২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার

আদালতে জমি দখলের মামলা, জানেন না বাদী!

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১১:২৮ অপরাহ্ণ, ৩১ অক্টোবর ২০২০

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল:: মাস দেড়েক আগে ৮০ বছর বয়সী নুরুল ইসলাম মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় বাড়ি করার জন্য একটি জমি কেনেন। গত ১৮ অক্টোবর ওই জমিতে কাজ করতে গেলে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি চক্র তাদের বাধা দেয় এবং জমি থেকে তাড়িয়ে দেয়। পরের দিন নিজের কেনা জমিতে অন্য একটি সাইনবোর্ড দেখতে পান নুরুল ইসলাম। ওই সাইনবোর্ডে জমির মালিক হিসেবে অন্য তিনজনের নাম লেখা।

পরে নুরুল ইসলাম জানতে পারেন, তার নামে জমি দখলের অভিযোগ এনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সাইনবোর্ডে মালিক হিসেবে উল্লেখ করা তিন ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, তারা এ সংক্রান্ত মামলাই দায়ের করেননি। এমনকি জমির ওপর টাঙানো সাইনবোর্ডের বিষয়েও তারা কিছু জানেন না।

১৪ অক্টোবর ঢাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের করা ওই মামলায় বাদী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে মো. মশিউর রহমান, তার মা শামীমা আক্তার এবং বোন আইরিন ইসলামের নাম।

আজ শনিবার আইরিন ইসলাম সাংবাদিকদের জানান , ‘নুরুল ইসলামের নামে যে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে, সে বিষয়ে আমি বা আমরা কিছুই জানি না। মামলায় বাদী হিসেবে আমার মা শামীমা, আমাকে এবং আমার ভাই মো. মশিউর রহমানের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ আমার মা বয়স্ক মানুষ এসবের কিছুই বোঝেন না।’

তিনি আরও বলেন, ‘মামলায় আরেক বাদী হিসেবে দেখানো আমার ভাই ২০১৮ সালের পর অস্ট্রেলিয়া থেকে একবারও দেশে আসেনি। তাহলে সে কিভাবে আদালতে গিয়ে বাদী হয়ে মামলা দায়ের করল? আর আমরা নুরুল ইসলামের জমিতেও কোনো সাইনবোর্ড লাগাইনি। কোনো একটি চক্র আমাদের নাম ব্যবহার করে এমন কাজ করেছে। সে কারণে গত ২৪ অক্টোবর মোহাম্মদপুর থানায় একটি জিডি করেছি আমি। একইসঙ্গে আমাদের নামে দেওয়া ওই ভুয়া সাইনবোর্ডটি অপসরণ করতে সংশ্লিষ্ট হাউজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালককের কাছেও একটি আবেদন করেছি।’

ভুক্তভোগী নুরুল ইসলামের অভিযোগ, স্থানীয় তাজুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি তার জমিটি দখল করতেই মিথ্যা মামলা এবং জমিতে অন্যের নামে সাইনবোর্ড টাঙিয়েছেন। এমনকি জমিটি ছেড়ে না দিলে তাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দিচ্ছেন। এই ঘটনার পর বৃদ্ধ নুরুল ইসলামও গত ১৮ অক্টোবর মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) দায়ের করেছেন।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নুরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘মোহাম্মদপুর থানার বেড়িবাঁধ সংলগ্ন নবীনগর হাউজিংয়ের ৬ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর প্লটটি আমরা আটজন মিলে কিনেছি। জমির মূল মালিক রবিউল ইসলামের কাছ থেকে মাস দেড়েক আগে আমরা জমিটি কেনার পর আমাদের সাইনবোর্ড ছিল সেখানে। কিন্তু গত ১৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় ওই জমিতে কাজ করতে গেলে তাজবীর হোসেন তাজুল, আব্দুল আউয়ালসহ পাঁচ-ছয়জন আমাদের কাজে বাধা দেয়। তারা আমার সাইনবোর্ডও ভেঙে ফেলে এবং আমাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘পরদিন আমি আমার জমিতে গিয়ে দেখি, নতুন একটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা এই জমির মালিক শামীমা আক্তার, আইরিন ইসলাম ও মো. মশিউর রহমান। কিন্তু সাইনবোর্ডে দেওয়া মোবাইল নম্বরগুলো একটিও তাদের নয়। এরপর ওই দিনই আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, সাইনবোর্ডে যাদের নাম লেখা তারা নাকি আমার বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলাও দায়ের করেছে।’

তিনি বলেন, ‘এরপর আমি থানায় গিয়ে বিষয়টি জানাই এবং সাইনবোর্ডে লেখা ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি। কিন্তু জানতে পারি তারা আমার নামে মামলা করেনি এবং ওই সাইনবোর্ডটিও তারা লাগায়নি। তখন আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারালাম স্থানীয় তাজুলসহ ওই প্রভাবশালীরাই এই কাজটি করেছে।’

৮০ বছর বয়সী নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি এর বিচার চাই। আমি একজন বয়স্ক মানুষ। তারা আমার জমি দখল করতে চাচ্ছে, আবার আমাকে মামলাতেও হয়রানি করছে।’

আরও মানুষের জমি দখল

শুধু নুরুল ইসলাম নয়, ওই চক্রটি এভাবে অনেকের জমি দখল করে আসছে বলে জানিয়েছে একাধিক ভুক্তভোগী। এমনকি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগও করেছেন অনেকে।

আরিফুর রহমান নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমি একজন খুবই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। সামান্য কিছু টাকায় জমিয়ে অনেক বছর আগে ওই হাউজিংয়ে একটা জমি কিনেছিলাম। এরপর সেখানে একটি টিনের ঘর নির্মাণ করে বসাবস করতাম। গত ৩০ জানুয়ারি ওই চক্রটি আমার বাড়িতে হামলা করে আমাদের ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে দেয়। হামলার সময় আমার ভাই দানু হাওলাদার, রনি হাওলাদার ও মিজান হাওলাদার এবং আমার ছেলে রাকিব হাওলাদার গুরুতর আহত হয়। পরে আমাদের হাসপাতালে নেওয়া হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘ওই ঘটনার পর আমি ৩১ জানুয়ারি থানায় একটি মামলা দায়ের করেছি। মামলার তিন নম্বর আসামি হচ্ছে তাজুল। মামলার পরও আমি আমার নিজের বাড়িতে নিরাপদে থাকতে পারছি না। আমার জমিও আমি বুঝে পাচ্ছি না।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার অপর এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘এই চক্রটি আমার জমিও দখল করেছে। এ ছাড়া নবীনগর হাউজিংয়ের অনেক মানুষের জমি তারা এভাবে দখল করেছে। অনেক মানুষকে জায়গা ছাড়া করেছে।’

হাউজিং কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

নুরুল ইসলামের অভিযোগ এবং মামলার ভুয়া বাদীর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মোহাম্মদীয়া হাউজিংয়ের নবীনগর প্রোজেক্ট ম্যানেজার মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা এটি সমাধানের চেষ্টা করছি। ভুয়া সাইনবোর্ড কে লাগিয়েছে, সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আলিম বলেন, ‘ভুয়া মামলার বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে কারও জমি কেউ দখল করবে-এর সুযোগ নেই। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে থাকলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

এ বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত তাজুল ইসলামের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা হলেও মুঠোফোনে তাকে পাওয়া যায়নি।

জমিতে টাঙানো সাইনবোর্ড ও বাদী হিসেবে উল্লেখ করা অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী মো. মশিউর রহমানের পাসপোর্ট

7 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন