১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন: জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলী

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৮:০৯ অপরাহ্ণ, ২৪ মে ২০২০

আবুল বাশার নাহিদ :: জীবনের বহু স্মৃতিরেখা কালের ধুলোয় অস্পষ্ট হয়ে হারিয়ে যায় অদৃশ্যে। যারা সন্ধ্যার গোঘূলির আলো-আধারের খেলা দেখেই জীবনের সীমারেখা টানতে চায়, অন্ধকারের ভয়ে থমকে দাঁড়ায় তাদের জীবনের স্মৃতিরেখা ঝাপসা হয়ে ধীরে ধীরে মলিন হয়ে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তবে   যারা অমাবস্যার অন্ধকারেও ভোরের আলোর প্রত্যয়ী তাঁদের স্মৃতিরেখা কালোত্তীর্ণ হয়ে উঠে। তারা সাধারণের বৃত্তে থেকেই অসাধারণ হয়ে উঠেন। মহাসমুদ্রে নাবিক যেমন আকাশের তাঁরায় প্থ-নির্দেশ খুঁজে তেমনি জনমানুষ এসব কালোত্তীর্ণ মানুষের স্মৃতি অভিজ্ঞতায় প্রেরণা-নির্দেশনা খুঁজে ফিরে। জীবনের খেরোখাতায় শব্দের ক্যানভাসে তাঁরা তুলে আনেন বহমান সময়ের স্থিরচিত্র যেমন ভাস্কর তাঁর সৃষ্টি কর্মে ফুটিয়ে তুলেন সময়ের গল্প। কবি সুফিয়া কামাল তাঁর শেষ ইচ্ছায় বলেছিলেন আমার কবর যেন আজিমপুরের সাধারণ গোরস্থানে হয়, কোন চিহ্ন  যেন না থাকে কবরের। তাঁর ভাষায়-“চলে যাবো হাসিমুখে মনে নাহি রবে কোনো খেদ, কেননা মাটির সাথে আমি হয়ে রহিব অভেদ।“ তিনি সাধারণের সঙ্গে থেকে সাধারণ থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কি জানতেন যে কত অসাধারণ হয়ে উঠেছিলেন তিনি! অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর স্মৃতিরেখায় সুফিয়া কামালের শেষইচ্ছার বর্ণনা দেন। কিন্তু অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন যিনি ১৯৬৮ সালে মফস্বল শহরের গন্ডি পেরিয়ে বিক্ষোভে উত্তাল মিছিলের নগরী ঢাকায় সাধারণের মিছিলে যোগ দিয়ে পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে নিজেই হয়ে উঠলেন অসাধারণের প্রতিচ্ছবি। হয়তো তিনি নিজেও তাঁর অসাধারণ হয়ে উঠা জানেন না কিংবা জানতেও চাননা। যেমন সুফিয়া কামালরা জানতে চাননি।

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বিগত পঞ্চাশ বছরের কর্ম জীবনের নানা আঙিনায় বহুমাত্রিক শৈল্পিক চিত্ররূপময় কবিতার রেখা এঁকেছেন যেমন শীতের কুয়াশার সকালে সবুজ শস্য মাঠের ভিতরে চলা উদাসী বালক নিজের অজান্তেই পিছনে ফুটিয়ে তুলে অনিন্দ্য কারুকার্য। তাঁর  কর্মযজ্ঞে যেমন খুঁজে পাওয়া যায় স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে জীবনের জয়গানের বাণী উচ্চারণ যেমন বর্ষার প্রচন্ড ঝড়ে বাতাসে মাথা উচু করে কদম ফুল তার দৃঢ়তা ছড়ায় শৈল্পিক ভাষায়। আবার তাঁর কর্মেই খুঁজে পাওয়া যায় হাজার বছর ধরে বয়ে চলা শান্ত অথচ দৃঢ় নদীর মত যে তার লক্ষ্যে নিরবে বয়ে চলে সমুদ্রের পানে। ফলে অধ্যাপক মামুন যেভাবে কলমে, ভাষায় রাজপথে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশু রাষ্ট্রের জন্মকালীন বিরোধীতাকারী নরপিশাচের বিচারের দাবীতে সরব ছিলেন, শিশু রাষ্ট্রের বিকাশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রপথিক তেমনি তিনি দক্ষিণ এশিয়ার স্বল্প পরিচিত অথচ বৈচিত্রময় ঢাকা আর পূর্ববঙ্গকে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর ইতিহাস আর সাহিত্যের চিত্ররেখায়। ঢাকা আর পূর্ববঙ্গের ইতিহাস রচনায় তিনি জীবন্ত কিংবদন্তী। আর মুক্তিযুদ্ধের বয়ান চিত্র অঙ্কনে তিনি অনন্য । অনেকটা প্রধান ধারাভাষ্যকারের মতই।  জীবনে হেটেছেন বহু পথে আর এঁকেছেন শৈল্পিক নানা ছবি- ছাত্র রাজনীতি, সাংবাদিক, শিক্ষক,বুদ্ধিজীবী, চিত্র সমালোচক, শিশু সাহিত্যিক, সমাজ কর্মী, সংগঠক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার আর  কিংবদন্তী  ঐতিহাসিক । আদর্শের সাথে কখনো আপোস করেননি। থেমে বা দমে যাননি  কখনো লক্ষ্য পৌছাতে অথবা কোন রক্তচক্ষুকে ভয় পাননি । এজন্য বরণ করতে হয়েছিল কারাবরণ অথবা কখনো কখনো দাড়াতে  হয়েছিল পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে।

 অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন যখন জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের স্মৃতিচারণ শব্দের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেন তখন তাঁর নিজের চিত্রের অববয়ে ফুটে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ শিক্ষক যিনি ছুটে ফিরছেন ইতিহাসের বিভিন্ন জানা-অজানা দিক আর চিন্তাগুলো  নিজের শৈল্পিক শব্দের খেলায় কিভাবে তুলে আনার গল্প। কখনো ছুটে ফিরেন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে কখনো ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। সময়ে সময়ে ফিরে আসেন গুরুর কাছে নিজেকে শাণিত করে নিতে। নিজের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেন অকপটে আর গুরুও অভয় বাণীতে বলেন- “শুনেন, ঐসব  মেধাটেধা বাজে কথা। পরিশ্রম হচ্ছে ৯৫ ভাগ, আর মেধা ৫ ভাগ।“  তাহলে আমি যদি পরিশ্রম করি, হবে? উত্তরে বলেছিলেন অবশ্যই। আব্দুর রাজ্জাক স্যার  মুনতাসীর মামুনের ব্যাপারে প্রশংসা করে বলেছিলেন, “ওর হবে, পরিশ্রম করতে পারে।“ । তাঁর স্মৃতির খাতায় ফুটে উঠে অন্য রকম আব্দুর রাজ্জাক স্যার। দেখা যাবে তরুণ মুনতাসীর মামুনের ঐতিহাসিক হয়ে উঠার গল্প।

 আবার যখন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন শিল্পী কামরুল হাসানের  শিল্প জীবনের গল্প বলেন তখন কামরুল হাসানের শিল্পী হয়ে উঠার গল্প যেভাবে জানা যায় তেমনি শিল্প সচেতন মুনতাসীর মামুনকে পাওয়া যায়। ফুটে উঠে মধ্যবিত্ত রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে শিল্পী হয়ে উঠার সংগ্রামের গল্প। দেখা যায় মুনতাসীর মামুন শিল্পীর সাথে চলে যান বংশী নদীর ওপারে যেখানে শিল্পী তাঁর চিত্রের ক্যানভাসে জীবনের গল্প বলেন।

যখন তিনি  জাহানারা ইমাম, অধ্যাপক কবির চৌধুরীর অথবা ফেরদৌসি প্রিয়ভাষীণীর  স্মৃতির গল্প বলেন তখন মনে হয় রাজপথের লড়াকু যোদ্ধা মুনতাসীর মামুন, যিনি রাজপথে অগ্নিবৃষ্টি ঝড়ান মানবতাবিরোধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে। তাঁর গল্প বলার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠে  কিভাবে  যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলন সফল হয়।

গত পাঁচ দশকে তিনি যে কত বিচিত্র ধরনের কাজের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁর কিছু রুপকল্প পাওয়া যাবে শিল্পী হাসেম খানকে নিয়ে লিখা তাঁর স্মৃতিরেখায়। বঙ্গবন্ধু জাদুঘর, ঢাকা  জাদুঘর, আদিবাসীদের নিয়ে জাদুঘর, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ ব্যাংকের “টাকা জাদুঘর”, গনহত্যা নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর, গনহত্যা- বধ্যভূমিতে ফলক স্থাপন, ত্রিপুরায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতে নির্মিত “ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যান”, ত্রিপুরার জাতীয় জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে একটি কক্ষ, বাংলাদেশের প্রথম থিমেটিক ক্যালেন্ডারের পরিকল্পনা , মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী বন্ধুদের সম্মান জানানোর প্রস্তাব, জাতীয় জাদুঘরের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্যাল্যারি, ১৯৭১ সালের গনহত্যা নির্যাতন বিষয়ক ৭১টি ডাকটিকিট প্রকাশ সহ কত শত কাজের উদ্যাগের সাথে তাঁরা জড়িত ছিলেন। তাঁরা সারাদেশে ঘুরে বেরিয়েছেন।স্কেচ করেছেন আর বই বের করেছেন। তাঁদের তুলি আর কলমে ফুটে উঠেছে অপরুপ বাংলার নৈসর্গিক চিত্ররেখা।

আজ মুনতাসীর মামুনের ৬৯ তম জন্মদিন। কিছুদিন আগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী মহলে নেমে আসে অনিশ্চয়তার শঙ্কা। সবাই প্রার্থনা করেন তাঁর দ্রুত সুস্থতার জন্য। তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসলেন। আবার কলম ধরেছেন। লিখছেন দুহাতে অবিরাম। তাঁর কলমের  শব্দের ক্যানভাসেই আমাদের মত তরুণরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, চেতনা-প্রেরণা, আর বাঙালির সুখ-দুঃখের গল্পের সাথে পরিচিত হই। আপনার স্মৃতিরেখা কালের ধূলোয় মুছে যাবে না বরং সময়ের ব্যবধানে আরো বেশি উজ্জ্বল হয়ে জাতির কাছে প্রকাশ হবে।

শুভজন্মদিন প্রগতিশীল মানুষের প্রেরণার বাতিঘর।

লেখকঃ আবুল বাশার নাহিদ লেকচারার, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ  ও

দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী

9 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন