২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

আসুন, সরকারের সমালোচনা করি!

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১২:১৭ অপরাহ্ণ, ১৮ মে ২০২০

আসুন, সরকারের সমালোচনা করি!

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে ছুটি ঘোষণা করলো সরকার। বলা হলো- যিনি যেখানে যে অবস্থায় আছেন তিনি সেখানেই যার যার বাড়িতে অবস্থান করবেন। সেটা বাস্তবায়নের জন্য বন্ধ করা হলো গণপরিবহন। কিন্তু ফলাফল কী হলো? আমরা একসঙ্গে ১০ দিনের ছুটি পেয়ে ঈদ উৎসবের মতো যে যার পন্থায় ছুটলাম গ্রামের বাড়িতে। গ্রামের বাড়িতে থাকা বাবা-মা, পরিবার-পরিজন আর আত্মীয়-স্বজনকে করোনা উপহার দিতে চলে আসলাম উৎসব করে। এখানেই শেষ নয়! নিজে ট্রাক, ভ্যান, রিকশা, অটোতে চড়ে আবার কিছু পথ হেঁটে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পার করে বাড়িতে এলাম সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে। গণপরিবহন বন্ধ থাকাতে বাড়ি আসার পথে সীমাহীন ভোগান্তি আর অর্থনাশের কারণে আবার সরকারকেই গালাগাল করলাম। সমালোচনায় তুলোধুনো করে সরকারের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করলাম।

সরকার বলেছিল কর্মক্ষেত্র এলাকাতে যার যার ঘরে অবস্থান করতে। ছুটিও দেয়া হয়েছিল সে কারণেই। কিন্তু আমরা কোটি জনতা পালিয়ে চলে এলাম গ্রামের বাড়িতে। নাড়ির টান বলে কথা! ঘটনা হয়তো এখানেই শেষ হতে পারতো কিন্তু তা হলো না। গ্রামের বাড়িতে এসে আমরা কী করলাম? উৎসব করে পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে হাটে-বাজারে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলাম। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিককে বাঁধা দেবার সাধ্য আছে কার? যে যার মতো ফ্রি স্টাইলে ঘুরতে লাগলাম সর্বত্র। অবস্থা বেগতিক দেখে আমাদের ভেড়ার পালের মতো তাড়িয়ে ঘরে ঢুকাতে পুলিশ-র‌্যাবের পাশাপাশি সেনাবাহিনী মাঠে নামালো সরকার। এতে শুরু হলো আরেক চোর-পুলিশ খেলা। তাড়িয়ে এক দরজা থেকে আমাদের ঘরে ঢুকিয়ে দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আর আরেক দরজা দিয়ে আমরা বেরিয়ে যাই তাদের তামাশা দেখার জন্য। ভারি এক তামাশা চললো বেশ কিছুদিন। সেই ছোটবেলার ছি-বুড়ি কিংবা গোল্লাছুট খেলার মতো মেতে উঠলাম দুর্বার আনন্দে। আমাদের এই মজার খেলার প্রতিপক্ষ ছিল সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সরকারি খেলোয়াড় আমাদের চেয়ে সংখ্যায় অনেক কম থাকায় সঙ্গত কারণেই হেরে গেলো তারা।

এরপরে সরকার বললো- একান্ত প্রয়োজনে বাইরে বের হতে হলে মানতে হবে সামাজিক দূরত্ব। কীসের দূরত্ব আর কীসের কী? মুখে কোনোমতে একটা মাস্ক লাগিয়েই নিজেকে সুপারম্যান ভাবতে শুরু করলাম আমরা। সেই মাস্কও অধিকাংশ সময় মুখের পরিবর্তে ঝুলতে থাকে গলায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখলে আবার সেটাকে টেনে মুখে তুলি আমরা। তারা চলে গেলে আবার নেমে যায় মাস্ক। অনেকে একটা মাস্কই প্রতিদিন ব্যবহার করছি। কেউ আবার একটা মাস্ক দিয়েই কাটিয়ে দিয়েছি পুরো করোনা সময়কাল। আমরা দলবেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছি খেয়ালখুশি মতোই। লোক সমাগম বন্ধ করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও শপিংমল, বিপণী বিতান, বিনোদন হল, পার্ক, ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করলো সরকার। সৌদি আরবের পবিত্র কাবা শরিফের মসজিদে যেখানে বিগত ১৪০০ বছরে কখনো এক ওয়াক্তের জন্যেও জামাতে নামাজ আদায় বন্ধ হয়নি সেখানেও জামাতে নামাজ পড়া বন্ধ করে দেয়া হলো। অথচ আমাদের দেশে মসজিদে জামাতে নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে আরোপিত সরকারি নিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠলাম আমরা।

কঠোর ভাষায় সরকারের সমালোচনায় মুখর হলাম। কারা বেশি সমালোচনা করলাম? যারা জীবনে কখনো মসজিদেই প্রবেশ করিনি। তারাই বেশি সরকারকে গালিগালাজ করলাম। মরে গেলেও জামাতে নামাজ আদায় বন্ধ না করার ঘোষণা দিয়ে অনেকেই মসজিদে গেলাম। ভালো কথা। এজন্য সরকার থেকে কি কোনো মসজিদে অভিযান চালিয়ে ইমাম-মুয়াজ্জিন অথবা জামাতে নামাজ পড়তে আসা কোনো মুসল্লীকে গ্রেফতার করেছিল? নিময় ভেঙে মসজিদে যাবার জন্য কারও বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল? করোনা ঝুঁকি নিয়ে সরকারি নিয়ম ভেঙে যারা মসজিদে গেলাম তারাও সরকারকে গালি দিলাম। আবার যারা জীবনে কোনোদিন মসজিদের দরজায় পা রাখেনি তারাও গালি দিলো। সরকার কি আসলে মসজিদে কখনো জামাত বন্ধ করেছিল? যারা মসজিদে যাবার লোক, তাদের অধিকাংশ মুসল্লী কিন্তু ঠিকই মসজিদে গিয়েই জামাত এবং তারাবির নামাজ পড়েছেন। কিন্তু যারা জীবনে কখনো মসজিদমুখী হননি তারাই ধর্মীয় উগ্রবাদী বিষবাষ্প ছড়িয়ে এই সিদ্ধান্তের জন্য সরকারকে গালি এবং সমালোচনায় তুলোধুনো করেছেন।

জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) যখন গবেষণা করে বললো যে, করোনাভাইরাসের মহামারী ২০২৪ সাল পর্যন্ত টানা চলতে পারে এবং এই ভাইরাসকে কখনোই পুরোপুরি নির্মূল হবে না। ভয়াবহ এই তথ্য জানার পরে নিজেদের অর্থনীতি বাঁচাতে বিশ্বের অনেক উন্নত ও সমৃদ্ধশালী দেশ তাদের লকডাউন শিথিল করে দিয়েছে। সেখানে আমাদের মতো একটি মধ্যম আয়ের গরীব দেশ যখন লকডাউন শিথিলের ঘোষণা দিলো তখন আমার আবার সরকারের সমালোচনায় মুখরিত হলাম। কিছু নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে যখন গার্মেন্টস, শপিংমল, বিপণী বিতান খোলার সিদ্ধান্ত দিলো সরকার তখন আরেক দফায় সরকারের নিন্দা জানাতে মুখর হলাম আমরা। সৌদি আরব কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মতো আমাদের তেল কিংবা খনিজসম্পদের ভান্ডার নেই। কৃষি নির্ভর অর্থনীতি আমাদের। গার্মেন্টস শিল্প এবং রেমিট্যান্স আমাদের জাতীয় আয়ের প্রধান উৎস। এরপরে আয়তন ও সম্পদের তুলনায় অতিরিক্ত জনসংখ্যা আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে এদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই এখন কয়েক কোটি। সেখানে সবকিছু বন্ধ করে লকডাউন হয়ে বসে থাকলে দেশে অচিরেই দুর্ভিক্ষ নেমে আসবে। সেই দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করার ক্ষমতা কি আমাদের আছে?

যেখানে বিশ্বের সম্পদশালী উন্নত দেশগুলোই পারছে না তাদের জনগণকে ঘরে বসে বসে খাওয়াতে সেখানে আমাদের মতো অতিরিক্ত জনসংখ্যা বোঝাই একটি গরীব দেশে এই আশা করাটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ৫ জনের একটি মধ্যবিত্ত ছোট্ট সংসার চালাতেই যেখানে বাড়ির কর্তাকে হিমসিম খেতে হচ্ছে সেখানে ১৮ কোটি মানুষের একটি বিশাল রাষ্ট্র চালাতে সরকারপ্রধানকে যে কতকিছু চিন্তা করে প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে সেটা একমাত্র তিনিই ভালো জানেন। ১৮ কোটি মানুষের মুখে অন্ন জোগাতে সরকারকে অনেককিছু ভাবতে হয়, অনেককিছুই করতে হয়। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো এদেশেও ঈদকে সামনে রেখে সীমিত আকারে বাজার, শপিংমল, বিপণী বিতান ইত্যাদি খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। অথচ আমরা কিছু না বুঝেই আবার সেটা নিয়ে সরকারের কঠোর সমালোচনায় লিপ্ত হলাম। দোকান বন্ধ করার সময় যেমন আমরা একদল জনতা সরকারকে গালি দিলাম, এখন দোকান খুলে দেবার পরে আবার আরেকদল মানুষ গালি দেয়া শুরু করলাম।

সকল ব্যর্থতার দায়ভার আমরা সরকারের কাঁধে চাপিয়ে নিজেরা ফেরেশতা সেজে বসে আছি। অথচ আমরা ভাবছি না নিজেরা কী করছি! কখন কয়টা সরকারি নির্দেশনা মেনে চলেছি? কয়টা নিয়ম পালন করেছি আমি নিজে? সেটা কি কখনো ভেবে দেখেছি একবারও? শুধু সরকারের দোষ খুঁজেছি। যত দোষ ওই নন্দ ঘোষ সরকারের! আমরা নিজেরা সচেতন না হলে, নিজেদের ভালোমন্দ নিজেরা না বুঝলে সরকার কী করবে? করোনায় করণীয় শেখাতে এবং আমাদের ঘরে রাখতে গিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ২ হাজারের বেশি পুলিশ সদস্য, শতাধিক সাংবাদিক ও ডাক্তার-নার্সসহ ৫ সহস্রাধিক করোনাযোদ্ধা আজ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। অথচ আমাদের তাতে বিন্দুমাত্র বোধোদয় হয়নি। প্রতিদিন পাল্লা দিয়ে বাড়াছে করোনায় আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা। অথচ আমরা তা অগ্রাহ্য করে বরং এখন আগের চেয়ে আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। হাটে-বাজারে-মার্কেটে নির্ভয়ে কেনাকাটা করছি। ঈদ মার্কেটে এখন ক্রেতা সমাগমের দৃশ্য দেখলে মনে হবে এদেশে করোনাভাইরাসের কোনো অস্তিত্ব নেই!

প্রথম দিকে অনেকের মুখে বা গলায় মাস্ক ঝুলতে দেখা গেলেও এখন সেটাও দেখা যাচ্ছে না। মাস্ক অথবা নূন্যতম কোনো প্রতিরোধব্যবস্থা ছাড়াই আমরা অনেকে সুপারম্যান সেজে হাটে-বাজারে এবং মার্কেটে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সরকার দেশের অর্থনীতি বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে লকডাউন শিথিল করেছে। হাট-বাজার, দোকান-পাট, শপিংমল, বিপণী বিতান খুলে দিয়েছে। কিন্তু আমি কেন ঝুঁকি নিয়ে সেখানে যাচ্ছি? আমি না গিয়ে ঘরে নিরাপদে থাকলেই তো পারতাম। সেটা না করে নিজে বাইরে যাচ্ছি আবার নিজেই সরকারের এই সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করছি। সরকারের মন্দকাজের সমালোচনা করবো ভালো কথা, কিন্তু সরকারের ভালোকাজের কয়দিন প্রশংসা করেছি আমরা? প্রতিটি রাষ্ট্রে তাদের নাগরিকদের নিয়েই সরকার পরিচালিত হয়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাজে নাগরিকরা সহায়তা করে। কিন্তু আমরা কী করি? বিভিন্ন ইস্যুতে নগ্নভাবে সরকারের সমালোচনা করার আগে আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি আমি নিজে কতখানি সুনাগরিক হতে পেরেছি? নিজে কতটুকু নাগরিক দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি? আমরা জাস্টিন ট্রুডোর মতো প্রধানমন্ত্রী চাই কিন্তু নিজে সেদেশের নাগরিকের মতো সুনাগরিক হতে চাই না। নিজে ভালো চিন্তা, ভালো কাজ করতে না পারলে কোনো সরকারই আমাদের ভালো রাখতে পারবে না। আওয়ামী লীগ কী আর বিএনপি কী, স্বয়ং জ্বিন-পরী এসে দেশ চালালেও আমাদের ঠিক করতে পারবে না যদি আমরা নিজেরা ঠিক না হই। নিজেরা সচেতন না হলে কেউ আমাদের মঙ্গল করতে পারবে না, এটাই বাস্তবতা।

ব্যক্তিস্বার্থ এখন আমাদের কাছে এতটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে যে আজ দেশের স্বার্থের দিকে তাকানোর সামান্যতম ফুরসত নেই আমাদের। যে যেভাবে পারছি দেশ ও দশের সম্পদ লুটে নিচ্ছি। লুটে লুটে সম্পদের পাহাড় গড়ছি। শুধু নিজে সবকিছু আত্মসাৎ করতে পারলেই যেন শান্তি! নিজে খেতে পারলেই যেন নিশ্চিন্ত! নিজে ভোগদখল করতে পারলেই যেন সকল স্বস্তি! অথচ একবারও ভাবি না, শুধু নিজে ভালো থাকার নাম জীবন নয়। একা নিজে ভালো থাকা আদৌও সম্ভব নয়। চারপাশের মানুষকে ভালো রাখার নামই ভালো থাকা। তাই শুধু তর্কের খাতিরে তর্ক নয়, কারণে-অকারণে শুধু সরকারের সমালোচনা নয়, আসুন সবাই মিলে নিজেরা একটু সুনাগরিক হওয়ার চেষ্টা করি। নিজে সৎ হই এবং দায়িত্বশীল আচরণ করি। মানুষ হিসেবে আমরা প্রত্যেকে মানবিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসি। তবেই প্রিয় বাংলাদেশ একদিন সত্যিকারের সোনার বাংলায় রূপান্তর হবে। #

আরিফ আহমেদ মুন্না
মানবতাবাদী লেখক, কবি সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বাবুগঞ্জ, বরিশাল, ১৮ মে, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ।

7 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন