১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

আজন্ম প্রতিবাদী ছিলেন সাংবাদিক মিন্টু বসু

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৯:০৮ অপরাহ্ণ, ০৩ অক্টোবর ২০২০

আহমেদ জালাল>> বরিশালের সাংস্কৃতিক জগতের মহীরূহ অন্যায়ের ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আজন্ম প্রতিবাদী,মুক্তিযোদ্ধা ও প্রগতিশীল মহলের অগ্রসৈনিক ছিলেন সাংবাদিক মিন্টু বসু। সমাজের নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে জীবনভর লড়াই করে গেছেন তিনি। নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা, সংগঠক, সাংবাদিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। সমাজের আলোকিত মানুষটি এই দিনে সকলকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান।

বরিশালে নানা কর্মসূচীতে শনিবার (০৩ অক্টোবর) সাংবাদিক মিন্টু বসুর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়েছে। বরিশালে সাংবাদিকদের উদ্যােগে শনিবার বেলা ১২টায় শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাবে মিন্টু বসু’র কর্মময় জীবন নিয়ে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় সকলের সিন্ধান্তনুযায়ী মিন্টু বসু স্মৃতি উদযাপন কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান দৈনিক বিপ্লবী বাংলাদেশ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল আলম ফরিদ। এছাড়া দিবসটি উপলক্ষে স্বজনদের সহযোগিতায় খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটার শনিবার  সকাল ১০টায় বরিশাল মহাশ্মশানে মিন্টু বসুর সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন। পরে খেয়ালী’র পক্ষ থেকে ভার্চুয়াল স্মরণসভার আয়োজন করা হয়।

সাংবাদিক মিন্টু বসু বরিশালের সকল সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। মিন্টু বসুর জন্ম ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার বৈচন্ডি গ্রামে ১৯৪৮ সালের ১২ মার্চ। পিতা নরেন্দ্রনাথ বসু ও মাতা শৈলবালা বসু। পিতা-মাতার ৬ সন্তানের মধ্যে তিনি চতুর্থ। ব্যক্তিগত জীবনে মিন্টু বসু এক কন্যা সন্তানের জনক। স্ত্রী কল্পনা বসু এবং কন্যা মুক্তি বসু চৌধুরী দুজনেরই ছিল সাংস্কৃতিক অঙ্গনে উজ্জ্বল পদচারণা। স্বাধীনতা পূর্বকালে মিন্টু বসু ছিলেন ‘বরিশাল যুবসংঘ’র নেতৃস্থানীয় কর্মী। যুবসংঘ ছিল একটি প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। এ সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণে তিনি’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিবাদী।
প্রতিতযশা সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত মিন্টু বসু। বিপ্লবী বাংলাদেশ ছিল রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধাদের মুখপত্র। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের কোলকাতায় অবস্থানকালে মিন্টু বসু জানতে পারেন ৯নং সেক্টরের মুখপত্র ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ পত্রিকায় প্রকাশ শুরু হয়েছে। এ খবর শুনে পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক নুরুল আলম ফরিদের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। বিপ্লবী বাংলাদেশের বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মিন্টু বসু। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সাপ্তাহিক থেকে দৈনিক হিসেবে প্রকাশিত বিপ্লবী বাংলাদেশে দীর্ঘদিন বার্তা সম্পাদক ছিলেন মিন্টু বসু। রণাঙ্গণ নিয়ে মিন্টু বসুর অনেক লেখাই ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও দলিল পত্র’ গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে।তিনি দৈনিক দক্ষিণাঞ্চল ও আজকের বার্তায় বার্তা সম্পাদক, দৈনিক গ্রাম সমাচার পত্রিকায় নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদ, দৈনিক দেশবাংলা এবং দৈনিক বাংলার বাণীতে বরিশাল প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। দীর্ঘদিন তিনি একুশে টেলিভিশনেরও বরিশাল প্রতিনিধি ছিলেন। বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ছাড়াও বরিশাল প্রেসক্লাবের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন মিন্টু বসু। লেখক হিসেবে নাটক, উপন্যাস, জীবনীগ্রন্থ ও মুক্তিযুদ্ধের উপর তার ৭৮টি বই প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রথম লেখা উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে। ৮০’র দশকে তিনি শিশু সংগঠন চাঁদের হাটের মাধ্যমে বরিশালে শিশু নাট্য আন্দোলন গড়ে তোলেন। চাঁদের হাটে তিনি দীর্ঘদিন সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। দেশের অন্যতম প্রাচীন গ্রুপ থিয়েটার খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটারের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘ ২০ বছর। তাঁর লেখা নাটকের সংখ্যা ৩৪। এর মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে ১৪টি। ১৯৯৪ সালে ইতালিতে তার লেখা নাটক ‘বিপ্লবের মৃত্যু নেই’ মঞ্চস্থ হয় এবং বিশেষ এ্যাওয়ার্ড লাভ করে। তাঁর একাধিক নাটক টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। ঢাকার নাট্য সংগঠন লোক নাট্যদল মিন্টু বসুকে ১৯৯৩ সালে দেশের শ্রেষ্ঠ নাট্যকর্মীর পদকে ভূষিত করে।
এছাড়া বরিশালের প্রজন্ম নাট্যকেন্দ্র তাকে বিপ্লবী দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ পদক প্রদান করেন। তিনি খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটার কর্তৃক এ্যাডভোকেট সৈয়দ গোলাম মাসউদ প্রবর্তিত আকবর হোসেন পদক,বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদ থেকে শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদক এবং মাইনুল হাসান স্মৃতি পদকে ভূষিত হন। বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থাও তাকে গুনীজন সন্মাননা প্রদান করেন। এ পর্যন্ত তিনি অর্ধশত নাটকে অভিনয় ও নির্দেশনা দিয়েছেন। তাঁর লেখা নাটক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, অপসংস্কৃতি এবং সামাজিক নীপিড়নের বিরুদ্ধে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছে। তাঁর রচিত ও নির্দেশিত স্বৈরাচার বিরোধী নাটক ‘ঢোল’ সমগ্র বাংলাদেশ ব্যাপী সাড়া জাগায়। সংগঠক হিসেবেও মিন্টু বসুর সুখ্যাতি রয়েছে। তিনি বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনে কেন্দ্রীয় পরিষদের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য, বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং একাধিকবার সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
মিন্টু বসু মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বরিশাল জেলা কমান্ডের সাবেক সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য, বরিশাল জেলা কমান্ডের সাবেক সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাংস্কৃতিক সম্পাদকসহ বহু প্রগতিশীল সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি সেক্টরস্ কমান্ডার ফোরাম বরিশাল মহানগর শাখার সভাপতি ছিলেন। প্রতিভাবান এই মানুষটি ২০১৭ সালের ০৩ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর আদর্শ চিরঞ্জীব। তিনি বেঁচে থাকবেন বরিশালের মানুষের ভালোবাসায়।
—————————–

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক ও বার্তা প্রধান, রণাঙ্গণের মুখপত্র ‘দৈনিক বিপ্লবী বাংলাদেশ’।

9 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন