Sumon Hossain
প্রকাশিত: ০১:৩৩ অপরাহ্ণ, ০৩ অক্টোবর ২০২৪
নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল: ব্রিটিশ ভারতে ১৮৯৫ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) পরীক্ষায় বসার সর্বনিম্ন বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয় ২১ বছর। আর সর্বোচ্চ বয়সসীমা ছিল ২৩ বছর। বাংলাদেশে সর্বোচ্চ বয়সসীমা বাড়তে বাড়তে এখন ৩০ বছরে দাঁড়িয়েছে। তবে কোটার প্রার্থীদের ক্ষেত্রে তা আরও দুই বছর বেশি, মানে ৩২ বছর।
এখন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবি উঠছে। কয়েক শ তরুণ গত সোমবার এ দাবিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারি বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে অবস্থান নেন। সরকারও বিষয়টি পর্যালোচনায় একটি কমিটি গঠন করেছে।
প্রশ্ন উঠেছে, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করা যৌক্তিক কি না। বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের লোকপ্রশাসনের একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, জনপ্রশাসন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সাবেক একজন সচিব ও সরকারি চাকরি আইনে একজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে। তাঁদের দুজন ৩৫ বছর করার যৌক্তিকতা নেই বলছেন। একজন বলেছেন, স্থায়ীভাবে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ বছর করা যাবে না। তবে সাময়িক একটা ছাড় দেওয়া যেতে পারে।
ভারতে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে সাধারণ বয়সসীমা ৩২ বছর। পাকিস্তানে অবশ্য তা ৩০ বছর। বিশেষজ্ঞরা চাকরি বাড়ানোর ওপরও জোর দিচ্ছেন, যাতে তরুণেরা বেকার না থাকেন।
কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ এ-ও বলছেন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর না করে ৩২ বছর করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও সাধারণ চাকরিপ্রত্যাশীদের মধ্যে ব্যবধান ঘুচিয়ে দেওয়া যায়। বাংলাদেশে বিসিএস ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণ সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে তা ৩২ বছর।
ভারতে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে সাধারণ বয়সসীমা ৩২ বছর। পাকিস্তানে অবশ্য তা ৩০ বছর। বিশেষজ্ঞরা চাকরি বাড়ানোর ওপরও জোর দিচ্ছেন, যাতে তরুণেরা বেকার না থাকেন।
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির দাবি পর্যালোচনায় গঠিত কমিটির প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী বুধবার সচিবালয়ে বলেছেন, চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধির দাবির যৌক্তিকতা আছে। তিনি বিভিন্ন দেশের কথা উল্লেখ করে বলেন, এখনকার বয়স যেটি আছে তা বাড়ানো উচিত। তবে কতটুকু করা যৌক্তিক তা সার্বিক পরিস্থিতির আলোকে চিন্তা করা হবে।
সাধারণভাবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ৩০ হলেও বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, অধিদপ্তর, বিধিবদ্ধ সংস্থায় বিভিন্ন পদে নানা রকম বয়সসীমা আছে। এসব পদ নন-ক্যাডার। বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর পদ, চিকিৎসক নিয়োগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশি বয়সেও প্রার্থীরা আবেদন করতে পারেন।
সরকারি চাকরি আইনের বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া
বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের সাবেক রেক্টর ও সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদারের লেখা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ইতিহাস বইয়ের তথ্যানুযায়ী, ব্রিটিশ ভারতের শেষ দিকে আইসিএস পরীক্ষা দেওয়ার সর্বোচ্চ বয়স ছিল ২৩ বছর। পাকিস্তান আমলে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এ বয়সসীমা ২৪ বছর নির্ধারিত ছিল। পরে ১৯৬৩ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়ে বয়সসীমা ছিল ২৫ বছর।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা সর্বোচ্চ ২৭ বছর নির্ধারণ করা হয়। ১৯৯১ সালের ৩১ জুন তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের জারি করা এক প্রজ্ঞাপন বলছে, তখন বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয় ৩০ বছর।
বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিটি অনেক বছর ধরেই তোলা হচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন হওয়া আওয়ামী সরকার দাবিটি পূরণ করেনি। তবে করোনার সংক্রমণজনিত পরিস্থিতির কারণে সাময়িক ছাড় দেওয়া হয়েছিল। যেমন ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে এক প্রজ্ঞাপনে সরকারি সব চাকরির ক্ষেত্রে নিয়োগে (বিসিএস ছাড়া) প্রার্থীদের সর্বোচ্চ বয়সসীমায় ৩৯ মাস ছাড় দেয় সরকার।
অবশ্য বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, সেশনজট, প্রশ্নপত্র ফাঁস, দুর্নীতি ও অনিয়ম এগুলো প্রশাসনিক সমস্যা। বয়সসীমা বাড়ানো হলেও এসব সমস্যা থাকবে। এটা দূর করতে পদক্ষেপ দরকার।
সরকারি চাকরি আইনের বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণভাবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ৩০ হলেও বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, অধিদপ্তর, বিধিবদ্ধ সংস্থায় বিভিন্ন পদে নানা রকম বয়সসীমা আছে। এসব পদ নন-ক্যাডার। বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর পদ, চিকিৎসক নিয়োগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশি বয়সেও প্রার্থীরা আবেদন করতে পারেন।
ফিরোজ মিয়া উদাহরণ দেন যে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে ট্রান্সপোর্ট ইকোনমিস্ট ও সিস্টেম অ্যানালিস্ট পদে বয়স ৪০ বছর হলেও আবেদন করা যায়। বিভিন্ন সংস্থায় এমন বহু পদ রয়েছে। তিনি বলেন, স্থায়ীভাবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করা ঠিক হবে না। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বয়সে দুই বছরের ছাড় দেওয়া যেতে পারে।
সরকারি চাকরিতে প্রবেশে বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁরা নানা যুক্তি তুলে ধরছেন। তাঁদের দাবি, ১৬২টি দেশে বয়সসীমা ৩০ বছরের বেশি। তাঁরা করোনাকালে ক্ষতিগ্রস্ত, সেশনজটে আক্রান্ত এবং প্রশ্নপত্র ফাঁস, দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে চাকরি পাননি। বিসিএসে দীর্ঘসূত্রতা, দেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং ২০১১ সালে সরকারি চাকরির অবসরের সময় বাড়লেও প্রবেশের বয়সসীমা না বাড়ানোকে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেন তাঁরা।
সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা স্থায়ীভাবে বৃদ্ধি চাই—৩৫ প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদ নামের আন্দোলনকারীদের একটি সংগঠনের জনসংযোগের দায়িত্বে থাকা খাদিজা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, এই আন্দোলন শুরু হয়েছে ২০১২ সাল থেকে। তাদের দাবি মানা হয়নি। তিনি জানান, তিনি রংপুরের সরকারি কারমাইকেল কলেজে পড়েছেন। ২০১৮ সালে স্নাতক শেষ হয়েছে। সেশনজটের কারণে তিনি ৩০ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত চার বছরের মতো সময় সরকারি চাকরিতে আবেদন করতে পেরেছেন।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, আশপাশের দেশ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশের উদাহরণ বাংলাদেশে খাটে না। কারণ, ওই সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারি চাকরি ও নিয়োগের ধরনে ভিন্নতা আছে।
অবশ্য বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, সেশনজট, প্রশ্নপত্র ফাঁস, দুর্নীতি ও অনিয়ম এগুলো প্রশাসনিক সমস্যা। বয়সসীমা বাড়ানো হলেও এসব সমস্যা থাকবে। এটা দূর করতে পদক্ষেপ দরকার।
সাবেক একজন সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিকদের বলেন, ৩৫ বছর বয়সে একজন ব্যক্তি চাকরিতে প্রবেশ করলে প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে দক্ষ হতে হতে বয়স ৪৫ হয়ে যাবে। এত বয়সে নিয়োগ পাওয়াদের পেছনে বিনিয়োগ করে সরকার বেশি দিন তাঁদের সেবা পাবে না। প্রয়োজনে এটা ৩২ করা যেতে পারে। তাও স্থায়ীভাবে নয়।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, আশপাশের দেশ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশের উদাহরণ বাংলাদেশে খাটে না। কারণ, ওই সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারি চাকরি ও নিয়োগের ধরনে ভিন্নতা আছে।
যুক্তরাজ্যে আইন পেশায় নিয়োজিত সাব্বির আহমেদের কাছে সেখানে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে জানতে চাইলে সাব্বির আহমেদ বলেন, যুক্তরাজ্যে সরকারি চাকরির ‘ফাস্ট স্ট্রিম প্রোগ্রামে’ যোগ দিতে হলে সাধারণত প্রার্থীদের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে হতে হয়। ফাস্ট স্ট্রিম হলো সিভিল সার্ভিসের একটি কর্মসূচি, যার মাধ্যমে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ভবিষ্যতের সিভিল সার্ভেন্টদের প্রস্তুত করা হয়। তবে সাধারণ সরকারি চাকরির পদের জন্য বয়সের নির্দিষ্ট সীমা নেই। বিশেষ করে যদি প্রার্থীরা অভিজ্ঞতা সহকারে আবেদন করেন।
সাব্বির আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে বিসিএসে একটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ হয়। যুক্তরাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন পরীক্ষা এবং সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে প্রার্থীদের বাছাই করা হয়।
বাংলাদেশে এখন উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে সার্বিক বেকারত্বের হার যেখানে সাড়ে ৩ শতাংশের কিছু বেশি, সেখানে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব ১২ শতাংশ। সংখ্যার বিচারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বেকার বসে আছেন প্রায় আট লাখ নারী-পুরুষ।
অবশ্য দেখা গেছে, যাঁরা বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাঁরা সফল হয়েছেন পড়াশোনা শেষ করার কয়েক বছরের মধ্যেই। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৪১তম বিসিএসে প্রায় ৪০ শতাংশ এবং ৪৩তম বিসিএসে প্রায় ৩৮ শতাংশ প্রার্থীর বয়স ২৩ থেকে ২৫ বছর বয়সের মধ্যে। অন্যদিকে বেশি বয়সী প্রার্থীর সফলতার হার অনেক কম। ৪১তম বিসিএসে ১৩ শতাংশ এবং ৪৩তম বিসিএসে ১৬ শতাংশের মতো প্রার্থীর বয়স ২৭ বছর বা তার চেয়ে বেশি। এর মধ্যে ২৯ বছরের বেশি বয়সী প্রার্থী মাত্র ১-২ শতাংশ।
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার যৌক্তিকতা ও আইনি কারণ নেই। এ আলোচনা ও সুপারিশের পেছনে কিছু রাজনৈতিক বিষয় কাজ করে থাকতে পারে। তিনি বলেন, সরকার এখন কত পদ খালি আছে, তা পর্যালোচনা করে দেখতে পারে। এরপর ধাপে ধাপে সেগুলো পূরণের ব্যবস্থা করতে পারে, যাতে তরুণেরা চাকরি পান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক পরীক্ষা দিয়েই শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে আবেদন করতে পারেন। তাঁদের অনেকে দ্বিতীয়, তৃতীয় অথবা চতুর্থ বর্ষে পড়াশোনার সময়ই সরকারি চাকরির পড়াশোনা শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হয় বয়স ২২ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। ফলে ৮ থেকে ৬ বছর তাঁরা চাকরিতে আবেদনের সুযোগ পান।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের সমস্যা হলো বেকারত্ব, বেসরকারি চাকরিতে অনিশ্চয়তা, সরকারি চাকরিতে পদ খালি থাকলেও সময়মতো নিয়োগ না হওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও চাকরির বাজারের চাহিদার ভিন্নতা ইত্যাদি। সেই সব সমস্যা সমাধানে জোর দেওয়া জরুরি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান এ বিষয় সাংবাদিকদের বলেন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার যৌক্তিকতা ও আইনি কারণ নেই। এ আলোচনা ও সুপারিশের পেছনে কিছু রাজনৈতিক বিষয় কাজ করে থাকতে পারে। তিনি বলেন, সরকার এখন কত পদ খালি আছে, তা পর্যালোচনা করে দেখতে পারে। এরপর ধাপে ধাপে সেগুলো পূরণের ব্যবস্থা করতে পারে, যাতে তরুণেরা চাকরি পান।