারে। যারা বাংলাদেশে যত রাজনৈতিক দল আছে, অরাজনৈতিক সংগঠন আছে এবং বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ আছে, তাদের সকলের সঙ্গে আলোচনা করে—বাংলাদেশকে তারা কীভাবে দেখতে চায়, তারা বাংলাদেশের কাছে কী চায় এবং কী চায় না—এসব মতামত সংগ্রহ করবে। টাস্কফোর্স বা বিশেষজ্ঞ মতামতের সঙ্গে জনগণের আকাঙ্ক্ষা মিলিয়ে দেখলে, পর্যালোচনা করলে একটা ন্যূনতম ঐকমত্য বের হয়ে আসবে। সে ঐকমত্য ধরে সরকার একটা সংস্কার রূপরেখা তৈরি করতে পারে। জনগণের কাছ থেকে পাওয়া সংস্কারের এই রূপরেখা বাস্তবায়নের জন্য, সরকার ‘সংস্কার পরিষদ’ বা ‘রিফর্ম এসেম্বলি’র একটা নির্বাচন ঘোষণা করতে পারে। নির্বাচিতরা এসে জনগণের সেইসব আকাঙ্ক্ষাকে সংবিধানের
ভাষায় লিপিবদ্ধ করে গণভোটে অনুমোদন করিয়ে নিলেই এ সংস্কারটি বিশ্বজুড়ে গ্রহণযোগ্য এবং দেশের মধ্যে দীর্ঘজীবী হতে পারে।

সংস্কারকৃত সংবিধানে জাতীয় নির্বাচনের যে বিধান করা হবে, সে বিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিতদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই একটি সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচারের রাষ্ট্র হওয়ার পথে নতুন যাত্রা করতে পারে।

111 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন