১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

আলোচিত মামলার আসামি ৪ ডাক্তার দিব্যি ঘুরছে, বরিশাল পুলিশ বলছে পলাতক!

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৪:৪৮ অপরাহ্ণ, ০৭ আগস্ট ২০২০

শাকিব বিপ্লব ও হাসিবুল ইসলাম:: চিকিৎসাজনিত অবহেলায় বরিশাল রয়েল সিটি হাসপাতালে অকাতরে জীবন বিসর্জনকারী তরুণী সনিয়া আক্তারের পরিবারের দায়েরকৃত মামলার সাত আসামি প্রকাশ্যে ঘুরছে। তদুপরি পুলিশ তাদের ধরতে গড়িমসি করছে আর্থিক সুবিধা নেওয়ায়। এই হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটি ঘটনার সত্যতা প্রমাণসাপক্ষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে অবহিত করেছে। অভিযুক্তদের মধ্যকার ৪ জন চিকিৎসক। অন্যারা সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের বিভিন্ন পদে দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। এই আলোচিত মামলা গ্রহণে শুরু থেকেই থানা পুলিশ অনিহা প্রকাশ করে আসছিল। পরে তা এজাহার হিসেবে গ্রহণ করলে ডিবি পুলিশ তদন্তভার নিলে সেখানেও আসামি গ্রেপ্তারে নাটকীয়তার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।

একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, বরিশাল মিডিয়ার দুটি আঞ্চলিক পত্রিকা সম্পাদক এই বেসরকারি হাসপালের পক্ষ নিয়ে প্রশাসনকে প্রভাবিত করায় আসামি ধরার ক্ষেত্রে পুলিশের এ অনিহার কারণ। এই মিডিয়া মোড়লদের কারণেই সুদর্শনা তরুণীর মৃত্যু পর যাতে আইনি ঝুট-ঝামেলায় না জড়ায় সেজন্য কোতয়ালি পুলিশের সাথে সমঝোতায় যায়।

অপর একটি সূত্রের দাবি, কোতয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরুল ইসলামের সাথে ওই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধর ডা. রফিকুল বারীর স্ত্রীর কাজী আফরোজার সখ্যতা এবং পারিবারিক যোগাযোগ থাকায় নিহত পরিবার শত আকুতি জানালেও মামলাটি না নিয়ে ভিন্নখাতে প্রভাবিত করতে কালক্ষেপন শুরু করে। সেক্ষেত্রে থানার ওসির শর্ত ছিল মামলাটি হলেও অন্তত প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও তার স্ত্রীর নামটি যেন এজাহারে অন্তর্ভুক্ত না হয়। কিন্তু প্রগতিশীল ধারার মিডিয়াকর্মীরা চিকিৎসা অবহেলায় সনিয়ার মৃত্যু নিয়ে ব্যাপক লেখালেখি শুরু করলে পুলিশ চাপের মুখে পড়ে যায়। একপর্যায়ে পুলিশ কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গিয়ে ঘটনার সত্যতা খুঁজে পেলে মামলা গ্রহণে নির্দেশ দেন। এরপর ওসি অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওই প্রতিষ্ঠানের চার চিকিৎসকসহ অপর তিন কর্মকর্তাকে আসামি করে মামলা গ্রহণের বাধ্য হন। এতো নাটকীয়তার পরে মামলা নিলেও থানা পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তার এড়াতে কৌলশ এঁটে দেয়।

সূত্রমতে- এরপর কিছুদিন আসামিরা কর্মস্থলে আসা যাওয়া বন্ধ করে নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান নেন। তাদের ধারণা ছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনায় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট তাদের অনুকুলে আসার পরে মামলাটি থিতিয়ে পড়বে। কোতয়ালি পুলিশের পক্ষপাতমুলক ভুমিকায় আচ করতে পেরে মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বিষয়টি আরও গুরুত্বের সাথে দেখেন। এবং মামলাটি এক মাসের মাথায় অর্থাৎ জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে নগর গোয়েন্দা বিভাগকে দায়িত্ব দেন। পুলিশের এই নাটকীয়তার মধ্যে নিহত সনিয়া আক্তারের পরিবার তাদের অবস্থানে অনঢ় থেকে বিচার দাবি করে আসছিল।

উল্লেখ্য, সনিয়া আক্তার একজন প্রবাসীর স্ত্রী। তার স্বামী সাইফুর রহমান বেপারী মেহেন্দিগঞ্জের বাসিন্দা, কিন্তু থাকেন মধ্যপ্রাচ্যে। ফলে সনিয়া অক্তারের পিত্রালয় ঝালকাঠি সদর উপজেলার বিনয়কাঠী ইউনিয়নের বহরামপুর গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা পিতা মো. কালাম হাওলাদার এই ঘটনায় মামলা দায়েরে অগ্রণী ভুমিকা মাঠে নামেন। সনিয়া আক্তারের চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল মৃত্যু ঘটলেও এই ঘটনায় সূত্রপাত আরও পুর্ব থেকে।

তার পরিবার জানায়, সনিয়া আক্তার গর্ভবতী হলে বরিশাল শহরের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের গাইনী চিকিৎসক তানিয়া আফরোজের স্মরণাপণ্ন হন। এবং এই চিকিৎসকের তত্ত্বাবধায়নে শহরের ব্রাউন কম্পাউন্ট রোডের রয়েল সিটি হাসপাতালে পরবর্তীতে সনিয়া আক্তার একটি কণ্যা সন্তান প্রসব করেন। কিন্তু সার্জারীতে তার সন্তান ভুমিষ্ঠ হলেও চিকিৎসক ভুলবশত অথবা ব্যস্ততায় সনিয়ার আক্তারের পেটে গজ রেখে ত্রুটিপূর্ণ সেলাই দেন। জানা গেছে, ওই অপারেশন প্রাক্কালে তানিয়া আফরোজার স্বামী সার্জারী চিকিৎসক মনিরুল আহসান যৌথভাবে অংশ নেন।

ওই সূত্রটি আরও জানায়, কণ্যা সন্তান প্রসবের পর সনিয়া আক্তার পিতৃালয় ফিরে যাওয়ার এক মাসের মাথায় তার পেটে যন্ত্রণা অনুভব করেন। আবার ফিরে আসেন তানিয়া আফরোজের কাছে। তিনি পরামর্শ দেন মেডিকেলে নয়, সেই রয়েল সিটি হাসপাতালে আগে ভর্তি হও, পরে চিকিৎসা দেওয়া হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সনিয়া আক্তারকে স্বজনেরা ২৩ এপ্রিল হাসপাতালটিতে ভর্তি করেন।

একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এই ধরনের রোগীদের মেডিকেলে ভর্তির নিয়ম থাকলেও বাণিজ্যিক সুবিধা নিতে রয়েল হাসপাতালের সন্ধিচুক্তি থাকায় রোগীদের সেখানে পাঠানো হয়। আবার কখনও কখনও কোন অপারেশনের জন্য ওই হাসপাতালটি ব্যবহার করে। কিন্তু সেখানকার অপারেশন থিয়েটার যথার্থ অর্থাৎ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। জানা গেছে ডা. মনিরুল ইসলাম বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালের সার্জারী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তার স্ত্রী ডা. তানিয়া আফরোজ বরিশাল জেনারেল হাসপাতালের গাইনী বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন।

এদিকে ওইদিন সনিয়ার শারীরিক অবস্থা আরও গুরুতর হলে ডাক্তার মনিরুল ইসলাম ওই হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার সজিবকে সহযোগী হিসেবে সাথে নিয়ে গত ২৭ এপ্রিল পুনরায় অপারেশন করে পেট থেকে গজ অপসারণ করেন। কিন্তু রোগীর বেগতিক হলেও ডাক্তার তানিয়া আফরোজ সেখানে অনপুস্থিত থাকেন। ততক্ষণে রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

ওই হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, সকাল আটটায় অপারেশন শুরু হয় এবং শেষ হয় দুপুর ২টা নাগাদ। দীর্ঘ ৬ ঘণ্টার এই অপারেশনে রোগী সনিয়া আক্তারের মৃত্যু তরান্বিত হয়েছে অর্থাৎ দুই চিকিৎসকের সেবার অনুকুলের বাইরে চলে গেছে। এসময় রোগীর স্বজনদের বলা হয় সনিয়াকে দ্রুত শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে নিয়ে যেতে। শেবাচিমের চিকিৎসকেরা নিশ্চিত করে রোগী নিয়ে আসার আরও তিন ঘণ্টা পুর্বে তার মৃত্যু ঘটেছে। পরে ঘটনা ধামাচাপা দিতে রয়েলে সিটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায় এড়ানোর চেষ্টা শুরু করলে রোগীর স্বজনেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে কোতয়ালি মডেল থানার সেই ওসি পুলিশ পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেন।

খবর পেয়ে মিডিয়াকর্মীরা ঘটনাস্থলে গেলে রয়েল সিটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজেদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করে বিষয়টি ডাক্তার তানিয়া আফরোজ ও তার স্বামী ডাক্তার মনিরুল ইসলামের ওপর চাপিয়ে দেওয়াসহ রোগী বাঁচানো সম্ভব ছিল না বলে দাবি করে। এর আগে বিক্ষুব্ধ জনতার তোপের মুখে হাসপাতালের মালিক ডাক্তার রফিকুল বারীসহ অপারেশনে অংশ নেওয়া অপর দুই চিকিৎসক ঘটনাস্থল ত্যাগ করে আত্মরক্ষা করেন। জানা গেছে, সনিয়ার মৃত্যুর খবরে উত্তেজিত রোগীর স্বজনদের ওপর ওই হাসপাতালে প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ আরও দুই লাঠিয়ালের ভুমিকায় অবতীর্ণ হন।

অন্যদিকে কোতয়ালি মডেল থানার এসি রাসেল ও ওসি অপারেশন মোজাম্মেল হক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনী সহায়তার আশ্বাস দিয়ে সনিয়ার পিতা কালাম হাওলাদারকে থানায় নিয়ে যান।

সনিয়ার পারিবারিক সূত্র জানায়, ওই দিন মামলা নেওয়ার কথা থাকলেও থানার ওসি নুরুল ইসলামে সনিয়ার ময়নাতদন্তের অজুহাতে কালক্ষেপন করেন। এবং শেবাচি হাসপাতালের মর্গে গিয়ে সনিয়ার স্বজনদের রয়েল হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের সাথে আপসরফা নতুবা প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধর রফিকুল বারী ও তার স্ত্রী কাজী আফরোজের নাম বাদ দেওয়ার চাপ প্রয়োগ করেন। এর পরে নানান নাটকীয়তা শেষে তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল সাতজনকে আসামি করে চিকিৎসা অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যু অপরাধে একটি মামলা গ্রহণে পুলিশ বাধ্য হয়। সেক্ষত্রে পুলিশ কমিশনার শাহাবুদ্দিনের ইতিবাচক ভুমিকা থানা পুলিশ তাদের অবস্থানে টিকে থাকতে পারনেনি।

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, একদিকে রয়েল হাসপাতাল কর্ণধরের স্ত্রী কাজী আফরোজের সাথে ওসি নুরুল ইসলামের সখ্যতা অন্যদিকে কাজী আফরোজের পক্ষে পত্রিকা সম্পাদকদের মধ্যকার একজন যিনি কী না সর্বত্র মধ্যস্ততার ভুমিকা রেখে নিজেকে নেতা হিসেবে জাহির করেন তিনিই কী ভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়, সে পরিকল্পনার ছক আঁকে। যে কারণে আসামিরা মামলার শুরু থেকেই নিরাপদে রয়েছেন। এক মাসের মাথায় জুনের প্রথম সপ্তাহে মামালটি ডিবি পুলিশকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়ে স্থানান্তরিত করা হলেও সেখানে প্রভাব বিস্তার করা হয়। যে কারণে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (্এসআই) খাইরুল ইসলামও আসামিদের গ্রেপ্তারে অন্ধাকারে ঘুরপাক খাচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য হচ্ছে, আসামিরা সকলে পলাতক রয়েছেন। কিন্তু মুল আসামি চার চিকিৎসকসহ প্রতিষ্ঠান মালিকে প্রতিনিয়ত শহরে দিব্যি ঘুরছেন, দেখা যায়। এবং চেম্বারে রোগীও দেখছেন। বিশেষ করে মামলার এক নম্বর আসামি ডা. তানিয়া আফরোজ ও তার স্বামী মনিরুল ইসলাম বান্দরোডস্থ ইসলামীয়া হাসপাতালে শুক্রবার ব্যতিত সপ্তাহে ৬ দিন চেম্বারে অংশ নিচ্ছেন। রয়েল হাসপাতাল মালিক ডা. রফিকুল বারী ও তার স্ত্রী কাজী আফরোজাও তাদের প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত আসছেন, বসছেন। পাশাপাশি মামলার অপর আসামি রয়েল হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং কাজী আফরোজার বোন জামাতা মিলন প্রকাশ্যে ঘুরছেন এবং দম্ভো করে বলছেন মামলা থাকছে না।

এমন উদাহরণ তুলে ধরলে মামলা তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির এসআই সুর পাল্টে বলছেন, তিনি করোনা আক্রান্ত ছিলেন বিধায় অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার সম্ভবপর হয়নি। তবে আগামী ২/১ দিনের মধেই পদক্ষেপ নিচ্ছেন বলে আশ্বাস দিলেন।

সর্বশেষ প্রাপ্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে মিলনের দম্ভের সূতার মাথা কোথায় তার খোঁজ মিলছে। তা হচ্ছে, স্বাস্থ্য বিভাগের তদন্ত কমিটি ঘটনার সত্যতা উদঘাটন সাপক্ষে সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রতিবেদন পাঠিয়ে এই খবরে কাজী আফরোজা বিনয়কাঠী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলামের মাধ্যমে সনিয়ার পিতার সাথে সমঝোতার ক্ষেত্রফল তৈরি করার চেষ্টা করে চলছেন। সেক্ষেত্রে মামলা প্রত্যাহারের বিপরিতে ৫ লাখ টাকা অফার দেওয়া হয়েছে। অনুরুপ ঘটনার শুরুতে আইনী পদক্ষেপ না নিতে বরিশালের সদ্য প্রয়াত ডাক্তার ঝালকাঠির বাসিন্দা রাহাত আনোয়ার হাসপাতালের সত্ত্বাধিকারী ডাক্তার আনোয়ার হোসেনের মাধ্যমে সমঝোতার চেষ্টা চালালে মিডিয়াকর্মীরা সজাগ থাকায় ওই চিকিৎসক তার অবস্থান সরে যান।

একটি প্রাণবিয়োগের ঘটনার প্রেক্ষাপটে মামলা নিয়ে এত নাটকীয়তা এবং যেখানে ডিবি পুলিশের ওপর আস্থা রাখা হয়েছিল, তারা কেন স্বচ্ছ ভুমিকায় নেই এমন প্রশ্নে নগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি মঞ্জুর রহমান জানালেন, এই বিষয়ে তিনি গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন, সেখানে ছাড় দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’

12 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন