বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ১১:৪৫ অপরাহ্ণ, ০৭ অক্টোবর ২০১৬
বরিশাল: বরিশাল তথা বৃহত্তর দক্ষিনাঞ্চলে বিএনপি রাজনীতির শীর্ষে অবস্থানকারী নেতা কেন্দ্রিয় বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব ও একাধিক পদ আগলে রাখা এ্যাড. মজিবর রহমান সরোয়ার বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না। একা দলের বৃহদাংশ পদ দখলে রেখে বরিশাল বিএনপিকে একঘেয়ে রাজনীতির বৃত্তে বন্দি করে রেখেছে বলে তৃণমূলের যে দাবী তার প্রেক্ষিতে কেন্দ্রিয় বিএনপির পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে আবার নতুন করে আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়েছে নগরীতে। বর্তমানে বরিশাল বিএনপি এই পদ প্রশ্নে নানামুখি মত এবং পথে বিভক্ত হয়ে পরেছে। সরোয়ার ঘরানার বাইরের নেতারা চাইছেন এই বলয় ভেঙ্গে নৃতৃত্বের বিকেন্দ্রিকরণ করতে।
কিন্তু কৌশলে বেকে বসেছেন হেভিওয়েট নেতা এ্যাড. মজিবর রহমান সরোয়ার। যে কারনে ইতিমধ্যে তার অনুসরনকারী নেতাদের দিয়ে গণ-পদত্যাগের হুমকিও দিয়েছেন তিনি। এর পরপরই সরগরম হয়ে উঠেছে বিএনপি কেন্দ্রিক স্ব-দলীয় রাজনীতি। খোদ মহানগরের কতিপয় নেতা মনে করেন, সরোয়ার যেহেতু কেন্দ্রিয় বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল সেহেতু বরিশাল মহানগরে নতুন কাউকে দেয়া যেতে পারে। এর ফলে দল আবার চাঙ্গা হবে এবং দলেও নতুন নেতৃত্ব আসবে। কিন্তু এমন যুক্তিকে খোড়া দাবী করেছেন সরোয়ার পন্থিরা।
তাদের মত হলো, মজিবর রহমান সরোয়ার ছাড়া বরিশাল বিএনপি মৃতপ্রায়। দলকে বাচাতে হলে মজিবর রহমান সরোয়ারের কোন বিকল্প নেই। কারন দলের দুর্দিনে কেবলমাত্র তিনিই দলকে ধরে রেখেছেন প্রতিকূলতার মধ্যেও। যা অন্য কেউ পারেনি। এক নেতার বহুপদ এই নীতি থেকে সরে আসার জন্য এবং বিএনপিকে ঢালাওভাবে সাজানোর জন্য সম্প্রতি কেন্দ্রিয় বিএনপি উদ্যোগ নেয়। সে অনুসারে এক নেতার এক পদ নিয়ম মেনে প্রক্রিয়া শুরু করে।
যার প্রেক্ষিতে পদ ছাড়ার জন্য ইতিমধ্যে সারাদেশে অন্তত ৪৫ জন নেতাকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে মজিবর রহমান সরোয়ারের নামও রয়েছে। চিঠিতে স্ব-ইচ্ছায় যেকোন একটি পদ রেখে অন্য পদ থেকে পদত্যাগের জন্য বলা হয়। যদিও মজিবর রহমান সরোয়ার বলছেন এখন পর্যন্ত তিনি এ ধরনের কোন চিঠি পাননি। তিনি বলেন, পদ ছাড়া না ছাড়ার ব্যাপারে ম্যাডাম বেগম খালেদা জিয়া) আমার সাথে কোন ধরনের আলোচনা করেননি। দুটি পদের মধ্যে একটি ছাড়তে হলে সরোয়ার কোনটা ছাড়বেন সেটা নিয়েই এক ধরনের সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। মহানগর পদ না থাকলে বরিশালের রাজনীতিতে সরোয়ারের অবস্থানটা আগের মত থাকবে না। আবার যুগ্ম মহাসচিবের মত গুরুত্বপূর্ন পদ ছাড়লে জাতীয় রাজনীতিতে সরোয়ারের অবস্থানটা বলতে গেলে শূন্যের কোটায় চলে আসবে। ফলে সিদ্ধান্ত সংকটে সরোয়ার ও তার রাজনীতি।
ইতিমধ্যে ৬ অক্টোবর সংবাদ ম্মেলন করেছে মহানগরের সরোয়ার অনুসারীরা। তারা দাবী করেছে, বরিশাল বিএনপিকে জীবিত রাখতে হলে মজিবর রহমানের কোন বিকল্প নেই। বিভাগের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মহানগর। তাই মজিবর রহমান সরোয়ারের ব্যাপারে সিদ্ধান্তের আগে নেতাকর্মীদের অবস্থা আগে বুঝতে হবে। সরোয়ারকে যুগ্ম মহাসচিবের পাশাপাশি মহানগর বিএনপির সভাপতি পদে রাখতে হবে। তা না হলে গণপদত্যাগের মত কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবেন মহানগর বিএনপির নেতারা। মজিবর রহমান সরোয়ারকে মহানগর বিএনপির সভাপতির পদে না রাখলে মানববন্ধন, অনশন, সমাবেশসহ কঠোর কর্মসূচি দেয়ার ঘোষনা দেন তারা। আর মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক জিয়াউদ্দীন সিকদার বলেছেন, মজিবর রহমান সরোয়ারের বাইরে মহানগরের নেতৃত্ব দেয়ার মত কেউ নেই।
তিনি (সরোয়ার) দক্ষিনাঞ্চল বিএনপির অভিভাবক। যুগ্ম মহাসচিবের পাশাপাশি মহানগর বিএনপির পদেও তাকে রাখতে হবে। এদিকে মহানগরের পদ যেন মজিবর রহমান সরোয়ার আটকে রাখতে না পারে সেজন্য ভিন্ন পথে হাটছেন তার বিপরীত স্রোতের বিএনপি নেতারা। সূত্র জানিয়েছে বরিশালে মজিবর রহমান সরোয়ারকে নিয়ে যেসব আপত্তি রয়েছে তার ফিরিস্তি ইতিমধ্যে দলীয় চেয়ারপার্সনের দফতরে পাঠিয়েছে স্থানীয় নেতারা। একই সাথে বিষয়গুলো বিবেচনা করে মহানগরে রাখা না রাখার সিদ্ধান্তে আসার অনুরোধ জানানো হয়েছে বলে মুঠোফোনে জানিয়েছেন কয়েকজন নেতা।
তারা আরও জানান, দেশে ৪৫ জনের একই ধরনের অভিযোগে পদ ছাড়ার চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রিয় বিএনপি। বাকি ৪৪ জায়গা থেকে দলের হাই কমান্ডের বিরোধী কোন পদক্ষেপ নেয়নি কেউ। কেবলমাত্র বরিশালই হাইকমান্ডের বিপরীতে দাড়িয়েছে। কারন দেশের অন্য কোথাও চেয়ারপার্সনের সিদ্ধান্তের বিপরীতে কথা না বললেও বরিশালে সংবাদ সম্মেলন করে ফেলেছে। এখানে স্পষ্ট যে বরিশালে বিএনপির চেয়ে মজিবর রহমান সরোয়ারকে বড় করে রেখেছেন নিজে। তবে সরোয়ার ঘরানার বাইরের এসব নেতারা কেউ নিজেদের নাম গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে চাননি। তারা জানিয়েছে সরোয়ারের বিষয়ে তারা যে আপত্তি তুলে লিখিত অভিযোগ কেন্দ্রে পাঠিয়েছে তার মধ্যে বেশকিছু বিষয় তুলে ধরেছেন। তাদের ভাষ্যমতে, দলে একক অধিপত্য কায়েম করলেও মজিবর রহমান সরোয়ার কখনোই তৃণমূল নেতাদের আমলে নেননি।
যে কারনে ২০১৪ সালের শেষ দিকে সায়েস্তবাদে একক কর্তৃত্বের বলে নিজস্ব লোককে দিয়ে কমিটি গঠন করতে গিয়ে যে বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন। কমিটি ঘোষনা নিয়ে এই হেভিওয়েট নেতার সামনে ঘটে যাওয়া সংঘর্ষ এবং ১০ জন আহত হবার সংবাদ জানান দিচ্ছে বিএনপি’র দূর্গখ্যাত বরিশালে এখন আর বিএনপি’র পায়ে বল নেই। একই সাথে সংগঠন মজবুত না করে নেতাদের কোন্দল এমনকি মহানগর কিংবা জেলার কোথাও বিএনপি’র সুসংগঠিত হবার সুযোগ নেই। নেই পূর্নাঙ্গ কমিটি। ফলে ক্রমান্বয়ে অস্তিত্ব সংকটে পরেছে দলটি।
এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির পিছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী মজিবর রহমান সরোয়ারই বলে মত তাদের। দলের মধ্যে নতুন নেতৃত্বকে যে কোন উপায়ে ঘায়েল করা, দল গঠনে পেশী শক্তি ব্যবহার করা আর ক্ষমতায় থেকে চাঁদাবাজী, হত্যা, লুটপাটের যে অভিযোগ তার প্রভাবেই সরোয়ার নামটি উচ্চারিত হচ্ছে বিভিন্ন মূল্যায়নে। তাদের মতে বরিশালকে নিয়ন্ত্রন করতে এবং তাকে ডিঙ্গিয়ে যাবার মত কোন নেতাকে দমন করতে প্রধান প্রধান স্থানে বিশ্বস্ত এবং অনুসারীদের বাসিয়েছেন। উদাহরণ স্বরূপ উত্তর জেলা বিএনপি’র সভাপতি মেজবাহ্ উদ্দিন ফরহাদ এবং সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান। দক্ষিন জেলা বিএনপি এক নাটকীয় অভ্যূথানের মধ্যে দিয়ে দখলে নিয়েছেন। পূর্বে গোটা বরিশালে সরোয়ারের ইচ্ছামাফিক দল চালানোকে কেবলমাত্র যে দুজন প্রতিবাদ করতো তারা ছিলেন বর্তমান মেয়র আহসান হাবীব কামাল এবং বিলকিস আক্তার শিরিন।
কিন্তু ২০১৩ সালের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে পূঁজি করে একধরণের জিম্মি করে ফেলে কামালকে। মেয়র করতে শুধুমাত্র মাঠে নেমে কাজ করবে এই চুক্তিতে দক্ষিন জেলা বিএনপি’র সভাপতি পদ ছাড়ার অঙ্গিকার করায়। এমনকি শিরিনকেও পদচুত্য করার শর্ত থাকে। সে অনুসারে কামাল মেয়র হবার পর সভাপতি করা হয় এবায়দুল হক চাঁনকে এবং সাধারণ সম্পাদক করা হয় আবুল কালাম শাহীন। এর মধ্যে চাঁন সরোয়ারপন্থি না হলেও তাকে মুখ বন্ধ রাখতে সরোয়ার চাপ প্রয়োগ করে আসছে আর আবুল কালাম শাহীন প্রকাশ্যেই সরোয়ারের লোক। ফলে নেতা দমনে সর্বেসর্বাই সরোয়ার। সিনিয়র নেতারা জানিয়েছেন এমন বৈশিষ্ট্য অর্জন করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের আমল থেকে।
আব্দুর রহমান বিশ্বাস যখন রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন তখন বরিশাল-৫ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ছিল তার পুত্র এহতেশামুল হক নাসিম। তবে নাসিম বিশ্বাসের মৃত্যুর পরে বিএনপি’র হাল ধরার কেউ ছিলনা। তখন মজিবর রহমান সরোয়ারের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজী, হত্যা, লুন্ঠন সহ বেশ কিছু মামলা চলছিল। দলের প্রয়োজনে সে সমস্ত মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় রাষ্ট্রপদানের বিশেষ ক্ষমতা বলে খারিজ করে দেয়া হয়। ২০০১ এর নির্বাচনে মনোনয়ন প্রদান করা হয় সরোয়ারকে। বিপুল ভোটে এমপি নির্বাচিত হয় একই সাথে পার্লামেন্টে তাকে হুইপের দায়িত্ব দেয়া হয়। এর দু’বছর পর অর্থাৎ ২০০৩ সালের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। তবে একই দলের প্রার্থী হয়ে এবায়দুল হক চাঁন ও আহসান হাবীব কামাল প্রতিদ্বন্ধিতা করায় কেন্দ্রীয় বিএনপি থেকে বহিস্কার করা হয় চাঁন এবং কামালকে।
এতে করে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কর্তা বনে যান সরোয়ার। যার প্রেক্ষিতে আজ পর্যন্ত সরোয়ারের পরিপন্থি কোন কথা বলতে পারছেনা কেউ। যখন যা সিদ্ধান্ত প্রদান করেন তখন তা ‘আদর্শ পিতার’ নির্দেশের মত পালন করে আসছে তৃণমূল বিএনপি। অথচ সরোয়ারের বিরুদ্ধে রয়েছে রাজনৈতিক দূর্বৃত্তায়নের ব্যাপক অভিযোগ। চলছে চাঁদাবাজী, হত্যাসহ পুলিশ নির্যাতনের মামলা। এর মধ্যে আলোচিত রয়েছে হিসাব বহির্ভূত অর্থের হিসাব দুদকে প্রদান না করা। দুদকের তদন্ত সূত্র বলছে, মজিবর রহমান সরোয়ারের একমাত্র বৈধ ব্যবসা ঠিকাদারী। তবে ঠিকাদারীকে সামনে রেখে মেয়র ও সংসদ সদস্য থাকা কালে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।
দূর্ণীতি প্রতিরোধ টাক্সফোর্স বলছে, সরোয়ার ৬ কোটি ১৭ হাজার ৩০৩ টাকার হিসাব বহির্ভূত সম্পদের সন্ধান দেয়নি সরোয়ার। এছাড়া অনেক প্লট, ফ্লাট এবং একাউন্টের কথা উল্লেখই করেনি। তিনি গুলশান- ২ ও বনানীতে নিজের নামে দুটি ফ্লাট খরিদ করেছে। পাশাপাশি স্ত্রীর নামে গুলশানে একটি ফ্লাট কেনেন। এছাড়া ২০০৮ সালের ৮ জুন বরিশালের মেয়ে শামীমা আক্তার ছবির (সরোয়ারের বান্ধবী) জন্য নগদ ৯ লাখ ৫০ হাজার পরিশোধ করে লাল রংয়ের একটি ‘হোন্ডা’ প্রাইভেট কার কিনে দেয়। খোজ নিয়ে জানা যায়, ছবি বরিশালের মেয়ে হলেও বিখ্যাত খুনি এরশাদ শিকদারের স্ত্রী সানজিদা আক্তার শোভার বড় ভাইয়ের স্ত্রী ছিল শামীমা আক্তার ছবি। তবে সরোয়ারের সাথে সখ্যতার পর থেকে সেই স্বামী ত্যাগ করে ঢাকায় অবস্থান নেয়।
সরোয়ার ছবিকে ঢাকার বসুন্ধরায় একটি ফ্লাট কিনে দেন। যার মূল্য ১৯ লাখ ৪৯ হাজার ২শ টাকা ছিল। ছবির প্রতিবেশীরা জানায়, সরোয়ার ঢাকা এলে ছবির ফ্লাটেই রাত্রী যাপন করে। দুদকের তদন্তে এসব বেড়িয়ে এলে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। তবে দফায় দফায় মামলাটি উচ্চ আদালতে স্থগিত হচ্ছে। ওদিকে ট্যারা শাজাহান হত্যা মামলায় তিনি আসামী। নিহত ডাকাত শাজাহানের স্ত্রী অভিযোগ করে জানায়, শাজাহান সরোয়ারের লোক ছিল।
তবে তার কথা শেষাবধি না শোনায় পরিকল্পনা করে হত্যা করায়। এসব বিষয়ই পদ নিয়ে ঘোলাজল সৃষ্টি হওয়ার মধ্যে ঢাকায় পাঠিয়েছে বরিশাল বিএনপির একাংশ। যে কারনে সরোয়ার একা অনেক পদ আগলে রাখতে পারবেন কিনা তা নিয়ে যে রাজনীতি শুরু হয়েছে সহসাই শেষ হবার নয় বলে ধারনা রাজনীতি সচেতনদের। অর্থাৎ মজিবর রহমান সরোয়ারের পদ নিয়ে আবারও চাপা কোন্দল জন্ম হচ্ছে বরিশালে। যেখানে কেন্দ্রের নির্দেশনার বিষয়টি বার বার ঘুরে ফিরে সামনে আসছে।