২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

কবি হেনরী স্বপনকেও গ্রেপ্তার করা যায়!

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১১:০৭ অপরাহ্ণ, ১৪ মে ২০১৯

আমীন আল রশীদ:: ‘বরং ক্রান্তিকালেই তো ছোট কাগজের জন্ম। অতএব মৃত্যুর সময় যার জন্ম, তার মৃত্যু নেই।’ ছোট কাগজের ক্রান্তিকাল ও অন্যান্য বইয়ে (প্রকাশক শ্রাবণ, ফেব্রুয়ারি ২০১৬) কবি হেনরী স্বপন যে ক্রান্তিকালের কথা লিখেছেন, তার ভিকটিম এবার তিনি নিজেই।

ফলে যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কবি হেনরী স্বপনকে গ্রেপ্তারের খবরটা শুনি, তাতে বিস্মিত হইনি। কারণ বিরুদ্ধ সময়ের যাত্রীদের এই পরিণতি অস্বাভাবিক নয়। বরিশাল শহরে কবি হেনরী স্বপনকেও গ্রেপ্তার করা যায়। অর্থাৎ কোনো কিছুই যে এখন আর অসম্ভব নয়। দেশের সবচেয়ে সম্মানিত মানুষটিকেও পুলিশ যদি কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যায়, তাতেও বোধ করি কেউ বিস্মিত হবেন না। আমাদের মন থেকে বিস্ময় চলে যাচ্ছে। যতক্ষণ না আমাদের প্রত্যেকের কোমরে দড়িটা বাঁধা হয়।

আমাদের জানা দরকার হেনরী স্বপন কে? হেনরী স্বপন জলে ভেসে আসা কোনো খড়কুটো নন। এই শতাব্দীর শুরুর দিকে আমরা যখন দুয়েক লাইন কবিতা-সাহিত্য বোঝার চেষ্টা করছিলাম; তারুণ্যের উন্মাদনায় যখন লিটল ম্যাগাজিন বের করার তাড়না বোধ করছিলাম, তখন আমাদের সামনে যে কয়টি পত্রিকা ও যে কয়জন মানুষ মহীরুহের মতো ছিলেন, তাদের অন্যতম এই হেনরী স্বপন এবং তার লিটল ম্যগাাজিন ‘জীবনানন্দ’।

এই কাগজে কবিতা ছাপা হওয়া অনেক বড় কবির জন্যও সম্মানের ব্যাপার ছিল। তবে এসব ছাপিয়ে ব্যক্তি হেনরী স্বপনও অত্যন্ত উদার, সংবেদনশীল এবং নিরেট ভদ্রলোক হিসেবেই পরিচিত। কারো আত্মসম্মান বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে তিনি কথা বলেন, এটা নিজের কানে শুনলেও অবিশ্বাস্য মনে হবে। সেরকম একজন মানুষকে নাকি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায় পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

বরিশালের সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিককর্মীদের ধন্যবাদ যে তারা হেনরী স্বপনের গ্রেপ্তারের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়েছেন। পুলিশের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে তাদের কেউ কেউ পুলিশের সব অনুষ্ঠান বয়কটেরও ঘোষণা দিয়েছেন, যতক্ষণ না হেনরী স্বপনের নিঃশর্ত মুক্তি হয়।

স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, দিন কয়েক আগে থেকেই হেনরী স্বপনকে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছিলো। এ বিষয়ে তিনি থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ডায়েরিটি নথিভুক্ত করা হয়েছে কি না তা বরিশালের সাংবাদিকরা জানে না। অথচ সেই হেনরী স্বপনের বিরুদ্ধে একটা অদ্ভুত অভিযোগের মামলায় গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

সাংবাদিকরা মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত চেষ্টা করেও মামলার এজাহারের কপি জোগাড় করতে পারেননি। অভিযোগ উঠেছে পুলিশ হেনরী স্বপনকে তার বাসা থেকে ধরে নিয়ে এসেছে মঙ্গলবার দুপুরে। অথচ মামলা রেকর্ড (বাদী, বরিশাল ক্যাথলিক চার্চের ফাদার লরেন্স লাকা ভেলি গোমেজ, মামলার নম্বর ৪৮) হয়েছে ওইদিন বিকালে। পুলিশের এই অতি উৎসাহের কারণ স্পষ্ট নয়।

এবার দেখা যাক হেনরী স্বপন ফেসবুকে কী এমন লিখেছিলেন যার কারণে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হলো? ২৩ এপ্রিল তিনি লিখেছেন: ‘রোম যখন পুড়ছিল তখন সম্রাট নিরো নাকি বাঁশি বাজাচ্ছিলো। শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর গির্জায় আত্মঘাতী হামলায় শত শত মানুষ নিহতের আকস্মিকতায় যখন শোকস্তব্ধ বিশ্ববাসী, তখন বরিশাল ক্যাথলিক ডাইওসিসের বিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার চার্চ চত্বরে করছেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।’

এই ঘটনা যদি সত্যি হয়, অর্থাৎ শ্রীলঙ্কার চার্চে বোমা হামলার সময়ে যদি বরিশালের চার্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, তাহলে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে হেনরী স্বপন কী অপরাধ করলেন? এখানে কোন বাক্যটির দ্বারা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত হলো? এটুকু সমালোচনা করা কথা বলা কিংবা মতামত প্রকাশের অধিকার একজন নাগরিকের থাকবে না? আবার কেউ একজন সংঘুব্ধ হয়ে মামলা করতে গেলেই পুলিশ মামলা নিয়ে নেবে এবং অতি উৎসাহী হয়ে তাকে গ্রেপ্তার করবে? গ্রেপ্তারের আগে তারা ভাববে না কাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে?

যাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তিনি কে, তার অতীত কী, তার সম্পর্কে তার সমাজ ও স্থানীয়দের ভাবনা কী? তিনি মানুষ হিসেবে কতটা উচ্চমানের এবং যে অভিযোগ করা হচ্ছে সেটি আদৌ সঠিক কি না? পুলিশ হয়তো বলবে এসব আদালতে প্রমাণের বিষয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আদালত পর্যন্ত এইসব ঘটনা তো যাওয়ারই কথা নয়। যেকোনো অপরাধ দমনের প্রাথমিক কাজটা পুলিশের। তারা যদি সঠিক তদন্ত করে বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্ট দেয়, তাহলে আদালতে কারো ন্যায়বিচারের সংকট তৈরি হয় না।

কিন্তু সাধারণত পুলিশের রিপোর্ট হয় পক্ষাপতদুষ্ট এবং যে পক্ষ তাদের বেশি পয়সা দেয়, রিপোর্ট তাদের পক্ষেই যায়—এরকম অভিযোগ নতুন কিছু নয়। আমরা অনেক সময়ই বলি তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ হয়েছে। বস্তুত এইসব আইনে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার সবই আইনের প্রয়োগ; অপপ্রয়োগ নয়। কারণ যে উদ্দেশ্যে আইনগুলো করা হয়েছে সেই উদ্দেশ্যসাধনেই তা বাস্তবায়িত হয়েছে এবং হচ্ছে। অর্থাৎ এটিই আইনের প্রয়োগ।

তবে এসব আইনে মামলা ও গ্রেপ্তারের পেছনে অধিকাংশ সময়ই রাজনৈতিক প্রভাব বা ইন্ধন থাকে। কিন্তু হেনরী স্বপন যে ধরনের মানুষ, তাতে তার সাথে কারো রাজনৈতিক বিরোধ থাকার সুযোগ নেই। স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়েও জেনেছি, তাকে গ্রেপ্তারের পেছনে কোনো রাজনৈতিক ইন্ধন বা পুলিশের উপরে কোনো রাজনৈতিক চাপ ছিল না। তাহলে তারা কেন এরকম একজন মানুষকে গ্রেপ্তার করলো এবং পুরো বিষয়টি নিয়ে একধরনের ‘হাইড এন্ড সিক’ খেলছে?

প্রসঙ্গত, নানা আলোচনা-সমালোচনা আর বিতর্কের মধ্যে গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে জাতীয় সংসদে যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল পাস হয়, সেখানে কার্যকর কোনো বিরোধিতা ছিল না। কেবল বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারি কিছু সমালোচনা করেছেন এবং তিনিও এই আইনটি তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারার চেয়ে আরও বেশি ভীতি ছড়াবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন। কিন্তু সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে এসব বিচ্ছিন্ন সমালোচনার আখেরে কোনো মূল্য নেই। শুধু এটি সংসদীয় কার্যবিবরণীতে থাকবে—এই যা।

সংসদে বিবেচনার জন্য আনার আগে নিয়ম অনুযায়ী এই বিলটি যাচাই-বাছাই করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। তারা বিলটির বিষয়ে সিনিয়র সাংবাদিকদের মতামতও নিয়েছে। কিন্তু সেই মতামতের কোনো প্রতিফলন আইনে নেই। আইনের বিভিন্ন ধারার বিষয়ে সাংবাদিক সমাজ যে ৩২টি সুপারিশ দিয়েছিলো, তা মানা হয়নি।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে নাগরিকদের উদ্বেগের আরেকটি বড় কারণ এখানেও তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার আলোকে একটি বিধান রাখা হয়েছে যার দোহাই দিয়ে নাগরিকদের হয়রানির করার সুযোগ স্পষ্টই বহাল থাকলো। আইনে বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যমে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ; মানহানিকর তথ্য প্রকাশ; ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত; আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, অনুমতি ছাড়া ব্যক্তি তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবহার ইত্যাদি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

প্রশ্ন হলো, কোন কথাটি মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক, মানহানিকর এবং কোন তথ্যে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে বা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটবে—তার মানদণ্ড কী? এটি তো ব্যাখ্যার বিষয়। কিন্তু সেই ব্যাখ্যার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যে ধারণা—তাতে এই আইনের যাচ্ছেতাই প্রয়োগ ঠেকানো সম্ভব নয়।

এই আইনের অপপ্রয়োগের শিকার হয়ে কোনো নাগরিক গ্রেপ্তার হওয়ার পরে উচ্চআদালত থেকে হয়তো জামিন পাবেন কিংবা খালাসও পাবেন—কিন্তু সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে হতে তাকে শারীরিক, আর্থিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে যে ভীষণ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে—সেই ক্ষতিপূরণ তাকে কে দেবে?

2 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন