সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৫ লক্ষাধিক লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি
নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল:: ঢাকাসহ সারা দেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পাঁচ লক্ষাধিক লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি। এসব গাড়ি একদিকে যেমন দুর্ঘটনার আশঙ্কা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে, অন্যদিকে সড়কের সৌন্দর্য নষ্ট করছে।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জেল-জরিমানা করেও ফিটনেসবিহীন গাড়ির দাপট কমাতে পারেছ না নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি সড়কে লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি বাধাহীনভাবেই চলাচল করতে দেখা গেছে।
সামনে-পেছনের বডি ভাঙা, জানালার গ্লাস নেই, রংচটা ও জরাজীর্ণ বাস দিয়েই চলছে গুরুত্বপূর্ণ সড়কে যাত্রী পরিবহন। অনেক বাসের সিট কাভার ছিঁড়া, ভাঙা সিট ও অতিরিক্ত আসন দিয়ে যাত্রীদের ওঠা-নামার জায়গা সংকীর্ণ করে রাখা হয়েছে।
এমন পরিবহনের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থাও নির্দেশনা জারি করেছে। আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে এসব গাড়ির ত্রুটি না সারালে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জেল-জরিমানার সম্মুখীন করা হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরেটি (বিআরটিএ)। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে সংস্থাটি।
বিআরটিএর হিসাব মতে, সারা দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৪ লাখ ৬৬ হাজার ৯৫৪টি। এর মধ্যে বাসের সংখ্যা ৫১ হাজার ৩৯৫টি। মিনিবাস রয়েছে ২৭ হাজার ৮৩৮টি। ১৮ হাজার ৪৫২ বাস এবং ১০ হাজার ২৯১ মিনিবাসের ফিটনেস নেই।
অন্যান্য ছোট-বড় যানবাহন মিলিয়ে পাঁচ লাখ ১৮ হাজার ৪৩২টি যানবাহন ফিটনেস ছাড়াই চলাচল করছে। সোমবার রাজধানীর ফার্মগেট, মহাখালী, মগবাজার, কাকরাইল, পল্টন, মৎস্য ভবন, গুলিস্তান, টিকাটুলি, ফুলবাড়িয়া, শান্তিনগর, মতিঝিল এলাকা ঘুরে লক্কড়ঝক্কড় গাড়িতে যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে। তা ছাড়া সম্প্রতি মিরপুর, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, বিমানবন্দর, বাড্ডা, রামপুরা ও খিলগাঁও এলাকায়ও এমন চিত্র দেখা গেছে।
এসব এলাকা ঘুরে সময় পরিবহন, ভিক্টর, তুরাগ, অনাবিল, ছালছাবিল, বলাকা, আজমেরি, সেফটি, গাবতলী এক্সপ্রেস (৮ নম্বর), প্রজাপতি, শিকড় ও মিরপুর লিংক পরিবহনে বেশি লক্কড়ঝক্কড় বাস চলাচল করতে দেখা গেছে। এর মধ্যে সময় পরিবহন গুলিস্তান থেকে নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচল করে।
ভিক্টর, তুরাগ, অনাবিল, ছালছাবিল, বলাকা ও আজমেরি পরিবহন ঢাকা থেকে টঙ্গী ও গাজীপুর রুটে চলাচল করে। সেফটি ও মিরপুর লিংক নিউ মার্কেট-মিরপুর রুটে, ৮ নম্বর গাবতলী রুটে, প্রজাপতি বিমানবন্দর-মিরপুর রুটে এবং শিকড় পরিবহন যাত্রাবাড়ী-মিরপুর রুটে চলাচল করে।
সোমবার দুপুরে রাজধানীর টিকাটুলিতে সময় পরিবহনের বেশ কিছু ভাঙাচোরা গাড়িতে যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে। একটি বাসের সামনে-পিছনে দুই দিকেই ভাঙা, নেই জানালার কাচও।
ভাঙা গাড়িতে কীভাবে যাত্রী পরিবহন করছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে চালক শাহিন বলেন, ‘গাড়ি তো ঠিকই আছে। সামনে-পেছনে শুধু একটু ভাঙা। এগুলো কোনো সমস্যা না। জানালার কাচ লাগিয়ে নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
তা ছাড়া গুলিস্তানের সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের সামনে দেখা গেছে, অভিনন্দন, গ্লোরী, হিমালয় ও আনন্দসহ বেশিরভাগ গাড়িই লক্কড়ঝক্কড়। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী রুটে লোকাল যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে ফিটনেসবিহীন বাসে। পল্টন পুলিশ বক্সের সামনে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্য শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কত ভাঙাচোরা গাড়ি যে চোখের সামনে পড়ে তার তো কোনো হিসাব নেই।
পেছন দিয়ে সব খোলা এমন গাড়িও চলাচল করে। কিন্তু আমরা কিছু বলতে পারি না। আমাদের কাজ যাতে জ্যাম না লেগে যায়, তা দেখা। তাই বাড়তি কোনো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাই না।’ মিরপুর লিংক পরিবহনের যাত্রী শাকিলা আক্তার বলেন, ‘গাড়িগুলোর সিট এত চাপানো থাকে যে দুজন বসতে কষ্ট হয়। নোংরা সিট কাভার। গাড়ি ব্রেক করার সময় বা গর্তে পড়লে ভয়ানক শব্দ হয়, মনে হয় যেন গাড়ি ভেঙে যাচ্ছে।’
সময়মতো পর্যাপ্ত গণপরিবহন না পাওয়ায় নানা ধরনের ঝুঁকি নিয়েই এসব পরিবহনে চলাচল করছেন যাত্রীরা। কলাবাগান থেকে প্রতিদিন মতিঝিল অফিস করেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা কামাল পাশা। তিনি জানান, অফিস থেকে কোনো পরিবহনের ব্যবস্থা নেই।
যে টাকা বেতন পান তা দিয়ে কোনোরকম সংসার চলে। তাই অফিসে আসা-যাওয়ার জন্য প্রতিদিনই গণপরিবহন ব্যবহার করতে হয়। তিনি বলেন, ‘কোনো উপায় না পেয়ে, অনেকটা বাধ্য হয়ে এসব বাসে উঠি। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা থাকলে কোনো মানুষই এসব বাসে চড়বে না। ভাঙা সিটের কারণে বেশ কয়েকবার জামাও ছিঁড়েছে।’
এদিকে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮-এর ২৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী, ফিটনেসের অনুপযোগী, ঝুঁকিপূর্ণ বা ক্ষতিগ্রস্ত, রংচটা, কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া নির্ধারিত রং পরিবর্তন করে জরাজীর্ণ, বিবর্ণ বা পরিবেশ দূষণকারী কোনো মোটরযান চালানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই অপরাধে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডই হতে পারে।
তবে নিয়ম-নীতির কোনো তোয়াক্কা না করেই নিজেদের ইচ্ছামতো গাড়ি চালাচ্ছেন বাস মালিকরা। পুরানো বাসের পেছনে টাকা খরচ করতে চান না তারা।
বিআরটিএও তাদেরকে ধরতে পারছে না। কেননা আগে থেকে ঘোষণা দিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করায় ওই সময় লক্কড়ঝক্কড় বাসগুলো সড়কে নামানো হয় না। অভিযানের সময় শেষ হলে আবার সড়কে নামান ওইসব বাস।
বিআরটিএর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সবকিছু নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতাও নেই তাদের। একটি বাসের ফিটনেস সনদ দেওয়ার আগে ৬০টি উপাদান পরীক্ষা করতে হয়।
যার জন্য জনবল রয়েছে মাত্র ১২৫ জন। তাদের পক্ষে এত সংখ্যক যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা দুরূহ কাজ। এ প্রসঙ্গে বিআরটিএর রোড সেফটি উইংয়ের পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী সময়ের আলোকে জানান, ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে সারা বছরই অভিযান পরিচালনা করা হয়।
এরই মধ্যে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে গাড়ির ফিটনেস না ঠিক করলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, ‘কোনো গাড়ির ফিটনেস না থাকলে ওই গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা-জরিমানা করা ছাড়াও ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়।’
শিরোনামজাতীয় খবর