২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার

অপ্রতিরোধ্য ধর্ষক, মাঠ পুলিশের ভুমিকা প্রশ্নবিদ্ধ!

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৯:৪৪ পূর্বাহ্ণ, ০৬ অক্টোবর ২০২০

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল:: সরকার কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও ধর্ষণ কিংবা নারীর প্রতি সহিংসতা দিনে দিনে আরও বেশি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। অনেক কারণই এজন্য দায়ী বলে মনে করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন সদস্যসহ সমাজকর্মীরা। তারা বলছেন, নৈতিক অবক্ষয় ও রাজনৈতিক কিংবা সামাজিকভাবে প্রভাবশালীদের পৃষ্ঠপোষকতা, বিচারহীনতা, রাষ্ট্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থাহীনতাই এর অন্যতম কারণ। বর্তমানে ধর্ষণসহ নারী নিগ্রহের যে ট্রেন্ড চলছে, তাতে কোনও অপশক্তির মদত থাকতে পারে বলেও মনে করেন কেউ কেউ। শুধু আইন প্রয়োগ করে নয়, ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার যে বীজ মানুষের মগজে ঢুকে আছে, সেটা আগে দূর করার ব্যবস্থা করতে হবে বলে মনে করেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের সংখ্যা এবং এর ভয়াবহতা অনেক বেড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ৯৭৫ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে একক ব্যক্তির মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৬২ জন। আর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০৮ জন নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৩ জনকে। লোকলজ্জা ও ক্ষোভে আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন নারী। এছাড়াও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৬১ নারী। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিন নারী ও ৯ জন পুরুষ নিহত হয়েছেন। পারিবারিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৩২ নারী। এরমধ্যে হত্যা করা হয়েছে ২৭৯ জনকে। পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন আরও ৭৪ জন নারী। নয় মাসে এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ২১ জন নারী। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৬৮ জন। এরমধ্যে হত্যা করা হয়েছে ৬৬ জনকে। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১৭ জন নারী। এ সময়ে ৬৪৭টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

কী কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণ বন্ধ হচ্ছে না জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে ধর্ষণ বন্ধ হচ্ছে না। নীতি-নৈতিকতা, মানবতা, বিবেক ও মনুষ্যত্ববোধ হারিয়ে মানুষ পশু হয়ে যায়। এই নৈতিকতার অবক্ষয় সবক্ষেত্রে হয়েছে। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে পরিবার, সমাজ ও সুশীল থেকে আরম্ভ করে সবার পক্ষ থেকে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা নিতে হবে।’

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল আবদুর রশিদ (অবসরপ্রাপ্ত) সাংবাদিকদের বলেন, ‘এবারের ধর্ষণের যে ট্রেন্ড—সেটা মনে হচ্ছে পরিকল্পিত। কোনও একটা অপশক্তির পরিকল্পনার অংশ মনে হচ্ছে। কারণ, ঘটনাগুলোর যে পরম্পরা বা ট্রেন্ড সেটা স্বাভাবিক ধর্ষণের যে অপরাধের ট্রেন্ড আছে, সেটা থেকে আলাদা। সেই আলাদা ট্রেন্ডের কারণেই মনে করছি যে এটা কোনও পরিকল্পনার অংশ হতে পারে। কোনও অপশক্তি এটাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারে। সে ব্যাপারে অনুসন্ধানের মাধ্যমে জানতে হবে কোনও অপশক্তি এর পেছনে কাজ করছে কিনা।’

মেজর জেনারেল আবদুর রশিদ (অবসরপ্রাপ্ত) বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি করার জন্য প্রায়ই ক্রিমিনাল গ্যাংদের পৃষ্ঠপোষকতা করে এগুলো করানো হয়। তাই এসব বিষয়েও অনুসন্ধান করে খবর নেওয়া উচিত। কারণ, আমরা দেখছি যারা এসব করছে, তাদের কিছুটা রাজনৈতিক চরিত্র আছে। তবে তারা বেশিরভাগই ক্রিমিনাল চরিত্রের। আর এই চরিত্রের লোকদের কেউ ইচ্ছা করলে কোনও একটি বিষয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করে সেদিকে ধাবিত করতে পারে।’

তিনি বলেন- ‘এখন ধর্ষণের ঘটনা পরিকল্পিত হোক আর নাই হোক, এতে সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন। এর প্রশমন করতে হলে যা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে, আইন তো আছে। এক্ষেত্রে সমাজ সচেতনতার প্রয়োজন আছে। বিভিন্ন এলাকায় আমরা দেখছি যে, সমাজপতিরা ক্রিমিনালদের সঙ্গে কিছুটা সমঝোতার চেষ্টা করে চলেন। এতে স্বভাবতই তারা উৎসাহিত হবে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমরা অনেক জায়গায় দেখেছি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্থানীয় সদস্যরা শক্তিশালীদের পক্ষে অবস্থান নেন। সেখানে যারা নিগৃহীত হন, তারা সাধারণত দুর্বল পক্ষের। সেক্ষেত্রে এই দুর্বল পক্ষকে বাঁচানো হচ্ছে রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাই আইনকে পাশে নিয়ে তাদের দুর্বলের পক্ষেই দাঁড়াতে হবে।’

জেনারেল আবদুর রশিদ (অবসরপ্রাপ্ত) সাংবাদিকদের বলেন, ‘নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের একলাসপুরে নারী নির্যাতনের ঘটনা ৩২ দিন আগের হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য হচ্ছে—তারা জানতো না। কিন্তু তাদের জানার যথেষ্ট উপায় আছে। এই ট্রেন্ডটা পরিবর্তন করতে হবে। বিচারের যে দীর্ঘসূত্রতা ও প্রলম্বিত বিচার, সেটাকেও সহজ করে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। যাতে সহজেই ধর্ষককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যায়। না হয় এর পুনরাবৃত্তি হবে।’

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন সাংবাদিকদের বলেন, ‘ধর্ষণ অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার কারণ হচ্ছে—দৃশ্যমান কোনও বার্তা সরকারের পক্ষ থেকে অপরাধীদের দিতে পারছে না। সিলেট ও আরও দুই-একটি ঘটনায় তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও সারা দেশে এ ধরনের অপরাধীরা যে অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে, বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি, তা এ ধরনের ঘটনাকে উৎসাহিত করছে। অপরাধীরা ভালো করে জানে, ক্ষমতার বলয়ের কাছাকাছি থাকলে বা ক্ষমতাসীন মানুষ হলে, এ ধরনের অপরাধ করে পার পাওয়া যায়।’ তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দল, যারা ক্ষমতায় থাকেন ও ক্ষমতায় যেতে চান, দুষ্কৃতকারীদের ওপর তাদের একধরনের নির্ভরশীলতা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। সরকারি দল হোক আর বিরোধী দল হোক, রাজনীতি তো দুর্বৃত্তদের দখলে। ফলে সমাজ থেকে সহজে এ ধরনের অপরাধ কমবে না।’

নূর খান লিটন সাংবাদিকদের বলেন, ‘নোয়াখালীর ঘটনা প্রমাণ করে সাধারণ মানুষ কোথাও যে আশ্রয় পাবে—এই আস্থা তারা হারিয়ে ফেলেছে। এই আস্থা না থাকার কারণে মানুষ নিজ উদ্যোগে পুলিশকেও জানাচ্ছে না। বিচারহীনতার কারণে রুখে দাঁড়াতেও ভয় পাচ্ছে। যেমন, আমি রুখে দাঁড়ালাম, পরবর্তীতে বিচার হলো না, তখন আমাকেই হেনস্তা হতে হলো। এটা এক মাস আগের ঘটনা। তখনই সবাই নড়েচড়ে বসেছে, যখন সোস্যাল মিডিয়ায় প্রচার হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এসব অপরাধ ও অপরাধীর বিরুদ্ধে যারা ভূমিকা রাখবে, তাদেরও এক ধরনের নৈতিক স্খলন ঘটেছে। দলদাসে রূপান্তরিত হয়েছে। তারা প্লট, পদক ও পদবিতে আটকে গেছে।’

ধর্ষণ প্রতিরোধে পুলিশের ভূমিকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের জনসংযোগ শাখার এআইজি মো. সোহেল রানা সাংবাদিকদের বলেন, ‘যেসব কারণ ও প্রভাবকের কারণে একজন মানুষ যখন ধর্ষক হয়ে ওঠে, সেই কারণগুলোকে কিল না করে, আপনি যতই আইন প্রয়োগ করেন না কেন, এ সমস্যার সহজে সমাধান হবে না। কারণ, আমাদের সমাজে নানা উপকরণ বিদ্যমান, যেগুলো আমাদের ধর্ষক হতে সহায়তা করছে। পুলিশ কোনও ক্ষেত্রেই কার্পণ্য করছে না। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা নিচ্ছে। হয়তো কোনও ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা থাকে। আর ধর্ষণের যে বীজ আমাদের মানসিকতায় রয়েছে, সেটা সামাজিকভাবে দূর করতে হবে।’

7 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন