২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

একজন মানবতার ডাক্তারের গল্প, যিনি মৃত্যুপুরীতে বদলি হলেন স্বেচ্ছায়!

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০১:২৩ পূর্বাহ্ণ, ০৮ মে ২০২০

একজন মানবতার ডাক্তারের গল্প, যিনি মৃত্যুপুরীতে বদলি হলেন স্বেচ্ছায়!

আরিফ আহমেদ মুন্না করোনা সংক্রমণের ভয়ে যেখানে সরকারি হাসপাতালে পিপিই সংকটসহ নানান অজুহাত দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেক চিকিৎসক, চাকরিচ্যুত করার কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েও সরকার যেখানে অনেককে কর্মস্থলে ফেরাতে পারছে না, এমনকি প্রাইভেট চেম্বারেও যেখানে রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন অনেক ডাক্তার; সেখানে শুধুমাত্র করোনা রোগীকে চিকিৎসা দেবার জন্য আবেদন করে সর্বাধিক করোনা আক্রান্ত এলাকায় স্বেচ্ছায় বদলি হয়ে গিয়েছেন একজন মানবতার চিকিৎসক। তিনি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীনে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু সেখানে করোনা রোগী না থাকায় সর্বাধিক করোনা আক্রান্ত এলাকায় গিয়ে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেবার সংকল্প নিয়ে নিজেই আবেদন করে নারায়ণগঞ্জ বদলি হন। মানবতার এই চিকিৎসকের নাম ডা. মো. মশিউর রহমান।

বৃহস্পতিবার (৭ মে) তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে স্বেচ্ছায় বদলির কারণ ব্যাখ্যা করেন তিনি। মশিউর রহমান ৩৯তম বিসিএস’র স্বাস্থ্য ক্যাডারের নিয়োগপ্রাপ্ত একজন চিকিৎসক। তার নানা বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত একজন মুক্তিযোদ্ধা। পিলখানার তিন নম্বর গেইটটি তার নানার নামে নামকরণ করা হয়েছে। তিনি হলেন বীরউত্তম সুবেদার হাবিবুর রহমান।

ডা. মশিউর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় কর্মরত ছিলাম। কিন্তু সেখানে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত কোনো করোনা রোগী ছিল না। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে আমাদের চিকিৎসকরা করোনা রোগীদের চিকিৎসা করতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু চিকিৎসক সবজায়গায় সীমিত। আমি ভেবে দেখলাম সিরাজগঞ্জে বসে থেকে কোনও লাভ নেই। তাই মনে মনে ইচ্ছা জন্মালো আমি যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সেবা করতে পারতাম। জাতির এইসময় যদি পাশে দাঁড়াতে পারি তাহলে আমার মেধা ও পরিশ্রম সার্থক হবে। কিন্তু হঠাৎ করে উপায় মিলছিল না। তাই উপায় খুঁজতে লাগলাম। যদি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বদলি হতে চাই, তাহলে ফাইল চালাচালি ও অর্ডার হতে সময় লাগবে। তাই আমি নিজেই ২৫ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতরে মহাপরিচালক বরাবর নারায়ণগঞ্জে বদলি হওয়ার জন্য আবেদন করলাম।’

বদলির আবেদনে যা লিখেছিলেন ডা. মশিউর রহমান

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর করা আবেদনে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি ডা. মশিউর রহমান, সহকারী সার্জন, দোবিলা ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, তাড়াশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অধীনে সিরাজগঞ্জে কর্মরত আছি। দেশের ক্রান্তিলগ্নে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় করোনা রোগীদের সেবাদানের জন্য আইসোলেশন সেন্টার এবং করোনা নিবেদিত হাসপাতালসমূহে সরকারি ডাক্তারদের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় আমি, ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের যে কোনও জেলায় করোনা টিমে বদলি হয়ে করোনা রোগীদের সেবা করতে ইচ্ছুক।

উল্লেখ্য যে, আমার নানা বীরউত্তম সুবেদার হাবিবুর রহমান ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। বিজিবি’র পিলখানার সদর দফতরের ঢাকা নিউ মার্কেট সংলগ্ন ৩ নম্বর গেইটের নাম বীরউত্তম হাবিবুর রহমান গেইট। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি নিজের জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘ ৪৬ বছর তিনি পঙ্গু থাকার পর ২০১৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। নানার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আমিও আজকের এই করোনা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাই।

অতএব, উপরোক্ত বিষয়সমূহ বিবেচনা করে আমাকে ঢাকা, গাজীপুর বা নারায়ণগঞ্জ জেলার যে কোনো সর্বাধিক করোনা রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে বদলি করে রোগীদের সেবা করার সুযোগ দানে হুজুরের সদয় মর্জি হয়।’

এই আবেদন করার দুদিন পর ২৭ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে চিকিৎসক মশিউর রহমানের নারায়ণগঞ্জে বদলির আদেশ জারি হয়। ডা. মশিউর রহমান বলেন, ‘আমাদের বদলির প্রক্রিয়াটি জেলা সিভিল সার্জনের মাধ্যমে হয়ে থাকে। তবে সেই প্রক্রিয়ায় গেলে সময় বেশি লাগতো। তাই সরাসরি ডিজি’র কাছে আমি আবেদন করেছি।’

তিনি সরাসরি চলে এসেছেন নারায়ণগঞ্জে

ডা. মশিউর রহমান সিরাজগঞ্জে বসেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তাই ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালে বদলির অর্ডার হওয়ার পরপরই তিনি নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন। মশিউর রহমান বলেন, ‘আমি মানুষের দুরবস্থা দেখে সেবার ইচ্ছা নিয়েই এখানে চলে এসেছি। আমি যখন আসি তখন এখানে আমাদের কয়েকজন সহকর্মী আক্রান্ত ছিলেন। তবে সবাই রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ প্রোটেকশন ব্যবস্থার পিপিই সরবরাহ করা হয়েছে। এখানে সবাই প্রয়োজনীয় পিপিই পাচ্ছেন। রোগীরাও আমাদের সেবায় খুশি। এখান থেকে সুস্থ হয়ে অনেক রোগীই খুশি মনে বাড়ি ফিরছেন। তবে মনটা খারাপ হয়ে যায় কেউ মারা গেলে। আমরা দিনরাত পরিশ্রম করছি যাতে একজন মানুষও তার স্বজন না হারায়।’

ডা. মশিউর রহমান প্রতিদিনই করোনা আক্রান্ত রোগীদের সাথে কথা বলেন। চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি রোগীদের আত্মবিশ্বাস এবং মনোবল বাড়ানোর জন্য কাউন্সেলিং করেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে ৭১ জন করোনা রোগী ভর্তি রয়েছেন। তাদেরকে আশ্বস্ত করে বলি যে- আমি ইচ্ছা করেই আপনাদের চিকিৎসার জন্য বদলি হয়ে এখানে এসেছি, আপনারা মনোবল শক্ত করেন। কিছু হবে না, আমাদের পরামর্শ মেনে চলুন। তখন রোগীরাও অবাক হয়। তারা বলে, আমাদের স্বজনরা কেউ কাছে আসে না, আর আপনি সিরাজগঞ্জ থেকে ইচ্ছা করে বদলি হয়ে এসেছেন!’

ডা. মশিউর রহমানের এই সিদ্ধান্তে তার সহকর্মীদের ছিল মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ তাকে পাগল বলে আখ্যায়িত করলেও অনেকেই তাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। অনেক চিকিৎসক বলেছেন, সবার পক্ষে এত সাহস দেখানো সম্ভব নয়। তবে ডা. মশিউর যেটা করেছেন সেটা বিরল দৃষ্টান্ত। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালের প্রায় সকল সহকর্মীরা তার প্রশাংসায় পঞ্চমুখ। মশিউর রহমান এই হাসপাতালের সর্বকনিষ্ঠ চিকিৎসক। তবুও তার কাজের স্পৃহাকে সবাই অনুসরণ এবং সহযোগিতা করছেন।

নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে করোনা রোগীদের চিকিৎসা জন্য আবাসিক ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানেই থাকছেন মশিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান আমাদের আবাসন, খাবার ও যাতায়াতের ব্যবস্থা করেছেন। এখানে আমাদের খাবার ও থাকার জায়গার মান খুবই ভালো।’

ডা. মশিউর রহমান বলেন, ‘নানার কাছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনা শুনছি। এসব শুনে দেশসেবায় ছোটবেলা থেকে উজ্জীবিত হয়েছি। তাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাছাড়া আমরা এগিয়ে না আসলে মানুষতো চিকিৎসাসেবা পাবে না। চিকিৎসাসেবা পাওয়া মানুষের যেমন অধিকার তেমনি চিকিৎসক হিসেবে তাদের সেবা করা আমাদের দায়িত্ব।’

মানবতার চিকিৎসক হিসেবে ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে সহকর্মী ডাক্তার-নার্স ও রোগীদের মন জয় করে নেয়া ডা. মশিউর রহমানের গ্রামের বাড়ি ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া জেলা সদরে। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। #

26 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন