সন্তানের নিষ্ঠুর নির্যাতনে শিকার হয়ে বাড়ি ছাড়া মা
নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল: সন্তানের নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়ে আদালত, পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সকলের দারস্থ হয়েছেন বিচার চেয়ে। কিন্তু নির্যাতন বন্ধ হয়নি। উল্টো ঘরের মধ্যে রেখে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার হুমকি ও মারধরে পাঁচদিন ধরে বাড়ি ছাড়া দিন কাটছে অশীতিপর বৃদ্ধা সাহেদা আক্তারের। বৃদ্ধার বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের সোহাগী ইউনিয়নের বগাপুতা গ্রামে।
বগাপুতা গ্রামের গ্রামের প্রয়াত জাহের উদ্দিনের স্ত্রী তিনি। দুই ছেলে আবদুল আওয়াল ও আখেদ আলী ওরফে আক্কাসকে ছোট রেখে মারা যান যান স্বামী। স্বজনদের সহায্যে ও মানুষের বাড়িতে কাজ করে বড় করে তোলেন জঠরে ধারণ করা দুই সন্তানকে। তাদের বিয়ে দিয়ে ঘরে নতুন বউ আনার পর শুরু হয় জটিলতা।
সন্তানদের অভাবের সংসারে হাল ধরতে চব্বিশ বছর আগে ঢাকায় গৃহকর্মীর কাজে যান। যা পেতেন সব দিয়েই সন্তানদের সংসারে হাল ধরেছিলেন। দুই ছেলের ৫ নাতি-নাতনীকে পড়ালেখা ও বিয়েও দিয়েছেন গৃকর্মীর কাজ করে। কিন্তু গত চার বছর আগে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় ডান হাত ও পড়ে গিয়ে কোমড় ভেঙে যাওয়ায় অচল হয়ে পড়েন তিনি।
চিকিৎসায় কিছুটা সেরে উঠলেও বৃদ্ধ বয়সে কাজের ক্ষমতা হারান। তাই গ্রামে ছেলে আবদুল আওয়ালের সংসারে এসে বোঝা হন তিনি। ছেলের সংসারে কর্মহীন সাহেদা আসার পর থেকেই শুরু হয় জটিলতা। ঠিক মতো খেতে না দেওয়ায়, তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাকে মারধর করতেন ছেলে আওয়াল ও তার স্ত্রী রওশন আরা। গত চার বছরে কয়েকদফা ছেলের নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়ে রক্তাক্ত হয়েছেন।
গত ২০২১ সালে ছেলের কাছে ধার দেওয়া ১০ হাজার টাকা চাওয়ায় শুরু হয় মায়ের ওপর অকথ্য নির্যাতন। মাকে মারধর করে মায়ের কক্ষ থেকে ঘর বাঁধার এক লাখ টাকাও নিয়ে যান।
বিষয়টি নিয়ে ময়মনসিংহ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে একটি মামলা করেন বৃদ্ধা মা। ছেলে আওয়াল, পুত্রবধূ রওশন আরা ও প্রতিবেশী নাতি জসিম উদ্দিনকে আসামী করে ওই মামলাটি করা হয়।
মামলাটিতে আদালতে হাজিরা দেবার তারিখ আসলেও মায়ের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায় মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য। মামলাটির আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমিনুল হক মিলন বলেন, আদালতে মায়ের সঙ্গে আপোষ হবার শর্তে ছেলেকে জামিন দিয়েছিল।
সর্বশেষ হাজিরায় আদালত পূণরায় মায়ের সঙ্গে আপোস করতে বলে দেয় ছেলেকে। ছেলেই তা মেনে বাড়ি যায়। সম্প্রতি ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ সুপারের কাছে বৃদ্ধা একটি লিখিত অভিযোগ দেন।
শারীরিক নির্যাতন থেকে রক্ষাসহ সম্পত্তি উদ্ধার এবং সুবিচার পাওয়ার জন্য ওই আবেদনটি করেন বৃদ্ধা। এতে বলা হয় আওয়াল তার ছোট ভাই আখেদ ওরফে আক্কাসে সম্পত্তি জোরপূর্বক দখল করে রেখেছে।
বৃদ্ধাকে শারীরিক নির্যাতন করে গরু বিক্রির ৩০ হাজার টাকা ও ১ লাখ ১০ হাজার টাকা নিয়ে যায় ছেলে আওয়াল। ঘটনাটি তদন্তের জন্য গত মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) বৃদ্ধার বাড়িতে যান ঈশ্বরগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. ছায়েদুর রহমান।
ওই সময় বৃদ্ধা ও অভিযুক্ত ছেলে কাউকে পুলিশ না পেয়ে প্রতিবেশী ও বাড়ির অন্যদের সঙ্গে কথা বলে চলে যান এসআই। বাড়িতে ফিরে আওয়াল পুলিশ আসার কথা জেনে ক্ষুব্ধ হয় মায়ের ওপর।
বাড়িতে কেন পুলিশ এসেছে সে কারণে শুরু হয় মায়ের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন। মারধর করে ঘর থেকে বের করে বৃদ্ধার ছাপড়া ঘরে তালা লাগিয়ে দেয় পুত্রবধূ। টানা হেঁচড়া করে বের করায় বৃদ্ধার হাতে ক্ষত হয়।
বাড়ি থেকে না গেলে ঘরে আটকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার হুমকি দিলে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয় বৃদ্ধা মা। পরে আশ্রয় নেয় দুই কিলোমিটার দূরের সাহেবনগর গ্রামের বৃদ্ধার ননদের ছেলে আবদুছ ছাত্তারের বাড়িতে।
বৃদ্ধা সাহেদা আক্তার বলেন, সারাটা জীবন সন্তানদের জন্য খেটেছেন। যে পেটে ছেলেকে ধরেছিলেন সেই পেটেই ছেলে লাথি মারে। গলাটিপে মেরে ফেলতে চায়। তার ভাঙা শরীরে মারধরের কারণে তার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেছে।
বাড়িতে কেন পুলিশ এলো সে কারণে তাকে বাড়ি ছাড়া করেছে। তিনি বলেন, আদর করে সন্তানকে বড় করে এখন কাল হয়েছি। চুলের মুঠি ধরে, লাঠি দিয়ে তাকে মারধর করে। ছেলের নিষ্ঠুর নির্যাতনের সুষ্ঠু বিচার চান তিনি।
বৃদ্ধার ছোট ছেলে আখেদ আলী বলেন, তার মা ঢাকা থেকে বাড়ি যাবার পর বড় ভাইয়ের ঘরে থাকতো। কিন্তু মারধর করে ঘর থেকে বের করে দিলে তিনি একটি ছাপড়া ঘর করে দিয়েছেন।
তার ভাইয়ের কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করার মতো শক্তি তার নেই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও তার ভাইয়ের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারে নি।’ বৃদ্ধার আশ্রয়দাতা আবদুছ ছাত্তার বলেন, বারবার ছেলে মাকে মারধর করছে। স্থানীয় ভাবে ঘুরেও বিচার পায়নি মা। বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ায় তিনি বাড়িতে এনে আশ্রয় দিয়েছেন।
এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত, যেনো সকল ছেলেরা সর্তক হয়। মায়ের উপর কেউ যেনো অবিচার করতে না পারে। বৃদ্ধার ছেলে আওয়ালের সন্ধানে তার বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তখন বৃদ্ধার ঘরটিতে তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। পুত্রবধূ রওশন আরা বলেন, তার শ্বাশুরির স্বভাব খারাপ। তারা মারধর করেন নি।
মিথ্যা অভিযোগ তোলা হচ্ছে। শ্বাশুরি কেন বাড়িতে নেই তা বলতে পারবেন না। সোহাগী ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান বলেন, মাকে মারধর করার বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকবার সালিশ করেন তিনি। মাকে ছেলে মারধরের ঘটনা সত্য।
সন্তান মাকে মারধর করে এটি কষ্ট লাগে। তিনি নিজে অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন।’ বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল কাদির বলেন, খবর পেয়ে গত বৃহস্পতিবার আওয়ালকে পরিষদে ডেনে আনা হয়।
ছেলের অভিযোগ তার প্রতি মায়ের আত্মবিশ্বাস নেই, সে কারণে মা তার কাছে থাকে না। ছোট ছেলের কাছে থাকতে চায়। মা-বাবাকে যে সন্তান আদর সোহাগ না করে সে সন্তান থাকার চেয়ে না থাকা ভালো।
মা যেনো কষ্ট না পায় সে জন্য আওয়ালকে বলে দেওয়া হয়। ঈশ্বরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাছিনুর রহমান বলেন, পূণরায় ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হবে। প্রয়োজনে ছেলেকে তাদের হেফাজতে নেওয়া হবে।
দেশের খবর