১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

এ যুগের অসুর চিন্ময়ের চোখে জল

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:৫০ অপরাহ্ণ, ২৬ অক্টোবর ২০১৯

এস.এম রফিকুল ইসলাম:: বারবার কলম হাতে নিয়েও থেমে গিয়েছিলাম ওর মত একটা নষ্ট কীটের পিছনে সময় ব্যয় করবো না ভেবে। তবে আমাকে বিবেক তাড়িত করে ফেরে বারংবার। তাই আর বিবেককে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দমাতে পারিনি। অসুরের ক্ষমতার বাহুবলে বহু নিরীহ নিপরাধ মানুষকে থানা ও কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্টে ঢুকিয়ে আজ সে নিজেই লাল দালানের চৌদ্দশিক গুনছে। প্রিয় পাঠক, বলছিলাম বরিশালের সাবেক দারোগা মাদক ব্যবসায়ী চিন্ময় মিত্রর কথা। চিন্ময় কোতয়ালি মডেল থানা ও মহানগর ডিবি পুলিশের এসআই ছিলেন। বিশেষ করে স্ব-জাতি পুলিশ কমিশনার শৈবাল কান্তির আমলে চিন্ময় দাপুটে ও বহুল ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছিল।

এমনকি মহানগর ডিবি পুলিশের বিভাগীয় প্রধান উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি ডিবি)কে টপকিয়ে সরাসরি পুলিশ কমিশনারের সাথে সম্পর্ক রেখে চলত সে। যার বদৌলতে এসআই চিন্ময়কে তৎসময়ের কতিপয় পুলিশের প্রধান খাদ্য বিএনপি জমায়াতের নেতা কর্মীদের এ্যারেস্ট অর্থ্যাৎ পলিটিক্যাল এ্যারেষ্টের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। জামায়াত-বিএনপির লাগাতার হরতাল অবরোধের সময় দায়িত্ব পেয়ে বরিশাল মহানগরের এমন কোন নেতা পাতি-নেতা নেই যে খানে চিন্ময় হানা দেয়নি। এমনকি রাজনীতি না করা অসংখ্য ব্যবসায়ীরাও ছিল চিন্ময়ের গ্রেপ্তারের তালিকায়। একেক জন মানুষের কাছে তিন চার বার গিয়ে লাখ লাখ টাকা ঘুষ আদায় করে ৪/৫ বারের সময় চাহিদামত উৎকোচ না পেয়ে ধরে নিয়ে এসেছে। অনেকে রাজনীতি যুগযুগ পূর্বে ছেড়ে দিয়েছে কিংবা বয়সের ভারে ন্যুজ হয়ে পড়েছে তাদেরকেও এনে মিথ্যা মামলা মোকদ্দমায় ঢুকিয়ে দিয়েছে সে। এসময় চিন্ময়ের অর্থ বাণিজ্যের মূল টার্গেটে ছিল দাড়ি টুপি ওয়ালা মানুষেরা। স্কুল-কলেজ মাদরাসায় হানা দিয়ে এ প্রকৃতির শিক্ষক ছাত্রদের খপ করে ধরে বলত টাকা দেন নইলে নাশকতা মামলায় ঢুকাবো। এভাবে দিনের পর দিন সে অবৈধ উপায়ে অর্থ কামানোর ধান্দায় নানা অপকর্ম করে বেড়ালেও পুলিশ কমিশনারের খাস লোক তাই সবাই মুখবুজে সহ্য করেছে। কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। যদিও তৎ সময়ে দু’একটি পত্রিকায় চিন্ময়ের এসব অপকর্মের খবর ছাপা হয়েছে।

কিন্তু সেই সাংবাদিকদেরকেও বিভিন্নভাবে হয়রানী ও হেনস্তার ব্যর্থ চেষ্টা চালাতে ভুল করেনি চিন্ময় বাবু। শুধু তাই নয় শহরের অলিগলিতে চিন্ময়ের ছত্রছায়ায় মাদক বেচাকেনা চলতো। নগরীর অন্তত ১০টি পয়েন্টে চিন্ময়ের নিজস্ব সোর্স ও বেতনভুক্ত মাদক বিক্রেতা দ্বারা ইয়াবা, ফেন্সিডিল বিক্রি করাতো। ফলে চিন্ময় অল্প সময়ের ব্যবধানেই কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যায়। শহরের অনেক ইয়াবা সুন্দরী, মাকদসেবী ও ব্যবসায়ী নারীদের সাথে চিন্ময়ের গভীর সখ্যতা ও নিষিদ্ধ আদান প্রদান ছিল। এমনকি মাদক বিক্রেতাদের সুন্দরী স্ত্রীরাও রক্ষা পেত না লম্পট চিন্ময়ের হাত থেকে। চতুর ধুরন্দর ও নানা অপকর্মের অনুঘটক চিন্ময়ের মাদক ইয়াবা/ফেন্সি বিক্রেতার তালিকায় বরিশাল নগরীর এক ওয়ার্ড আ’লীগের সভাপতির নাম জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছিল। চিন্ময় বরিশাল থেকে ঢাকা নারায়নগঞ্জ শিল্প পুলিশে বদলী হলে সেই স্বজাতি আলীগ নেতা চুপসে যান।

একই তালিকায় স্থান পেয়েছিল আরেকজন প্রভাবশালী নেশাখোর সাংবাদিকের নাম। যিনি হাবিব ভবনে বসে রবীন্দ্র সংগীতের তালে তালে ইয়াবা সেবন করত। তিনি আজ মরহুম। আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। তাই তার ঢের সমালোচনা ও নামটা উচ্চারণ হয়তো নাইবা করলাম। বেঁচে থাকলে হয়তো তার অবস্থাও একই পথের যাত্রী চিন্ময় বাবুর মতোই হতো। প্রিয় পাঠক, আপনারা হয়তো ইতিমধ্যেই অনেকে জেনেছেন, গত ২১ অক্টোবর সোমবার মাদকের মামলায় সাবেক দোর্দন্ড প্রতাপশালী এসআই ও মাদক ব্যবসায়ী চিন্ময় মিত্রকে ৫ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদন্ড দিয়েছেন বরিশাল ১ম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক এম.এ হামিদ।

একই মামলায় চিন্ময়ের বেতনভূক্ত মাদক ব্যবসায়ী নিধু মিস্ত্রীকে ৩ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ৩ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ২ মাসের কারাদন্ড দেন আদালত।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ২৪ জুলাই নগরীর কাশিপুর থেকে নিধু মিস্ত্রি নামে এক মাদক বিক্রেতাকে ৪৮ বোতল ফেন্সিডিলসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই ঘটনায় এসআই সুলতান আহমেদ বাদী হয়ে মাদক নিয়ন্ত্রন আইনে মামলা দায়ের করেন। গ্রেপ্তারকৃত নিধু আদালতের বিচারকের কাছে দেয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দীতে বলেন, সে চিন্ময়ের বেতনভূক্ত কর্মচারী, মাসে ১০ হাজার টাকা বেতনে চাকুরী করে। উদ্ধার হওয়া ফেন্সিডিল তার নয় এগুলো চিন্ময় মিত্রের। শুধু ফেন্সিডিল নয় এসআই চিন্ময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইয়াবা সংগ্রহ করে বরিশাল নগরীর আশেপাশের এলাকায় বেতনভূক্ত কর্মচারী দিয়ে বিক্রি করে। বরিশাল মহানগর ডিবি পুলিশের এসআই পদে পোষ্টিং হওয়ার পর থেকে চিন্ময়ের মাদক ব্যবসার অভিষেক ঘটে বলেও জানায় নিধু মিস্ত্রি। প্রিয় পাঠক, কথায় আছে, পাপ ছাড়েনা বাপকেও। অপরাধী যত বড়ই হোক না কেন একদিন না একদিন তাকে আইনের আওতায় আসতেই হবে। তারই ধারাবাহিকতায় চিন্ময় মিত্র একজন পুলিশের দারোগা হয়েও তার সহকর্মী পুলিশের দেয়া মামলা ও চার্জশিট এবং সাক্ষ্য বিবেচনায় এনে আদালত তাকে সাজা দিয়েছেন। মাদক ব্যবসায়ী চিন্ময় মিত্র মামলা ও সাজা থেকে বাঁচার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করেও রক্ষা পায়নি। কারাবন্দি অবস্থায় আদালতের পরবর্তি স্টেজ আপিলেও হয়তো একইভাবে পার পাবার চেষ্টা চালাবে সে।

কিন্তু কোন অবস্থাতেই তার নির্দোষ দাবি ধোপে টিকবে বলে আমার মনে হয়না। কেন না একজন নিদোর্ষ পুলিশ অফিসারকে কখনোই তার সহকর্মী পুলিশ অফিসাররা ও পুলিশের উধ্বর্তন কর্মকর্তারা ফাঁসাবেন না এটাই চির সত্য। আমি ধন্যবাদ জানাই সেই সব পুলিশ কর্মকর্তাদের যারা চিন্ময়ের কোটি টাকা ঘুষের অফার প্রত্যাখান করে পেশাগত দায়িত্ব পালনে অবিচল রয়েছেন। যারা অর্থের মোহে সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে বিচলিত হননি। নিজেদের জলাঞ্জলি দেননি অসুরের ঘুষ মন্ত্রের কাছে।

লেখক: আইনজীবী ও সম্পাদক প্রকাশক দৈনিক আমাদের বরিশাল।

8 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন