স্কুলে ভর্তির জন্য চলছে বয়সের ঘষামাজা
নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশালঃঃ রাজধানীর কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। সচেতন অভিভাবকরাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন নতুন বছরে সন্তানদের ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য। এ ক্ষেত্রে বয়সের বার থাকায় অনেক অভিভাবক কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন।
তারা সন্তানের বয়স কমিয়ে বা বাড়িয়ে নতুন করে নিচ্ছেন জন্মনিবন্ধন সনদ। কেউবা স্কুলের ক্যাচমেন্ট এরিয়া সুবিধা নিতে কাক্সিক্ষত প্রতিষ্ঠানের আশপাশে বাসা ভাড়া নিচ্ছেন। স্কুলে ভর্তির নীতিমালায় বয়সের বার যুক্ত হওয়ার বিষয়টি অনেক শিক্ষার্থীর ভর্তিতে এ বছর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে
। কিন্তু এক বছর অপেক্ষা করতেও রাজি নন অভিভাবকরা। তারা সন্তানের বয়স কমিয়ে বা বাড়িয়ে নতুন করে জন্মনিবন্ধন সনদ নিতে দৌড়াচ্ছেন সিটি করপোরেশনে। যদিও এটি অনৈতিক। সুনির্দিষ্টভাবে কোনো শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার ভর্তি বাতিল হবে, বলছে শিক্ষা প্রশাসন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, একটি নির্দিষ্ট বয়সে শিশুদের স্কুলে পাঠানোর লক্ষ্য সামনে রেখে বয়সের বাধ্যবাধকতা যুক্ত হয়েছে ভর্তির শর্তাদিতে। একেবারে কোমলমতি শিশুদের স্কুলে ভর্তি করে পড়ালেখার নামে তাদের মানসিক-শারীরিক চাপ থেকে মুক্তি দিতেই এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
স্কুলে ভর্তি নীতিমালায় শিক্ষার্থীর বয়সের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে- জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুযায়ী প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীর বয়স ৬ বছরের ঊর্ধ্বে হতে হবে। সে হিসাবে দ্বিতীয় থেকে ৯ম শ্রেণির ভর্তির বয়স নির্ধারিত হবে। তবে ভর্তির বয়সের ঊর্ধ্বসীমা সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয় নির্ধারণ করবে। শিক্ষার্থীর বয়স নির্ধারণের জন্য ভর্তির আবেদন ফরমের সঙ্গে অনলাইনে জন্মনিবন্ধন সনদের সত্যায়িত কপি জমা দিতে হয়।
সিটি করপোরেশন কার্যালয়ে বছরের অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে অক্টোবর-নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে জন্মনিবন্ধন সনদের জন্য অনেক বেশি আবেদন জমা হয়। এবারও তেমনটিই দেখা যাচ্ছে। বাংলাবাজার, সূত্রাপুর, লক্ষ¥ীবাজার, রামপুরা, বেইলি রোডে বিভিন্ন কম্পিউটার-ফটোকপির দোকানে এখন ভিড় করছেন অভিভাবকরা; অনলাইনে জন্মনিবন্ধনের ফরম পূরণ করছেন।
রামপুরায় একটি কম্পিউটারের দোকানে রবিবার সকালে এক অভিভাবক জানান, তার মেয়েকে ভিকারুননিসায় ভর্তির জন্য আবেদন করবেন। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞপ্তি অনুাযায়ী তার মেয়ের বয়স মাত্র ১৫ দিন কম আছে, এ জন্য তিনি নতুন জন্মনিবন্ধন করার জন্য দোকানে এসেছেন। এটি কতটা যুক্তিসঙ্গত? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ১৫ দিন-এক মাস বয়স বাড়ানো-কমানোয় কোনো সমস্যা নেই। নয়তো আমার মেয়েকে আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক অভিভাবক জানান, আগে তার সন্তানের ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন সনদ নিয়েছিলেন, যা সংশোধনের সুযোগ নেই। তিনি তাই নাম সংশোধন করে ফের জন্মসনদ সংগ্রহ করেছেন স্থানীয় পৌরসভা কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে।
ভর্তিতে বয়সের বার রাখা প্রসঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এবং ভর্তি নীতিমালা অনুযায়ী বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে।
নীতিমালা অনুযায়ী বয়স প্রমাণের জন্য অনেক অভিভাবক জন্মনিবন্ধন পরিবর্তন করে ভর্তির সুযোগ নিচ্ছেন, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন- এটি অনৈতিক চর্চা। কোনো শিক্ষার্থীর একাধিক জন্মনিবন্ধন সনদ চিহ্নিত হলে তার ভর্তি বাতিল করা হবে।
মতিঝিল স্কুল অ্যান্ড কলেজের তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি ইচ্ছুক একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার ছেলে ৫ বছর বয়সে যদি প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণির সব পাঠ আয়ত্ত করে- এটি কী অন্যায়? আমি ছেলেকে পরের শ্রেণিতে ভর্তি করার চেষ্টা করব না? সব শিশুর জন্য কী একই নিয়ম প্রযোজ্য হওয়া উচিত? কোনো কোনো শিশু পাঁচ বছর, সাড়ে পাঁচ বছরে সাবলীল বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে দক্ষ হয়। আবার কোনো কোনো শিশু ছয় বছরেও তা পারে না।
যে শিশু পারে না, তার জন্য পৃথক পরিচর্যার ব্যবস্থা রাখা উচিত। যারা একটু চঞ্চল শিশু তাদের উপযোগী শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হোক, এটি আমাদের দাবি। তিনি বলেন, ভর্তির নীতিমালা অনুযায়ী বয়স প্রমাণের জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ দাখিলের শর্ত দেওয়া হয়েছে।
এখন অভিভাবকরা প্রয়োজনে বয়স বাড়িয়ে-কমিয়ে নতুন করে জন্মনিবন্ধন সনদ করে নেবে। এটা তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর ভর্তি রোধ করতে পারবে না। অর্থাৎ সহজ পথ যদি সরকার কঠিনভাবে তৈরি করে, মানুষও কঠিন পথ যেতে অসাধু উপায় খোঁজে।
এ প্রসঙ্গে মাউশির একজন কর্মকর্তা জানান, নিজের সন্তানের স্কুলে ভর্তির জন্য যেসব অভিভাবক এমন অনৈতিক কাজ করছেন, তার কাছে সন্তান কী শিখবে? একটি নির্দিষ্ট বয়সে শিশুদের স্কুলে পাঠানো উচিত। শিশুদের যত বেশি চাপমুক্ত রাখা যায়, ততই তাদের মেধা বিকাশ ঘটে।
এ জন্য একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর স্কুলে নেওয়ার বিষয়টি নির্ধারণ করা হয়েছে। একেবারে কোমলমতি শিশুদের স্কুলে ভর্তি করে পড়ালেখার নামে তাদের মানসিক-শারীরিক চাপ থেকে মুক্তি দিতেই এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
নতুন বছরে ভর্তি কার্যক্রম শুরু প্রসঙ্গে মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) প্রফেসর মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন বলেন, গত শিক্ষাবর্ষে সরকারি ও বেসরকারি (মহানগর ও জেলা পর্যায়) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে নবম শ্রেণিতে কেন্দ্রীয়ভাবে অনলাইনে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। এবারও সে পদ্ধতি হতে পারে। শিগগির মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এ সংক্রান্ত নীতিমালা করে প্রকাশ করবে।
ভর্তি নীতিমালায় কোনো পরিবর্তন না হলে, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে সারাদেশের সব সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে নবম শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী নির্বাচন প্রক্রিয়া নিষ্পন্ন করা ব্যতীত অন্য কোনো পরীক্ষা গ্রহণ করা যাবে না। সরকার নির্ধারিত আবেদন ফির বেশি গ্রহণ করা যাবে না।
ঢাকা মহানগর/জেলা/উপজেলা ভর্তি কমিটির উপস্থিতিতে লটারি প্রক্রিয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থী নির্বাচন করতে হবে। বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা সর্বশেষ নীতিমালায় গঠিত মহানগরী/জেলা/উপজেলা ভর্তি তদারকি ও পরিবীক্ষণ কমিটির উপস্থিতিতে লটারি প্রক্রিয়া অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থী নির্বাচন করতে হবে।
লটারি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে বিদ্যালয়ের ভর্তি পরিচালনা কমিটি, ঢাকা মহানগরীর ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, মহাপরিচালক মহোদয়ের প্রতিনিধি, অভিভাবক প্রতিনিধি, ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রতিনিধি ও শিক্ষক প্রতিনিধির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী নির্বাচন ও ভর্তি প্রক্রিয়া অবশ্যই আগামী ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে নিষ্পন্ন করতে হবে।
জাতীয় খবর