২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

আহমেদ মুন্না’র কলামঃ এ কোন অশনিসংকেত?

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:১৩ পূর্বাহ্ণ, ২৩ জুলাই ২০১৯

আহমেদ মুন্না’র কলামঃ এ কোন অশনিসংকেত?

গত ক’দিন থেকে চারপাশে যা দেখছি তাতে কলম ধরার ইচ্ছেটা উবে গেছে! অনুভূতিগুলো কেমন যেন ভোঁতা হয়ে গেছে! লিখতে মন চাইলেও কিছু লিখতে পারছি না! অনেকগুলো দৃশ্য আমাকে কাঁদিয়েছে! অনেকগুলো প্রশ্ন আমাকে ভাবিয়েছে! কোথায় আছি আমরা? আমরা কি এমন একটা দেশ চেয়েছিলাম? এমন একটা দেশের জন্যই কি আমার পূর্বপুরুষরা জীবনের মায়া তুচ্ছ করে সেদিন যুদ্ধ করেছিল?

স্বাধীন এদেশে আজ খুনিরাও স্বাধীন! এদেশে এখন কাউকে হত্যা করতে কোনো অস্ত্রের দরকার হয় না! একটুখানি উস্কানি দেওয়াই যথেষ্ট। আবেগে ভাসা এবং গুজবে নাচা আমজনতাকে একটুখানি উস্কে দিতে পারলেই হলো! তারপরে যা করার তারা নিজ দায়িত্বে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে করবে! চোখের নিমিষেই একজন নিরপরাধ মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করবে! কোনো ধরনের বাছবিচার ছাড়াই শুধু একটু উস্কানিতে একজন মানুষকে ধরে প্রকাশ্য রাস্তায় সাপের মতো পিটিয়ে হত্যা করতে এতটুকুও দ্বিধা করবে না!

রাজধানীর বাড্ডা এলাকার রেনু বেগমের ৪ বছরের মেয়েটির কান্না আমাকে কাঁদিয়েছে। মেয়েটি এখনো জানে তার মা তার জন্য নতুন ড্রেস আনতে গেছে। মা আসছে না দেখে মাঝেমধ্যেই ডুকরে কেঁদে উঠছে। কিন্তু তুবা নামের হতভাগ্য মেয়েটা এখনো জানে না তার মমতাময়ী মা আর কোনোদিনও তার জন্য নতুন জামা নিয়ে ফিরে আসবে না! মেয়েটি জানে না, হুজুগে নাচা একদল উশৃংখল মূর্খ মানুষরূপী অমানুষ তার মাকে বিনাঅপরাধে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে!

তুবাকে স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে গিয়েছিলেন তার মা গৃহবধূ রেনু বেগম। কিন্তু তাকে ছেলেধরা সন্দেহে নিমিষেই পিটিয়ে হত্যা করেছে পাষণ্ড জনতা। শুধু রেনু বেগমই নয়, সাম্প্রতিককালে বেশকিছু এমন মর্মান্তিক গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে গণপিটুনির শিকার হয়েছেন বাবা! এসব গণপিটুনির অধিকাংশ ঘটনারই ভিকটিম ছিলেন নিরপরাধ। কিন্তু কে শুনেছে কার কথা? কে যাচাই করেছে দোষগুণ? তার আগেই শুধু একটা আওয়াজ, একটা গুজবে প্রাণ যাচ্ছে নিরীহ মানুষের!

এ দায় কার? শুধু কি সেই উশৃংখল নির্বোধ আমজনতার নাকি যারা উস্কে দিয়েছে তাদেরও? যারা কোনো ধরনের বিচার-বিবেচনা না করেই কল্লাকাটা গুজবকে বিশ্বাস করেছেন এবং সেটা আরেকজনকে বলে তাকেও আতঙ্কিত করেছেন তারা কি এই খুনের দায়ভার এড়াতে পারবেন? পদ্মাসেতুর জন্য মানুষের মাথা সংগ্রহের সেই কল্লাকাটা গুজবের ম্যাসেজটি যারা কোনো বাছবিচার না করেই অন্যজনকে ফরোয়ার্ড করেছেন তারা কি আজকের এই হত্যাকান্ডের নেপথ্য খুনি নন?

বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগেও আজ এই মধ্যযুগীয় বর্বরতার ঘটনাগুলো সমাজে কেন ঘটছে? অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কারের পাশাপাশি এসব ঘটনার জন্য ঠিক কোন কারণটা দায়ী? কেন মানুষ আজ হিংস্র পশুর মতো হয়ে উঠছে? কেন শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়েই মানুষ আরকেজন নিরপরাধ মানুষকে সাপের মতো পিটিয়ে হত্যা করে আবার উল্লাস করছে? কেন এই দৃশ্য দেখেও অন্য সচেতন মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে না মূর্খ মানুষদের প্রতিহত করতে? কেন মানুষ আজ অন্যায়কারীকে প্রতিহত না করে বরং সেই দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি আমি।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কোনো অপরাধীকে অপরাধ করা অবস্থায় হাতেনাতে ধরলেও তাকে পিটিয়ে হত্যা করে না জনতা। তারা তাকে পুলিশে সোপর্দ করে। নিজের হাতে কখনোই আইন তুলে নেয় না। আর যদি সন্দেহ করে যে, এই লোক অপরাধ করতে পারে কিংবা সে জড়িত থাকতে পারে তাহলে জাস্ট পুলিশকে ইনফরমেশন দেয়। তবে যার বিরুদ্ধে পুলিশকে ইনফর্ম করছে তাকে কোনোভাবেই বুঝতে দেয় না। কারণ, যদি সে নির্দোষ হয় তবে সেটা হবে চরম লজ্জার। তাই সন্দেহ করলে সেই ইনফরমেশনটি তারা পুলিশকে গোপনে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশে কেন এমন হচ্ছে? কেন মানুষ শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়েই প্রকাশ্য দিবালোকে মানুষকে চরম অমানবিকভাবে সাপের মতো পিটিয়ে হত্যা করছে? আসুন এই প্রশ্নের একটু উত্তর খুঁজি?

আইনের প্রতি যখন মানুষের আস্থা এবং শ্রদ্ধাবোধ উঠে যায় ঠিক তখনই মানুষ ব্যাপকভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া শুরু করে। একজন অপরাধীকে ধরলে কিংবা সন্দেহ করলে আজ কেন মানুষ তাকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করছে না? ছেলেধরা বা কল্লাকাটা সন্দেহে কাউকে ধরে কেন মানুষ পুলিশে না দিয়ে তাকে স্পটেই পিটিয়ে হত্যা করছে? কারণ, দুঃখজনক হলেও সত্যি আজ সবার মনে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে- পুলিশে দিলে পুলিশ টাকা খেয়ে তাকে ছেড়ে দেবে অথবা বড়জোর কোর্টে চালান করলেও দু’দিনের মধ্যেই ঠিক বের হয়ে আসবে। এই বদ্ধমূল ধারণা থেকেই মানুষ এখন ব্যাপকভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া শুরু করেছে। নিজের হাতে বিচার করার প্রতি সবার উৎসাহ জেগেছে।

পাশাপাশি দীর্ঘদিন দেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি চলছে তাতে সবার মনে একটা ধারণাই গেঁথে বসে আছে। সেটা হলো- এদেশে দিনদুপুরে খুন করলেও কিছু হয় না। যদি স্বাক্ষী না থাকে তাহলে তো সাত খুন মাফ। আর গণপিটুনিতে নিহত হলে তার তো কোনো বিচারই নেই। অজ্ঞাত জনগণ মেরেছে। অন দ্যা স্পটে বিচার করা যেন বিরাট এক পূণ্যের কাজ! এমন ধারণা থেকেই মানুষ আজ সামান্য কারণেই হিংস্র পশুর মতো আচরণ করছে! আইনের তোয়াক্কা না করে মানুষের এমন বেপরোয়া হওয়ার সঙ্গত কারণও রয়েছে!

এখানে মানুষ দেখছে একজন খুনি কিংবা ধর্ষক প্রকাশ্যে রাস্তায় বুক ফুলিয়ে হাঁটছে! গ্রেফতার হলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যে আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে! জামিনে বের হওয়ার পরে কেউ তার ভয়ে আদালতে সাক্ষ্য দিচ্ছে না। ফলে সে প্রকাশ্য দিবালোকে অপরাধ করলেও বিচারে গিয়ে আদালত থেকে বেকসুর খালাস হয়ে যাচ্ছে! এসব দেখে মানুষ আরও অপরাধ করতে উৎসাহিত হচ্ছে! আইন নিজের হাতে ইচ্ছামতো তুলে নিচ্ছে!

বাংলাদেশে আজ প্রায় সাড়ে ১১ শতাধিক আইন রয়েছে! এর অধিকাংশ আইনের কোনো বাস্তবায়ন নেই! এমনকি খোদ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনও এসব অনেক আইন সম্পর্কে জানে না কিংবা জানলেও মানে না! দেশে অল্পকিছু আইনের প্রয়োগ হয় তাও সীমিত আকারে! বাকি আইনগুলো অচল এবং আইনি পুস্তকেই সীমাবদ্ধ! যে আইনগুলো সচারাচর প্রয়োগ করতে সক্ষম হয় রাষ্ট্র সেগুলো প্রয়োগ হয় দুর্বলের উপরে! সবল রাঘববোয়ালরা টাকা এবং ক্ষমতার জোরে এদেশের দুর্বল আইনি কাঠামো ও বিচারব্যবস্থা  ভেঙে বেরিয়ে যায়! আটকা পড়ে কিছু দুর্বল চুনোপুঁটি! তাও সবসময় নয়!

বহুবছর ধরে এদেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি চলছে তারই নিদারুণ পরিনতি আজকের এসব ঘটনা। জাতির জন্য এসব ঘটনা এক মহাবিপর্যয়ের অশনিসংকেত! তাই এখনই রুখতে হবে এসব অশুভ ঘটনাকে। আইনের সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। একমাত্র আইনের সুশাসন নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল এসব অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা নিজ থেকে বন্ধ হবে। মনে রাখতে হবে- এই দায় আমাদের সবার। দায়ভার নিতে হবে সবাইকে। কারণ- “দশটা খারাপ মানুষের জন্য সমাজ নষ্ট হয় না, কিন্তু একটা ভালো মানুষ যদি নিশ্চুপ থাকে তাহলে সমাজ নষ্ট হতে বাধ্য”..!!!

– আরিফ আহমেদ মুন্না
লেখক, কবি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
২৩ জুলাই, ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ, বাবুগঞ্জ।

9 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন