২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

আসমান ভাইঙা তাসের ঘর

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৮:৫০ অপরাহ্ণ, ১৫ মে ২০১৮

১.
এমন শীত শেষের একদিনে শ্যমলী আক্তার ঝর্ণা তার স্বামী রুস্তম আলীকে আর তার বাম পা’টা হারায় । কে জানত আসমান ভাইঙ্গা তাসের ঘরের মত দালান পড়বে তাদের উপর? হারানোর দিনে পঙ্গু হাসপাতালে হাজার হাজার লোক । শ্যামলীর ছোট ভাই নাদিম তার পাশে বসা । গতবার ক্লাস ফাইভে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ায় শ্যামলী ভাইকে ভালো স্কুলে পড়ানোর জন্য শহরে নিজের কাছে আনে । মনে আছে ঝাপসা আবছা, কতগুলা বিদেশি লোক পা হারানো লোক গুনে তাদেরকে স্ট্রেচার আর কৃত্রিম পা দেয় । সেই আলগা পাও পায়ে দিয়ে শ্যামলী আক্তার ঝর্ণা তার স্বামী রুস্তম আলীকে এক মাস সতের দিন ধ্বংশস্তুপের ধারে গিয়ে খোঁজে । নড়বড়ে ঢিলা এক কৃত্রিম বাম পা নিয়ে তারপর শ্যামলী ও তার ভাই নাদিম সুহৃদপুরে বাপের ক্ষুদ্র ভিটায় ফিরে আসে ।

২.
মাস তিনেকের মাথায় শ্যামলী আক্তারের কোল জুড়ে আসে পুত্র । রুস্তম আলী বলত- পোলা ওইলে নাম রাখুম সোহরাব আর মাইয়া ওইলে সুরবি । যেহেতু পুত্র আসে এ ধরায়, শ্যামলী আক্তার দ্বিতীয় চিন্তা না করে দ্বিধাহীন মনে নাম রেখে দেয় সোহরাব আলী । সোহরাব আলীর কপালে বড় করে নজর না লাগে কাজলের টিপ দিয়ে সকাল বেলা রোদে নিয়ে বসে আর গায়ে সরিষার তৈল মাখে । মা বলে- হাত-পাও টাইন্যা টুইন্যা দে, পোক্ত হইবো । শ্যামলীর মাথা ধরে না, ভাবে এইটুক বাচ্চার হাত-পা টানলে কি লাভ? তবু যেহেতু মা বলছে, নিশ্চয় কথা সত্য । যুগ খানেক আগে, পদ্মায় মাছ উঠাতে গিয়ে বাপজান তার ফেরে নাই । অভাবের সংসারে শাক-লতা-ভাতে যেন আর চলে না । তাই কিশোরী শ্যামলী অল্প বয়সে শহরে পাড়ি জমায় । কারখানায় কাজ নেয়ার বছর ঘুরতে পরিচয় হয় রুস্তম আলীর সাথে । তারপর কিসের থেকে কি রুস্তম একদিন কয়- আমারে লবি তর লগে, খোদার কসম আমি তরে চাই । তারপর হয়ে যায় কিসের ত্থেকে কি ভাবতে বসলে তার বুকে সুখের মত  ব্যাথা লাগে ।

৩.
যেইদিন পায়ের উপর পাহাড় ভেঙ্গে পড়ে, শ্যামলী আক্তারের বারবার মনে হচ্ছিল এখুনি বুঝি রুস্তম এসে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে । তারপর সময় যায়, রুস্তম আর আসে না । পায়ের রক্ত ক্ষরণে দুর্বল শ্যামলী আক্তার ভ্যাপসা গরম আর ধুলাবালির মধ্যেই দুইবার ঘুমিয়ে পড়েছিল । ঘুমিয়ে পড়েছিলো নাকি অজ্ঞান হয়েছিল এখন আর মনে পড়ে না । তারপর পা হারানোর যন্ত্রনা রুস্তম আলীকে হারানোর দুঃখ মনে করতে দেয়নি খুব বেশি । এখন আর পায়ে যন্ত্রনা নাই, এখন রস্তমের চেহারাটা বারবার মনের মধ্যে হাসে ।

৪.
সংসারের একবছরের মাথায় ভেবেছিলো তারা কলোনিতে একটা ঘর নেবে । নন্দাইলের অজপাড়া থেকে পায়ে হেঁটে ভোরে আটটার মধ্যে কারখানায় ঢুকতে তারা হাঁপিয়ে যেত । প্রথম প্রথম এক সেকশানে ছিল বলে বৌ-জামাই একসাথে দুপুরে এক টিফিনকারীতে খেত । তখন রুস্তম তার বৌকে দুই-এক লোকমা খাইয়েও দিতো । খেতে খেতে কখনো হাসিতে কখনো ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়লে, আশেপাশের মহিলা কর্মীরা বলত- রং দেখছ? খাওয়ার পর দুইজনে ওড়নায় হাত মুছে আবার ব্যস্ত হত । কোন কোন শুক্রবার পূরবী সিনেমায় তারা বই দেখত । ঢিশা ঢিশা বইগুলান শ্যামলীর খুব একটা ভালো লাগত না, ভালো লাগত প্রেম-ভালোবাসার বই । রুস্তম অবশ্য তার উল্টা । দিনগুলি যেন চোখের পলকে চলে গেছে । এখন দুঃখ আছে কি নাই সেটাই সে বুঝে না । মনে হয় মাথায় ভেতর ফকফকা ফাঁকা । মাঝে মাঝে একটা স্বপ্ন দেখে ধড়ফড় করে ঘুম ভাঙ্গে । দ্যাখে- চারদিক ধুলাবালি, ঘন অন্ধকার, নড়বার এক তিল জায়গা নাই । কখনো সোহরাব আলী রাত্রিকালীন কর্ম সেরে ক্রন্দন করে উঠলে শ্যামলী উঠে যন্ত্রের মত কাঁথা বদলায় । তখন সে আনমনে বলে উঠে- তর বাপ আছিল ভালা মানুষ, কেউ তার দ্বারে দুই টেহা পানা নাই । বলে শ্যামলী আক্তার ভাবে টাকা পাওনা না থাকলে কি ভালো মানুষ হয়? হয়তোবা হয় । তখন সংসারের দিনে তারা দুইজনে উপার্জন করত তাই খুব একটা অভাব বোধ করত না । বাজারে রুস্তম আলীর নামে কোন বাকির খাতা নাই । এলাকার লোক সবারই কমবেশি বাকি করা লাগে । অথবা রুস্তম কাউকে চালাকি করে কিছু বলত না বা ঠকাতো না বলে এলাকার লোকেরা বলত- সিধা লোক, ভালা মানুষ । টাকা দিয়ে কেন ভালো মানুষ যাচাই করা লাগবে সেটা শ্যামলী আক্তারের মাথায় ধরে না । মাথাটা ঝিম-ঝিম করে ওঠে । পুত্রের পাশে শুয়ে গুনগুন করে- আয় আয় চাঁদ মামা ।

৫.
রুস্তম আলীকে খোঁজার দিনে কত লোক কত তালিকায় তার নাম ঠিকানা লিখে নিয়ে যায় । বলে- সরকার টাকা দেবে । কিন্তু সে রুস্তম আলীকেও পায় না টাকাও না । নিজের পা হারানোর জন্য হাজার চল্লিশ টাকা দিয়ে সে এইখানে গ্রামে ভিটা ঘর মেরামত আর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র কেনে । একবার দুইটা লোক হাতে খাতা-কলম, তার আগের সংসারের ঘরে খুঁজতে আসে । শ্যামলী তখন প্রায় শয্যা ছেড়ে উঠতে পারে না । লোক দুইটা এসে তার ঘরে কি আছে, খাটের তলায়, সানসেটের উপর খুঁজে দ্যাখে আর শ্যামলীকে প্রশ্ন করে অনেক । খাতায় লিখে তারা চলে যায় । শ্যামলী তখন ভয় পায় । অবলার ঘরে কি আছে জেনে লোক দুইটা কি করবে । তারপর সন্ধ্যা বেলা তারা একটা সেলাই মেশিন আর বস্তা ভরা চাল-ডাল-নুন নিয়ে আসে । এটুকুই, এছাড়া খবর নিতে আর কেউ আসেনি । এখন সে চল্লিশ হাজারের বাকি কিছু টাকা হাতে আছে । সোহরাব আলী একটু বড় হইলে যখন বাহির থেকে দৌঁড় দিয়ে এসে বলবে- মা মা কুলফি খামু; তখন অল্প সল্প টাকা ছেলের হাতে না দিলে ছেলের মন বড় হবে কিভাবে । তাই কষ্ট করে কিছু টাকা সে জমিয়ে রাখে । এক পায়ে সেলাই মেশিন চালিয়ে সোহরাব আলীর জন্য ছোট ছোট জামা বানায় । গ্রামের দু’একজন তাদের ব্লাউজটা, ফাটা লুঙ্গিটা সেলাই করতে শ্যামলীর কাছে আসে । কেউ দশ কেউ বিশ-পঞ্চাশ টাকা দেয় । সে টাকা নিতে শ্যামলী আক্তারের লজ্জ্বা লাগে । কয়দিন আগেই না সে হাজার হিসেবে চাকরি করত । এখন বিশ-পঞ্চাশ টাকা তার কাছে ভাতের লঘু ফ্যানের মত লাগে । তবু সে টাকাটা নিয়ে কৌটায় রাখে । অথবা সোহরাব আলীর স্কুলের খাতা-পেন্সিলের একটা খরচ আছে ভেবে রাখে । দুধের শিশুর ভবিষ্যত যেন এক্ষুনি চোখের সামনে নাচতে থাকে বই দেখার মত ।

৬.
কদিন আগে ঢাকা থেকে একটা ফোন আসে । বলে যাদের ডিএনএ মিলছে তাদের জন্য বরাদ্দ আছে । ডিএনএ কি জিনিস শ্যামলী আক্তার জানে না । সুখী আপা বলছিল- ডিএনএ শইলের হগলতানে থাহে, কিছু যদি মিলে তাইলে খোঁজ মিলব । শুনে শ্যামলীর রাগ উঠে । কেন, রুস্তম আলী যে সেখানে কাজ করত, তারা কি জানে না? তাদের খাতায় লেখা নাই? কেন এখন ডিএনএ মেলার জন্য এত তোড়জোড়? একেকটা মানুষ বাতাসে মিলিয়ে গেছে, কোন হদিস নাই? কারো কিছু যায় আসে না, কেবল এই শ্যামলী আক্তার ঝর্ণার ছাড়া? থরথর করে নিঃসয়ায় শ্যামলী কাঁপতে থাকে । মনে হয়- মরণ তারেও কেন নিলো না ।
ভাবতে ভাবতে অথবা কি ভাবতে ভাবতে নাম মনে করতে পেরে সে শিশু পুত্রের পানে চায় । মনের মধ্যে একটা গুমোট হাওয়া লেগে থাকে । নবম শ্রেনী পর্যন্ত পড়া, কেবল নামটি সাক্ষর করা শ্যামলী আক্তার ঝর্ণার চারিদিকে অকুল পাথার ।

2 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন