বরিশাল টাইমস রিপোর্ট
প্রকাশিত: ০৬:৪২ অপরাহ্ণ, ১০ নভেম্বর ২০১৬
ঝড়-ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ এক জনপদের নাম বাংলাদেশের উপকূল। যেখানকার মানুষ প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে। কৃষকের শ্রম-ঘামের বিনিময়ে কোন বছর মাঠে ভালো ফসল হলে প্রকিৃতর বৈরিতায় সে ফসল আর ঘরে তোলা সম্ভব হয় না। কষ্টের জমানো অর্থের সঙ্গে ঋণের টাকা যোগ করে নতুন ঘরখানা হয়তো এবছর মাথা তুলেছে, ঠিক পরের বছরই ঝড়ের ঝাপটায় মাটির সঙ্গে মিশে যায় সে ঘর। জলোচ্ছ্বাস, নদী-ভাঙণ, লবনাক্ততার প্রভাব প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে ফেরে মানুষগুলোকে। সে তো উপকূল! নোনাজলের ঝাপটায় ক্ষত-বিক্ষত হবে সে, এটাই স্বাভাবিক! তার জন্য আবার দিবস কেন! প্রতিদিনই তো তার এক একটি দিবস।
অবশ্যই প্রয়োজন আছে। উপকূলের জন্যও একটা দিবস প্রয়োজন আছে। উপকূলবাসীর দিকে বছরে অন্তত একটি দিনে বিশেষভাবে নজর ফেলার জন্য, উপকূলের সংকট-সম্ভাবনার কথা বছরে অন্তত একটিবার সবাই মিলে বলার জন্যে একটি বিশেষ দিন চাই। দুর্যোগ ধেয়ে এলেই গণমাধ্যম, উন্নয়নকর্মীসহ, সরকারি-বেসরকারি সকল স্তরের প্রতিনিধিগণ ছুটেন উপকূলে। দুর্যোগে সব লন্ডভন্ড হয়ে গেলে আরও বেশি মানুষ ছুটে যান সেখানে। এক পর্যায়ে আসে বৈদেশিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিগণ। বিশেষভাবে কেন্দ্রীয় গণমাধ্যমসমূহ তখনই উপকূলের কথা বেশি করে প্রচার করে। কিন্তু দুর্যোগকালীন সময়ের বাইরে স্বাভাবিক সময়েও উপকূলের মানুষের জীবন যে কতটা অস্বাভাবিক, সে খবর কে রাখে? সে কারণেই উপকূলের জন্য একটি দিবসের এই দাবি। যেদিন সবাই মিলে একযোগে উপকূলের কথা বলবে। উপকূলবাসীর জন্য সবচেয়ে শোকের দিন হিসাবে পরিচিত ১২ নভেম্বরই হতে পারে ‘উপকূল দিবস’। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, গোটা বিশে^র জন্যই এই দিনটি ‘ওয়ার্ল্ড কোষ্টাল ডে’ হওয়া উচিত।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর উপকূলবাসীর জন্য স্মরণীয় দিন। এদিন বাংলাদেশের উপকূলের উপর দিয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়। যার নাম ছিল ‘ভোলা সাইক্লোন’। এই ঘূর্ণিঝড় লন্ডভন্ড করে দেয় উপকূল। বহু মানুষ প্রাণ হারান। ঘরবাড়ি হারিয়ে পথে বসেন। এই ঘূর্ণিঝড় গোটা বিশ^কে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। উইকিপিডিয়ার সূত্র বলছে, এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড় সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্নিঝড়। সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসাবেও এটিকে আখ্যা দেয়া হয়েছে। এটির নাম ছিল এটি সিম্পসন স্কেলে ক্যাটাগরি ৩ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল। ওই ঘূর্ণিঝড়টি ৮ই নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট হয়। ক্রমশ শক্তিশালী হতে হতে এটি উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১১ নভেম্বর এটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ১৮৫ কিলোমিটারে পৌঁছায়। ওই রাতেই উপকূলে আঘাত হানে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপসমূহ প্লাবিত হয়। ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় পাঁচ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা ছিল ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলা। ওই সময়ে সেখানকার ১ লাখ ৬৭ হাজার মানুষের মধ্যে ৭৭ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। একটি এলাকার প্রায় ৪৬ শতাংশ প্রাণ হারানোর ঘটনা ছিল অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। ওই ঘূর্ণিঝড়ে তৎকালীন বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। দ্বীপচরসহ বহু এলাকার ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। উপকূল অঞ্চলের বহু এলাকা বিরাণ জনপদে পরিণত হয়।
’৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় প্রসঙ্গে প্রয়াত সাংবাদিক এম সানাউল্লাহ্ নূরী তাঁর নিবন্ধে লিখেছেন, ‘‘১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় হলো কার্তিক মাসের ২৮ তারিখে, অর্থাৎ বারোই নভেম্বর। আমি তখন দৈনিক বাংলার (সাবেক দৈনিক পাকিস্তান) সিনিয়র সহকারী সম্পাদক। সরেজমিনে গিয়ে আমরা চর বাদাম, চর সীতা এবং চর জব্বরে ধান ক্ষেতগুলোতে নাকে মুখে লোনা পানি লেপ্টানো হাজার হাজার লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখেছি। সাগরে ভাসতে দেখেছি অসংখ্য লাশ। রামগতি, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ভোলা এবং পটুয়াখালী পরিণত হয়েছিলো ধ্বংসস্তুপে। একটি গাছের ৩০ ফুট উঁচু মাথায় অসহায় দুর্গত কুকুরকে দেখেছি হাহাকার করতে। কোথাও পানি উঠেছে ৪০ ফুট ওপরে।’’
’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ডরপ’র প্রতিষ্ঠাতা ও গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার বিজয়ী এএইচএম নোমান। একটি নিবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘‘১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর উপকূলীয় এলাকায় ঘটেছে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছাস। সেই ভয়াল কালো রাতে উপকূলীয় হাতিয়া, রামগতি, চর আব্দুল্লাহ, সন্দ্বীপ, ঢালচর, চর জব্বার, তজুমুদ্দিন, চর কচ্ছপিয়া, চর পাতিলা, কুকরী কুমড়ী, মনপুরা, চরফ্যাশন, দৌলতখাঁন, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় জলোচ্ছাসে ভাসে। প্রকৃতির থাবায় একইসঙ্গে কোটি কোটি টাকার পশু, মৎস্য, ফসল, রাস্তা, কালভার্ট, বাড়িঘর, স্কুল, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সম্পদ ধবংস হয়ে যায়।’’
প্রলয়ংকরী ‘ভোলা সাইক্লোন’-এর আগে এবং পরেও উপকূলের উপর দিয়ে অনেকগুলো ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির বিচারে ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় সবচেয়ে ভয়ংকর বলে প্রমাণিত। স্বল্প পরিসরে হলেও এত বছর পরেও ওই দিবসটি পালিত হয়। দিনটিকে স্মরণ করে গণমাধ্যমসমূহ। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ’৭০-এর আগে ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে ‘বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন’-এ প্রায় ২ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছিল। এরমধ্যে এক লাখ লোকের মৃত্যু ঘটে দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে। ১৫৮২ সালে খ্রীষ্টাব্দে বাকেরগঞ্জ তথা বর্তমান বরিশাল অঞ্চলে আরেকটি ঘূর্ণিঝড়ের কথা জানা যায়। ওই ঘূর্ণিঝড়েও ২ লাখ লোক প্রাণ হারান। ১৯৭০-এর পরের ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড় ছিল ভয়াবহ। এতে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটে। এছাড়া ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডর, ২০০৮ সালের ৩ মে নার্গিস, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর নিলোফার, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানুসহ বেশকিছু ছোটবড় ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানে। তবে ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা অন্যকোন ঝড় অতিক্রম করতে পারেনি।
উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া অপেক্ষাকৃত বড় ঘূর্ণিঝড়গুলো এখনও স্মরণ করছে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। অন্যান্য বছরের মতো এবারও ১২ নভেম্বরের সেই ভয়াল দিনের কথা স্মরণ করে লেখা হবে প্রতিবেদন-প্রবন্ধ-নিবন্ধ। এই লেখাটাও সেই দিনকে স্মরণ করেই। কিন্তু এ লেখাটি ১২ নভেম্বরকে ‘উপকূল দিবস’ হিসেবে পালনের আহবান জানাচ্ছে। বাংলাদেশের উপকূল এত ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকার পরও ‘উপকূল দিবস’ হিসেবে কোন দিন নির্ধারণ হলো না। বিশেষ এই দিনে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের স্মরণে দোয়া-মোনাজাতও করা হয়। কিন্তু এইসব দুর্যোগে নিহত কিংবা নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের চোখের জল হয়তো কোনদিনই মুছবে না। স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে দু:সহ জীবন কাটাচ্ছে তারা। ‘উপকূল দিবস’ পালনের মধ্যদিয়ে ওইসব মানুষদের কান্না হয়তো থামানো যাবে না। তবে দুর্যোগ মোকাবেলায় মানুষকে অধিকতর সচেতন করে তোলা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের উপকূল নির্ধারণ করা হয়েছে তিনটি নির্দেশকের ভিত্তিতে। এগুলো হচ্ছে : ঘূর্ণিঝড়ের বাতাস, জোয়ার-ভাটার বিস্তৃতি ও লবনাক্ততার প্রভাব। ১৯টি জেলা উপকূলের আওতাভূক্ত। এরমধ্যে তিনটি জেলা অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ন। এগুলো হচ্ছে যশোর, নড়াইল ও গোপালগঞ্জ। বাকি ১৬ জেলাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন, পূর্ব-উপকূলের ৫ জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর; মধ্য-উপকূলের ৮ জেলা বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলা, ঝালকাঠি, বরিশাল, চাঁদপুর, শরীয়তপুর এবং পশ্চিম উপকূলের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা। প্রতিনিয়ত বহুমূখী প্রতিবন্ধকতার ভেতর দিয়ে এই এলাকার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। দুর্যোগে সব হারাচ্ছে; তারপরও আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। সংকট ও সমস্যা যেমন এই এলাকায় রয়েছে, তেমনি অবারিত সম্ভাবনাও রয়েছে গোটা উপকূল জুড়ে। জাতীয় অর্থনীতিতে উপকূল গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখছে। বিপুল সংখ্যক মৎস্যজীবী সমুদ্র-নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। আর তাদের আহরিত মাছ জাতীয় অর্থনীতির বিরাট অংশীদার। উপকূলের উন্নয়ন, সংকট সমাধান, সম্ভাবনা বিকাশ, পর্যটনের প্রসারসহ বিভিন্ন বিষয়ে সঠিক কর্মপরিকল্পনার লক্ষ্যে ২০০৫ সালে ‘উপকূল অঞ্চল নীতিমালা ২০১৫’ গৃহিত হয়। কিন্তু এই নীতির প্রতিফলন কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
এমন একটি দিনকে ‘উপকূল দিবস’ হিসাবে প্রস্তাব করা হচ্ছে, যে দিনটি উপকূলবাসীর জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন। ১২ নভেম্বর দিনটি যেন উপকূলের মানুষের প্রাণে গেঁথে আছে। এ দিনটি কখনোই ভুলতে পারে না। দিনটি এলেই সেই ভয়াল ছবি তাদের চোখের সামনে ভাসে। তাছাড়া অক্টোবর-নভেম্বরের এই মৌসুমটাতেই বাংলাদেশের উপকূলে আরও কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। এইসব বিবেচনায় ১২ নভেম্বরই হোক ‘উপকূল দিবস’। আর বাংলাদেশে এ দিবসটি পালন শুরু হলে গোটা বিশে^ই প্রথমবারের মত এ ধরণের একটি বিস হবে। কারণ বিশে^র কোথাও ‘কোস্টাল ডে’ পালিত হয়েছে বলে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়নি।
উপকূলের উন্নয়ন, সংকটের উত্তরণ, সম্ভাবনা বিকাশসহ উপকূলের অন্ধকারকে প্রকাশের আলোয় আনতে ‘উপকূল দিবস’ প্রবর্তন এখন সময়ের দাবি। দিবস পালনের ভেতর দিয়ে প্রতি বছর অন্তত একটি দিনে সবাই মিলে উপকূলের কথা বলা যাবে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে দিবস পালনের মধ্যদিয়ে উপকূলের ইস্যুসমূহ সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রভাব ফেলতে পারবে। বিশ^ব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের উপকূলের নতুন নতুন দুর্যোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তুলতেও একটি দিবসের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি।
দিবস তো কতই আছে! পাখি দিবস, পানি দিবস, শকুন দিবস, হাতি দিবস, শিক্ষা দিবস, স্বাস্থ্য দিবস, জনসংখ্যা দিবস, নারী দিবস, গ্রামীণ নারী দিবস, মানবাধিকার দিবস, ভালোবাসা দিবসসহ আরও কত দিবসের ভিড়ে আরেকটি দিবসের প্রস্তাব করছি শুধুমাত্র উপকূলের জন্যে। যে দিবস উপকূল সুরক্ষার কথা বলবে, উপকূলের সংকট-সম্ভাবনার কথা বলবে, উপকূলকে এগিয়ে নেওয়া কথা বলবে। যে দিবসে উপকূলবাসীর কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হবে। আর এভাবেই উপকূল এগিয়ে যাবে বিকাশের ধারায়।
লেখক : রফিকুল ইসলাম মন্টু, উপকূল-সাংবাদিক, বাংলাদেশ