বরিশালবাসীর স্বপ্নের পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যানটি ওঠানো হয়েছে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। এর পরে পেরিয়ে গেছে তিন মাস। এই তিন মাসে আর কোনও স্প্যান ওঠেনি।
কিন্তু প্রথম স্প্যানটি ওঠানোর দিন (৩০ সেপ্টেম্বর শনিবার) সংশ্লিষ্টরা বলেছিলেন, এখন থেকে প্রতি মাসেই একটি করে স্প্যান ওঠানো সম্ভব হবে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সেই প্রত্যাশা অনুযায়ী পদ্মা সেতুর দ্বিতীয় স্প্যানটি এখনও ওঠানো সম্ভব হয়নি।
এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সেতুর কাজ তাহলে শেষ হবে কবে?
এমন বাস্তবতায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘কাজটি পুরোপুরি টেকনিক্যাল। তাই হয়তো তারিখ অনুযায়ী সব কিছু হয় না। এর অর্থ এই নয় যে, কাজটি এগুচ্ছে না। পদ্মা সেতুর কাজ পুরোদমে এগুচ্ছে। এ নিয়ে আশঙ্কার কিছু নেই। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই এ প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি।’
পদ্ম সেতুর কাজ চলছে জানিয়ে সেতুমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটি সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী নিজে সার্বক্ষণিক এ প্রকল্পের কাজের খবর রাখছেন। নির্দিষ্ট মেয়াদেই শেষ হবে এ প্রকল্পের কাজ।’
গত ৩০ সেপ্টেম্বর শনিবার পদ্মা সেতুতে প্রথম স্প্যান বসানোর পর সেতুর জাজিরা পয়েন্টে সেতুমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘এরপর থেকে হয়তো প্রতি মাসেই একটি করে স্প্যান ওঠানো সম্ভব হবে। কারণ এখন একটি পিলার উঠলেই একটি স্প্যান বসানো যাবে।’
প্রথম স্প্যান বসানোর পর সংশ্লিষ্টরা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, দ্বিতীয় স্প্যান উঠবে ডিসেম্বরে। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জাতীয় সংসদকেও এ তথ্য জানিয়ে বলেছিলেন, ‘দ্বিতীয় স্প্যান ওঠানোর পর থেকে হয়তো প্রতি সপ্তাহেই একটি করে স্প্যান তোলা সম্ভব হবে।’
অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর এই তিন মাসে পদ্মা সেতুতে কেন দ্বিতীয় স্প্যানটি ওঠানো সম্ভব হয়নি- এই বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রতিমাসে একটি করে স্প্যান ওঠানো হবে, এমন কোনও সিদ্ধান্ত ছিল না। কাজটি তো খুবই টেকনিক্যাল। সেটি বুঝতে হবে। এর বেশি আর কিছুই আমি বলতে পারবো না।’
রাজধানী ঢাকার অদূরে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে অবস্থিত পদ্মা সেতু প্রকল্প অফিসে যোগাযোগ করলে সেখানকার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের বলেছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন করতে কাজ করছেন সংশ্লিষ্টরা। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা কাজ করছেন দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী ও শ্রমিকরা। কাজ তদারকি করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। পদ্মার তলদেশে পানির স্রোত, মাটির অবস্থান ও মাওয়া পয়েন্টে নদীভাঙন পরিস্থিতি এ প্রকল্পের কাজকে অনেকটাই জটিল করেছে বলে জানিয়েছে সূত্র। এ বছরের অতিবৃষ্টি ও তীব্র স্রোত সেতুর কাজকে বাধাগ্রস্ত করেছে। বর্তমানে শুকনো মৌসুম।
এ মৌসুম চলবে মার্চ পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে মাঝ নদীতে অধিকাংশ পিলার বসানোর কাজ সম্পন্ন করতে চায় কর্তৃপক্ষ। একইসঙ্গে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া পয়েন্টে নদীশাসন শেষে পিলারের কাজগুলো সম্পন্ন করতেও আগ্রহী তারা। কারণ বর্ষা মৌসুমে এ এলাকার নদী ভাঙন প্রকট আকার ধারণ করে। তখন কাজ করা খুবই কঠিন।
সংশ্লিষ্টদের মতে, পিলারগুলো দাঁড়িয়ে গেলে এর ওপর স্প্যান বসানোর কাজটি আসলে সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ সব কারণেই গত তিন মাসে স্প্যান তোলার চেয়ে পিলারের কাজ করার দিকে বেশি মনোযোগী ছিল বলে জানা গেছে। তবে আশঙ্কা, সমালোচনা, বৈরি প্রকৃতি ও স্রোত সব কিছুকে পরাজিত করেই এগিয়ে চলেছে এ প্রকল্পের কাজ।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই আরও একটি অত্যাধুনিক হ্যামার প্রকল্প এলাকায় এসে পৌঁছেছে।
প্রথম স্প্যান বসানোর পর সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম তাদের নিজ নিজ প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘হয়তো এখন থেকে প্রতি মাসেই একটি করে স্প্যান ওঠানো সম্ভব হবে।’ কারণ ব্যাখ্যা করে তারা জানিয়েছিলেন, জাজিরা পয়েন্টে পিলারের কাজ শেষের দিকে। প্রতি মাসে একটি করে পিলার দাঁড়ালেই তার ওপর একটি স্প্যান বসানো সম্ভব।
সংশ্লিষ্টদের সেই প্রত্যাশার জের ধরে অনেকেই আশা করেছিলেন হয়তো অক্টোবরেই সেতুতে উঠবে দ্বিতীয় স্প্যান। কিন্তু তা হয়নি। কারিগরিসহ নানা কারণে সেতুর ৩৯ ও ৪০ নম্বর পিলার দু’টির কাজ স্প্যান ওঠানোর মতো করে পুরোপুরি উপযুক্ত করা যায়নি।
তবে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের যেকোনও দিন পদ্মা সেতুর দ্বিতীয় স্প্যানটি বসানো সম্ভব হবে বলে এর আগে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম। তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আমরা সে লক্ষ্যেই কাজ করছি। কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি।’
এদিকে, পদ্মা সেতুর অগ্রগতি সংক্রান্ত সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পদ্মা সেতুর মূল প্রকল্পে ৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। মূল সেতুর চুক্তিমূল্য ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। পুরো প্রকল্পে ব্যয় হবে প্রায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত মূল সেতুর কাজের বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৫১ শতাংশ। সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৪৭ শতাংশ।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়। সেতুতে থাকবে মোট ৪২টি পিলার। এর মধ্যে ৪০টি পিলার নির্মাণ করা হবে মুল নদীতে। বাকি দু’টি পিলার বসবে নদীর তীরে।
নদীতে নির্মাণ করা প্রতিটি পিলারে ছয়টি করে পাইলিং করা হয়েছে, যার দৈর্ঘ্য গড়ে প্রায় ১২৭ মিটার পর্যন্ত। একটি পিলার থেকে আরেকটি পিলারের দূরত্ব ১৫০ মিটার।
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুতে ৪২টি পিলারের ওপর বসবে ৪১টি স্প্যান। এছাড়া দু’পাড়ের সংযোগ সেতুসহ সেতুটি হবে ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ।’
শিরোনামজাতীয় খবর