বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ০৬:৪৯ পূর্বাহ্ণ, ১৫ মার্চ ২০১৬
তাকে বলা হয় স্বশিক্ষিত দার্শনিক। কারণ তার চিন্তা-ভাবনা ছিল দার্শনিকদের মতো। আবার তিনি মানবতাবাদী, চিন্তাবিদ লেখক এবং সত্যানুসন্ধানে ব্যপৃত ছিলেন আমৃত্যু। সত্যানুসন্ধান করতে গিয়েই তিনি মানবতাবাদী হয়েছেন, চিন্তাবিদ লেখক হয়েছেন। যা তাকে দার্শনিকে পরিনত করেছে। সত্যানুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি নাস্তিকতার দায়ও কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
দার্শনিক বিচারে আরজ আলী মাতুব্বর কতটা সফল হয়তোবা তা বিচার্য বিষয়। তবে মানবতাবাদী সত্যান্বেষী জ্ঞান পিপাসু একজন আরজ আলী মাতুব্বর যে তার জ্ঞান চর্চা, জ্ঞান বিতরণ ও কল্যাণকামী মানসিকতার উদাহরণ তৈরি করেছেন সেটা অবশ্যই শ্রদ্ধার দাবীদার। আরজ আলী মাতুব্বরের ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।
১৯৮৫ সালের ১৫ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি মরণোত্তর চক্ষুদান এবং মেডিকেলের ছাত্রদের শিক্ষার উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ-এর এনাটমি বিভাগে মরণোত্তর দেহদান করেন। এমন দানের ঘটনা একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব! এভাবে তার নানা কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে তিনি অনেক অসাধারণত্বর স্বাক্ষর রেখে গেছেন। আর এসব অর্জনের জন্য অত্যন্ত সাদামাটা জীবনের মানুষ হয়েও আরজ আলী মাতুব্বর আজো আলোচনায়।
আরজ আলী মাতুব্বরের জীবন যেমন ছিল সাদামাটা তেমনি লেখাও ছিল জৌলুসহীন। তাই আধুনিক পাঠক সমাজকে তাঁকে চিনে নিতে অনেক সময় নিতে হয়েছিল। তিনি ছিলেন মুক্তবুদ্ধির চর্চায় অগ্রসর এক অসাধারণ মানুষ। তিনি অত্যন্ত সরল ও সহজ ভাষায় প্রাণের আর্তিগুলোকে প্রকাশ করে গেছেন তার রচনাসম্ভারে।
আরজ আলী মাতুব্বরের জন্ম বরিশালের নিভৃত লামচরি গ্রামে ১৩০৭ বঙ্গাব্দের ৩ পৌষ। জন্মের চার বছরের মাথায় পিতা এন্তাজ আলী মাতুব্বর মারা যান। পাঁচ ভাইবোন নিয়ে আরজ আলীর মা লালমন্নেসা বিবি দিশেহারা হয়ে পড়লেন। মানুুষের বাড়ি কাজ করে কোনোমতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতে লাগলেন।
এই পরিস্থিতির মধ্যে সামান্য অক্ষরজ্ঞানকে সম্বল করেই লাইব্রেরির নিয়মিত পাঠক হয়ে গেলেন আরজ আলী। বরিশালের পাবলিক লাইব্রেরি, মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত বরিশাল শহরের অন্য একটি লাইব্রেরি এবং বরিশাল বিএম কলেজের লাইব্রেরি- এই সব লাইব্রেরি-ই হয়ে ওঠে আরজ আলী ঠিকানা। বিশেষ করে বিএম কলেজের সমৃদ্ধ লাইব্রেরি আরজ আলীকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করেছিল। এই লাইব্রেরিই আরজ আলীকে দিয়েছিল অপার জ্ঞানের সন্ধান। ছিয়াশি বছরের জীবনে জ্ঞান সাধনাতেই কাটিয়েছেন প্রায় সত্তর বছর।
কৈশোরের একটি ঘটনা তাকে সত্যসন্ধ করে তোলে। তার মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের ছবি তোলার দায়ে মৃতদেহ কেউ জানাজা পড়ে দাফন করতে রাজি হয়নি। শেষে বাড়ির কয়েকজন লোক মিলে তার মায়ের সৎকার করেন। আরজ আলী সামাজিক এই আঘাতের পর সত্য অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হন। ধর্মের নামে কুসংস্কার সত্য, না বিজ্ঞানলব্ধ জ্ঞান সত্য? এই জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতে গিয়ে আরজ আলী বিপুলভাবে ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। বাংলা ভাষায় লিখিত এবং প্রাপ্ত অধিকাংশ গ্রন্থাদি অধ্যয়ন তার জীবদ্দশায় প্রায় বাদ পড়েনি।
অভাবের সংসারে বেঁচে থাকার জন্য আরজ আলী এক সময় আমিনের কাজও (জমি জরিপকারী) করেন। লোকের জমি মেপে যে পয়সা পেতেন তা সংসারের খরচ মিটিয়ে বাকি টাকা দিয়ে নিয়মিত বই কিনতেন। এভাবেই তিল তিল করে বই কিনে ১৩৮৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন `আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরি`।
আরজ আলীর রচিত পান্ডুুলিপির সংখ্যা মোট ১৫টি। এর মধ্যে তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছিলো ৪টি। এই বইগুলো হলো- ‘সত্যের সন্ধান’, ‘অনুমান’, ‘সৃষ্টি রহস্য’ ও ‘স্মরণিকা’। আজীবন তিনি সত্যানুসন্ধানে ব্যপৃত থেকেছেন।
সার্টিফিকেট বর্জিত স্বশিক্ষিত এবং শুধুমাত্র সত্যানুসন্ধানে ব্রতী একজন লোক-দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর। সত্যানুসন্ধানে উনি কতটা সফল হয়েছেন, নাকি সত্যের পথে চলতে গিয়ে ভুল গাড়িতে চড়েছেন সেটা নিয়ে হয়তো বিতর্ক থাকতে পারে। তবে তিনি সত্যানুসন্ধানের আপোষহীন মনোভাব এবং নিরলস প্রচেষ্টার সন্মাননা উনি পেয়ে যাবেন যুগ যুগ ধরে।
স্বাধীন মত এবং চলমান লোকজ ধর্ম বিশ্বাসের বিরুদ্ধমত প্রকাশের কারণে নাস্তিক ও কম্যুনিস্ট আখ্যা দিয়ে ১৯৫১ সনে তার বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত হয়েছে। তবে শত প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে তিনি ছিলেন আপোষহীন ভাবে স্বাধীন মত প্রকাশের একজন সাহসী সৈনিক।