২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

এখানেই লুকিয়ে আছে বরিশালের আদি ইতিহাস

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৮:০৭ অপরাহ্ণ, ১২ জানুয়ারি ২০২৩

এখানেই লুকিয়ে আছে বরিশালের আদি ইতিহাস

গিয়াস উদ্দিন, বিশেষ প্রতিবেদক:: বিভিন্ন ইতিহাসে প্রাচীনকাল থেকে বরিশালের বিভিন্ন বিষয়ের উল্লেখ থাকলেও এ জনপদের উৎপত্তি প্রাগৈতিহাসিক যুগে। বরিশাল অঞ্চলের প্রাচীন নাম বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ। তবে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নামের আগে এটি বাঙ্গালা নামেও পরিচিত ছিল। ধারণা করা হয়, বাঙ্গালা নামটি পরিবর্তিত হয়ে বাকলা হয়েছে। চতুর্দশ শতকে রাজা দনুজমর্দন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তখন চন্দ্রদ্বীপের রাজধানী ছিল বাকলা।

মুঘল আমলে বাকলায় সুবে বাংলার একটি সমৃদ্ধশালী সরকারের শাসন ছিল। ঐতিহাসিক তথ্যে জানা যায়, ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চল বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল। ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নিয়ে বাকেরগঞ্জ নামে নতুন জেলা সৃষ্টি করা হয়। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে বাকেরগঞ্জ জেলার সদর দপ্তর বাকেরগঞ্জ থেকে বরিশালে স্থানান্তরিত করা হয়। আর বরিশাল নামটি একেবারেই হাল আমলের।

প্রাগৈতিহাসিক ও ঐতিহাসিক কালের ভৌগোলিক বিবরণ বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীতে বাংলাদেশের ভৌগোলিক বিবরণের পাশাপাশি চন্দ্রদ্বীপের ভৌগোলিক বিবরণ রয়েছে। মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে কৌরব-পাণ্ডবদের যুদ্ধের পর ভগবান বলরাম গঙ্গার মোহনায় স্নান করেছিলেন এবং রাজসূয়া যজ্ঞের জন্য সাগর তীরের ম্লেচ্ছদেরকে পরাজিত করে ভীম প্রচুর সম্পদ আহরণ করেছিলেন। ওই পৌরাণিক গ্রন্থে (মহাভারত) বাঙালীদের (বাংলাদেশের অধিবাসী) ম্লেচ্ছ ও দস্যু বলে অভিহিত করা হয়। রামায়ণে গঙ্গা দেবীর পাতাল প্রবেশের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এ সকল পৌরাণিক কাহিনী বাংলা ও বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের প্রাচীন ভূ-তত্ত্ব সম্পর্কে ইঙ্গিত করে। (রোহিণী রায় চৌধূরী, বাকলা, পৃষ্ঠা- ৪১,৪২)।

উল্লেখ্য, মহাভারত রচিত হয় প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে। রাজা চন্দ্রবর্মণ চতুর্থ শতকে কোটালীপাড়ায় দুর্গ নির্মাণ করেন। বরিশালের গৌরণদী থানার সীমান্ত থেকে কোটালীপাড়ার দূরত্ব নয় কিলোমিটারের মত। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কোটালীপাড়া থানা বাকেরগঞ্জ জেলার অধীনে ছিল। ষষ্ঠ শতকে কোটালীপাড়ায় প্রাপ্ত পাঁচটি তাম্রশাসন প্রমাণ করে মৌর্য ও গুপ্ত আমলে চন্দ্রদ্বীপ উন্নত জনপদ ছিল। ভূ-তাত্ত্বিকদের মতে বরিশালের উত্তরাঞ্চল অর্থাৎ গৌরণদী, উজিরপুর, হিজলা ও মুলাদি থানার অধিকাংশ ভূ-গঠন প্রাগৈতিহাসিক যুগের।

সিরাজ উদ্‌দীন আহ্‌মেদ তাঁর বরিশাল বিভাগের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেন, বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ এক সময় পূর্ব সাগর বা লবণ সাগরে নিমজ্জিত ছিল। কোনো এক অজানাকালে গঙ্গা নদীর পলি জমে সুগন্ধা সুগন্ধা নদীর বুকে সৃষ্টি হয় একটি ত্রিকোণাকার ব-দ্বীপ। ওই দ্বীপের নাম স্ত্রীকর দ্বীপ। প্রাচীন স্ত্রীকর দ্বীপ বর্তমান শিকারপুর, উজিরপুর, গৌরণদী নামে পরিচিত।

মৌর্য আমলে সুগন্ধার মোহনায় বর্তমান গলাচিপা, কাঁঠালিয়া, আমতলী, এবং গুপ্ত আমলে বরগুনা, বামনা, মঠবাড়িয়া ও পাথরঘাটা নিয়ে আলাদা কয়েকটি দ্বীপের সৃষ্টি হয়। স্ত্রীকর, শঙ্খকোট, পিরোজপুর দ্বীপের সৃষ্টি হয় প্রাগেতিহাসিক যুগে। পরবর্তীতে ওইসকল দ্বীপের মিলিত নাম হয় বাঙ্গালা। পাল ও সেন আমলে এ দ্বীপগুলো বাঙ্গালা ও চন্দ্রদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল।

চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য প্রতিষ্ঠা রাজা রামনাথ দনুজমর্দনদেব চন্দ্রদ্বীপে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু দনুজমর্দনদেব কখন রাজত্ব করেছিলেন তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। কোনো কোনো ঐতিহামিক ধারণা করে চতুর্দশ শতকে তিনি রাজত্ব করেন। তবে চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের সপ্তম রাজা পরমানন্দ বসু ১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দে জীবিত ছিলেন।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাজা পরমানন্দ বসু ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে কোটালীপাড়ায় শ্রী চৈতন্যদেবের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময়কে ধরে এক হিসাবে ঐতিহাসিকগণ ধারণা করেন, রাজা রামনাথ দনুজমর্দনদেব ১৩২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। দনুজমর্দন বর্তমান বাউফল থানার কচুয়াতে রাজধানী নির্মাণ করেন। রাজধানীর নাম ছিল ‘বাঙ্গালা’। তিনি রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বাঙ্গালায় বন্দর নির্মাণ করেন। ওই বন্দরে আরব ও পারস্যের বনিকেরা বাণিজ্য করতে আসত।চন্দ্রদ্বীপের প্রাচীন কীর্তি বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে প্রাগৈতিহাসিককালের কোনো কীর্তির নিদর্শন পাওয়া যায়নি।

চতুর্থ শতক হতে এ অঞ্চলের প্রাচীন কীর্তির সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি, দীঘি, দুর্গ, তাম্রলিপি ও মুদ্রা। তবে লবণাক্ত পরিবেশ, ঘূর্ণিঝড় ও নদী ভাঙ্গনে এ এলাকার অনেক কীর্র্তি বিলীন হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়।তেরো শতকের প্রথম ভাগের সেন বংশীয় রাজা বিশ্বরূপ সেনের একটি তাম্রশাসন পাওয়া যায় কোটলীপাড়ায়।

ওই তাম্রশাসনে গৌরণদী থানার রামসিদ্ধি, বাঙ্গালা, ঝালকাঠি থানার নৈকাঠি ও চন্দ্রদ্বীপ নামের উল্লেখ আছে। হিজলা-মুলাদি থানার ইদিলপুরে কেশব সেনের একটি তাম্রলিপি পাওয়া যায়। তেরো শতকের ওই তাম্রলিপিতে ব্রাহ্মণকে ভূমি দান, চন্দ্রভণ্ড্র জাতি শাসন ও মন্দির নির্মাণের কথা উল্লেখ আছে। এ অঞ্চলে প্রাপ্ত মূর্তিগুলোর মধ্যে বাকেরগঞ্জের মাধবপাশা জমিদার বাড়ির কত্যায়নী মূর্তি, শিকারপুরের তারামূর্তি ভারতবর্ষে বিখ্যাত। গৌরণদীর লক্ষণকাঠির বিষ্ণুমূর্তি বাংলার ভাস্কর্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। সুলতানী, মুঘল ও অন্যান্য আমলের প্রাচীন কীর্তি।

চন্দ্রদ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলে মুসলিম স্থাপত্য শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয় সুলতানী আমলে বিশেষ করে রুকনউদ্দীন বরবক শাহ এর শাসন আমলে (১৪৫৯-৭৪খ্রিস্টাব্দ)। এ পর্যন্ত বরবক শাহের ১৫টি শিলালিপি আবিষকৃত হয়েছে। তাঁর নামাঙ্কিত একটি শিলালিপি পাওয়া যায় পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ থানার মসজিদবাড়িতে। মির্জাগঞ্জের মসজিদবাড়ির মসজিদ নির্মিত হয় ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দে। পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে গুরিন্দা গ্রামে রয়েছে গুরিন্দা জামে মসজিদ। এ মসজিদটিও বরবক শাহের আমলে নির্মিত হয়েছে।

মুঘল আমলের একটি উন্নত জনপদ হিসাবে পরিচিত ছিল গৌরণদীর কসবা। ওই আমলে কসবা ও পাশ্ববর্তী এলাকায় অনেক মসজিদ নির্মিত হয়। কসবা কাজীবাড়ির সামনে একটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ রয়েছে। কসবা হাটের দক্ষিণ পাশে একটি, কাহারবাড়ির কাছে একটি এবং খলিফাবাড়ির কাছে একটি মসজিদের ধংসস্তুপ রয়েছে।

কমলাপুর গ্রামে তিন গম্বুজ ও তিন দরজা বিশিষ্ট একটি মসজিদ রয়েছে। গুরিন্দা জামে মসজিদপটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে গলাচিপা উলানিয়া সড়কের পূর্ব পাশে গুরিন্দা খাল। ওই খালেরপশ্চিম পাড় ঘেঁষে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গুরিন্দা জামে মসজিদ। ৩৬১ বর্গফুট ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট বর্গাকৃতির মূল মসজিদ ভবনের উচ্চতা ১৬ ফুট। এক গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদটি মাটি থেকে তিন ফুট উঁচু ভিটির ওপর। এত রয়েছে একই মাপের তিনটি খিরান দরজা। মসজিদটির কয়েক ফুট দক্ষিণে ভিন্ন আরেকটি ভিটির ওপর ১৬ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১১ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট একটি বৈঠকখানা।

ধারণা করা হয় ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান বরবকশাহের রাজত্বকালে নির্মিত হয় গুরিন্দা জামে মসজিদ। অবশ্য বরবকশাহের চন্দ্রদ্বীপ বিজয়ের আগেই মুসলমানদের আগমন ঘটে এ অঞ্চলে। দীর্ঘ দিন ধরে লোকচক্ষুর আঁড়ালে ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঢাকা পড়েছিল গুরিন্দা জামে মসজিদ। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় বাহাদুরপুরের পীর সাহেব বাদশা মিয় এ এলাকায় সফরে এস মসজিদ এলাকা আবাদ করে ওই মসজিদে জুমা নামাজ আদায় করার জন্য এলাকাবাসীকে বলে যান।

দীঘি বিভিন্ন আমলে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে প্রায় দুই হাজার দীঘি খনন করা হয়। এগুলোর মধ্যে মাধবপাশার দুর্গাসাগর দীঘি, পটুয়াখালীর কারখানা, বাকেরগঞ্জের কবিরাজের দীঘি, বানারীপাড়ার লস্করপুরের দীঘি, উজিরপুরের শোলকের মলুয়ার দীঘি, গৌরণদীর ছবিখাঁর পার, হিজলা থানার জমাদার বাড়ির দীঘি উল্লেখযোগ্য।

3 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন