মামলাটি বর্তমানে ঢাকার চার নম্বর অতিরিক্ত মহানগর জজ আদালতে বিচারধীন। আইনজীবীরা বলেছেন, অনেকটা স্থবির রয়েছে মামলার বিচারিক কার্যক্রম। সাক্ষীরা সাক্ষ্য না দেওয়ার কারণে মূলত এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মামলাটিতে বাদিসহ ১৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়া শেষ হলেও মামলার দুই তদন্ত কর্মকর্তাসহ ৪৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ এখনও হয়নি।
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর মো. আব্দুল্লাহ আবু বলেন, ‘মামলাটি এখনও পেন্ডিং রয়েছে। আদালতে সাক্ষী না আসায় মামলাটি নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা ও মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তিতে রাষ্ট্রপক্ষের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
মামলার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকার চার নম্বর অতিরিক্ত মহানগর জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর সাইফুল ইসলাম হেলাল বলেন, ‘২০০৭ সালের ১৯ মার্চ প্রথম এ মামলায় বাদীর আংশিক সাক্ষ্যগ্রহণ হয়। এরপর দীর্ঘদিন বাদীর পূর্ণাঙ্গ সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ৭ মে বাদীর অসমাপ্ত সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। মামলায় মোট ৫৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। বাকিদের সাক্ষ্য গ্রহণের সকল পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সাক্ষীদের হাজিরের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকল স্থানে ইতোমধ্যেই চিঠি দেওয়া হয়েছে। বার বার সমন পাঠানোর পরও গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী মামলার দুই তদন্তকারী কর্মকর্তা এখনও সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসেননি। এ মামলাটি ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা মামলা, হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলাসহ বেশকিছু আলোচিত মামলা রয়েছে এ আদালতে। কিন্তু গত তিন মাস ধরে এ অদালতে বিচারক নেই। এতে বিভিন্ন মামলার বিচারিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে।’
আসামিপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘এ মামলায় ডিফেন্স আইনজীবী হিসাবে হাজিরা দিয়ে যাচ্ছি। কোনো সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে না আসায় মামলার কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে। যদি রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারত, তাহলে মামলায় গতি আসত। গুরুত্বপূর্ণ এ মামলাটি অতি পুরাতন হওয়ায় যত দ্রুত সম্ভব এ মামলার বিচার কাজ শেষ হওয়া উচিত।’
এদিকে বার বার সমন পাঠানোর পরও আদালতে সাক্ষ্য দিতে হাজির না হওয়ায় ১০ সাক্ষীর বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এদের মধ্যে একজন সাক্ষীকে ঠিকানা অনুসারে পাওয়া যায়নি বলে পুলিশি প্রতিবেদন আদালতে এসেছে। বাকি ৯ জনের ক্ষেত্রে গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিল সংক্রান্ত প্রতিবেদন এখনও পর্যন্ত আদালতে দাখিল করেনি পুলিশ।
যেসব সাক্ষীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে তারা হলেন মামলার ১৪ নম্বর সাক্ষী মো. মজিবুর রহমান, ১৫ নম্বর সাক্ষী বিনু বিবি, ২৩ নম্বর সাক্ষী মাহতাব আলী খান, ২৫ নম্বর সাক্ষী মো. সামছুল হক, ৩০ নম্বর সাক্ষী আবুল কালাম, ৩৬ নম্বর সাক্ষী আব্দুর রব, ৩৭ নম্বর সাক্ষী আয়েশা খাতুন, ৩৮ নম্বর সাক্ষী আব্দুল মালেক, ৩৯ নম্বর সাক্ষী মনোয়ার বেগম ও ৪৯ নম্বর সাক্ষী মো. আজাদ রহমান। এদের মধ্যে মাহতাব আলী খান ঠিকানা অনুসারে নেই বলে জানিয়েছে পুলিশ। বাকিদের ক্ষেত্রে কোনো তথ্য আদালতে দেয়নি পুলিশ।
৪১ বছর আগের এ ঘটনায় মামলা হয় ১৯৯৬ সালে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বিপথগামী সেনা সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমণের সময় কামানের গোলা ছুড়লে তা গিয়ে মোহাম্মদপুরে শেরশাহ শূরি রোড ৮ ও ৯ এবং ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়ির (বস্তি) ওপর পড়ে। এতে নিহত হন নারী ও শিশুসহ ১৩ জন। নিহতরা হলেন রিজিয়া বেগম ও তার ছয় মাসের মেয়ে নাসিমা, কাশেদা বেগম, ছাবেরা বেগম, সাফিয়া খাতুন, আনোয়ার বেগম (প্রথম), ময়ফুল বিবি, আনোয়ার বেগম (দ্বিতীয়), হাবিবুর রহমান, আবদুল্লাহ, রফিজল, সাহাব উদ্দিন আহম্মেদ ও আমিন উদ্দিন আহম্মেদ।
ওই ঘটনায় ৮ নম্বর বাড়ির মালিক মোহাম্মদ আলী বাদি হয়ে ১৯৯৬ সালের ২৯ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ২০০১ সালের এপ্রিলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। এরপর ২০০৬ সালের ১ নভেম্বর এ মামলায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।
১৭ আসামির মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয় ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি। এরা হলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহিউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ। এ পাঁচজন ছাড়া এ মামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে (প্রয়াত) গ্রেফতার দেখানো হয়েছিল।
এ ছাড়া মামলার বাকি ১১ জন আসমি পলাতক রয়েছেন। এরা হলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) শরিফুল হক ডালিম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) এসএইচএমবি নূর চৌধুরী, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এএম রাশেদ চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) আহমদ শরিফুল হোসেন ওরফে শরিফুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) মো. কিসমত হাসেম, ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার, রিসালদার (অবসরপ্রাপ্ত) মোসলেম উদ্দিন ওরফে মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী ও এলভি মো. আলী হোসেন মৃধা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টার দিকে শেরশাহ শূরি রোডের টিনশেড বস্তিতে পরপর তিনটি কামানের গোলা এসে পড়ে। লে. কর্নেল (অব.) মুহিউদ্দিন আহমেদের (আর্টিলারি) ছোড়া কামানের গোলার বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। মুহূর্তে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় ওই বস্তি। কামানের গোলার আঘাতে ১৩ জন মারা যান। আহত প্রায় ৪০ জনের মধ্যে কয়েকজন পুরুষ পঙ্গু হয়ে যান সারা জীবনের জন্য।
এই মামলার বাদী মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘তখন আমার বয়স ছিল ২৪ বছর। শেরশাহ সূরি রোডে ৮ নম্বর বাড়িটি ছিল আমাদের। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট রাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার দিন সকাল সাড়ে ৫টায় আমাদের বাসার ওপর কামানের গোলা এসে পড়ে। সেখানে আমার গ্রামের লোকজন ও ভাড়াটিয়ারা ছিল। কামানের গোলায় আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয় রিজিয়া বেগমসহ ১৩ জন মারা যান এবং প্রায় ৪০ জন আহত হন।
ঘটনার পর মোহাম্মদপুর থানায় গেলে তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রব দেশের অস্থিতিশীল অবস্থার অজুহাতে আমার মামলা না নিয়ে লাশগুলো কবর দিতে বলেন। ফলে ওই সময় আর মামলা করা সম্ভব হয়নি।’
৭৫’এর ১৫ আগস্ট যে ঘটনা ঘটেছে সেই ব্যাপারে কোনো মামলা করা যাবে না মর্মে আইন পাস হয়। পরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় এলে ওই কালো আইন বাতিল হয়। এরপর ১৯৯৬ সালে স্বশরীরে মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে বাদী হয়ে মামলাটি করেন মোহাম্মদ আলী ।
এ মামলায় পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান মোহাম্মদ আলী। কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, ‘ঘটনার পর এতোগুলো বছর পার হয়ে গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর কোন খোঁজখবর কেউ নেয়নি। বঙ্গবন্ধু চলে গেছেন। একদিন তার কন্যাও (প্রধানমন্ত্রী) চলে যাবেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা ছাড়া আমাদের দেখার আর কেউ নেই। তিনি যেন ওই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন, এটাই আমাদের দাবি। তবে গর্বের বিষয় এই যে বঙ্গবন্ধুর জন্য এক ফোটা রক্ত সেদিন আমিও দিয়েছিলাম।’
টাইমস স্পেশাল, স্পটলাইট