২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার

করোনায় ক্ষতির মুখে দক্ষিণাঞ্চলের নৌকাশিল্প

Saidul Islam

প্রকাশিত: ১০:৪৯ পূর্বাহ্ণ, ১৮ জুলাই ২০২১

 

করোনায় ক্ষতির মুখে দক্ষিণাঞ্চলের নৌকাশিল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঝালকাঠি>> দক্ষিণাঞ্চলের নৌকাশিল্প করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। লকডাউন ও করোনা মহামারীর ছোবলে শতবর্ষের পুরনো ভাসমান নৌকার হাটগুলোতে ক্রেতা সঙ্কটে দিশাহারা নির্মাতাসহ বিক্রেতারাও। গত বছরে মত এবারের বর্ষা মৌসুমেও নৌকা তৈরির কারিগরসহ ক্রেতার অভাবে বিপর্যস্ত দক্ষিণাঞ্চলের এ দুটি নৌকার মোকাম। এসব ভাসমান ও মৌসুমী হাটে কারিগরের অভাবে নৌকা তৈরি যেমন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে, তেমনি লকডাউনে দূর-দূরান্তের ক্রেতারও আসতে পারছেন না।

এবার মৌসুমের শুরু থেকেই প্রায় স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের নদী-নালা এবং খাল-বিলগুলো ইতোমধ্যে পানিতে টই-টুম্বুর হয়ে গেছে। এতে নৌকা নির্ভর এসব এলাকায় চাহিদা থাকলেও করোনার বিরুপ প্রভাব পরেছে এ শিল্পের ওপর। একদিকে যেমন প্রয়োজনীয় কারিগড় পাওয়া যাচ্ছে না, অন্যদিকে আর্থিক সঙ্কট সহ করোনার ভয়ে দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতারাও আসছেন না এসব নৌকার হাটে।

আবহমান কাল থেকে নৌকাই বর্ষার গণমানুষের প্রধান বাহন হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সেই ধারাবাহিকতায় এবারে বর্ষাার শুরু থেকেই গ্রামাঞ্চলে নুতন নৌকা তৈরি ও পুরোনো নৌকা মেরামতের হিড়িক পড়েছে দক্ষিনাঞ্চলের জেলাগুলোতে। ‘ধান-নদী,খাল, এই তিনে বরিশাল’ এই প্রবাদটি অনেক পুরানো হলেও এর বক্তব্য আজো চির নতুন। এককালের সেই বরিশাল এখন আর একক জেলা নেই, ছয় জেলায় পরিনত হয়েছে।

এক শ’বছরের পুরানো ঝালকাঠী-পিরোজপুরের সীমান্তবর্তী আটঘর হাটে এবার আগের বছরের তুলনায় এক-চতুর্থাংশ নৌকাও হাটে আসছে না। ক্রেতাও কম। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, কাঠসহ নৌকা তৈরির উপকরণের দাম বাড়লেও বাড়েনি নৌকার দাম। অপরদিকে করোনার কারণে ক্রেতা কম থাকায় চাহিদাও নেই। ফলে এ শিল্পের সাথে জড়িতরা বিপাকে পরেছেন।

অন্যদিকে ক্রেতার বলছেন, নৌকার দাম আগের বছরের তুলনায় অনেক বেশি। তবে বিক্রেতাদের দাবি, কাঠ ও লোহা সহ সব উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির সাথে কারিগড়দের মজুরিও প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে গত তিন বছরে। ফলে নৌকার দাম না বাড়িয়ে উপায় কী?

ঝালকাঠি জেলার সীমান্ত সংলগ্ন আটঘর নৌকার হাট। সপ্তাহের দুই দিন সোম ও শুক্রবার এ হাট বসে। এখানে বিক্রির জন্য পার্শ্ববর্তী স্বরুপকাঠি, বানাড়ীপাড়া, নাজিরপুরসহ বিভিন্ন উপজেলার ছুতাররা তাদের তৈরি ডিঙ্গা (ছোট নৌকা) নিয়ে এখানে আসতে শুরু করেন। ক্রেতারা আসেন সকাল থেকেই। সারাদিন চলে বেচাকেনা। প্রতি হাটবারে গড়ে ৫০০ থেকে ১ হাজার নৌকা বিক্রি হয়। চাম্বল, রেইনট্রি,কড়াই প্রভৃতি দেশী কাঠ দিয়ে তৈরি এসব নৌকার প্রতিটির দাম পড়ে ৮০০ থেকে ৮০০০ টাকা পর্যন্ত। সাইজ এবং গঠন ভেদে এসব নৌকার দামও ভিন্ন ভিন্ন।

একজন কিংবা দু’জন যাত্রী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন নৌকার দাম ৮ শ’থেকে ১৫০০ টাকা। এ ধরণের একটি নৌকা তৈরিতে একজন ছুতারের দেড় থেকে দুই দিন সময় লাগে। এ ধরনের একটি নৌকা বিক্রি করে ৩ শ’ টাকার বেশি লাভ হয় না। কাঠ পেরেক সহ নৌকা তৈরির কাচাঁমালের দাম বেড়ে যাওয়ায় নৌকা তৈরি করে আগের মত লাভ হয় না বলে জানালেন নৌকা বিক্রি করতে আসা সুণীল মিস্ত্রি। তবুও পূর্বপুরুষের পেশা ছাড়তে পারছেন না গৌরাঙ্গ মিস্ত্রি।

নৌকা বিক্রেতা হালিম জানান, বর্ষা মৌসুমে বাহিরে কাজ করা সম্ভর হয়ে উঠে না,তাই বাড়িতে বসে নৌকা তৈরি করি। বর্ষা মৌসুমে বেকার থাকতে হয় না। সপ্তাহে ৩ খানা নৌকা তৈরি করতে পারি। তবে ৮/১০ জন যাত্রী ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন এক একটি নৌকা তৈরি করে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা লাভ করা যায়। অবশ্য এ ধরনের নৌকা তৈরিতে সময় এবং শ্রম দু’টোই বেশি লাগে। মূলত ধানক্ষেতে যাওয়া আসা, মাছ ধরা, পেয়ারা তোলা, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, হাট বাজারে যাওয়া সহ অন্যান্য সবজি সংগ্রহের কাজেই এসব নৌকা ব্যবহৃত হয়। স্বল্পমূল্যের এসব নৌকার স্থায়ীত্ব এক মৌসুম।

বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে বৃহত্তর বরিশালের ছয়টি জেলাতেই নৌকার কদর থাকে। নৌকার দেশ হিসাবে পরিচিত জেলাগুলো হলো ঝালকাঠি, বরিশাল, ভোলা,বরগুনা, পটুয়াখালী, এবং পিরোজপুর। আর এ ছয় জেলার জন্য প্রয়োজনীয় নৌকার বেশিরভাগই সরবরাহ করে পিরোজপুর ও ঝালকাঠি জেলার ছুতাররা। বছরের অন্যান্য সময় নৌকার চাহিদা তুলনামূলকভাবে কম থাকলেও বর্ষা মৌসুম আসার সাথে সাথে এই এলাকার ছুতারদের ব্যস্ততা বেড়ে যায় অনেক গুন। কারণ বৃহত্তর বরিশালের ছয়টি জেলার গ্রামাঞ্চলের মানুষ বর্ষা মৌসুমে হয়ে পরে পুরোপুরি নৌকা নির্ভর। এই অঞ্চলের অর্থাৎ এমন অনেক গ্রামও এ অঞ্চলে রয়েছে যোখানে বর্ষা মৌসুমে নৌকা ছাড়া ঘর থেকে বেরুনোও প্রায় অসম্ভব। আর এ জন্য গ্রামের প্রতিটি পরিবারই ছোট বড় নৌকা সংগ্রহের জন্য ভীড় করে ঝালকাঠির সীমান্ত সংলগ্ন আটঘর হাটের মত বিভিন্ন নৌকা বিক্রির হাটে।

বৃহত্তর বরিশালের বিভিন্ন জেলা থেকে নৌকা সংগ্রহের জন্য খুচরা ক্রেতারাতো বটেই, পাইকারি ক্রেতারাও আটঘর হাটে আসেন। এখান থেকে নৌকা সংগ্রহ করে সরবরাহ করেন বিভিন্ন এলাকায়। নৌকা তৈরির কারিগর বা মিস্ত্রিরা এ অঞ্চলে ছুতার নামে পরিচিত। এরা বিভিন্ন হাট থেকে রেইনট্রি, সুন্দরী, চাম্বল, মেহগিনি সহ বিভিন্ন জাতের কাঠ সংগ্রহ করে মিলে চেড়াই করে বাড়ি নিয়ে দিন রাত খেটে তৈরি করেন ছোট বড় নানা ধরনের নৌকা। ডোঙ্গা, পেনিস, বজরা, পানসি, ডিঙ্গি, ডিঙ্গা, ছিপ, কোষা ইত্যাদি কত বাহারী নাম এসব নৌকার।

প্রায় এক শ’ বছরের পুরানো ঝালকাঠির সিমান্তবর্তী আটঘর নৌকা কেনা বেচার হাটে বিক্রির জন্য জেলা বিভন্ন স্থান থেকে কারিগর এবং মৌসুমী ব্যবসায়ীরা নৌকা নিয়ে আসে ট্রলারে কিম্বা গাড়িতে করে। এখান থেকে এসব নৌকা যাচ্ছে বৃহত্তর বরিশাল এবং ফরিদপুরের প্রত্তন্ত এলাকায়। প্রতি মৌসুমে এ হাটে এক থেকে দেড় কোটি টাকার নৌকা বিক্রি হয় বলে ব্যবসায়ীরা জানান।
ঝালকাঠির সীমান্তবর্তী আট ঘরের নৌকার হাটে গিয়ে দেখা গেছে, নৌকা ব্যবসায়ীরা রাস্তার উপরে এবং খালে কোষা নৌকার এক বিশাল আড়ত গড়ে তুলেছে। এর পাশেই কারিগররা খুব ব্যস্ত নৌকা তৈরি করতে। বাড়িতে নৌকা তৈরির পর একটির উপর আর একটি নৌকা সাজিয়ে ট্রলারে করে বিক্রির জন্য আনা হচ্ছে।

ছুতারদের ভাষ্যমতে কাঠ, পেরেক এবং ক্লামের মূল্য মিলিয়ে প্রতিটি নৌকার নির্মাণ ব্যায় বর্তমান বাজরে অনেক বেশি। তার উপর রয়েছে হাটের ইজারাদারদের খাজনা। বিক্রির উপর শতকরা ১০-১৫ টাকা হারে খাজনা দিতে হয়। তার পরেও বিকল্প ব্যাবস্থা না থাকায় নৌকা তৈরি করেই পার করতে হয় বর্ষা মৌসুম।

নৌকা বিক্রেতা সমিতির সভাপতি ছালেক ব্যাপারীসহ বেশ কয়েকজন নৌকা ক্রেতা বিক্রেতা খাজনা আদায়ের ক্ষেত্রে জুলুম করার অভিযোগ করেন।

অবশ্য ইজারাদারের লোক পরিচয় দানকারী মোসলেম মিঞা এ অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, পাকা রশিদ দিয়ে সরকারি রেট অনুযায়ী খাজনা আদায় করা হয়।

ঝালকাঠি বিসিক শিল্প সহায়ক কেন্দ্রের উপ-ব্যাবস্থাপক মোঃ শাফাউল করিম সাংবাদিকদের জানান, নৌকা তৈরির কারিগরদের পূঁজি সঙ্কটের কথা ম্বীকার করে জানান, এ সমস্যা সমাধানে তাদেরকে বিসিক থেকে স্বল্প সুদে মৌসুমী ঋণ দেয়ার একটি প্রকল্প রয়েছে। তারা ঋণের জন্য এলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ ব্যাপারে ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক মোঃ জোহর সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, স্থানীয় নৌকাশিল্পর ওপর করোনার কিছুটা প্রভাব পড়েছে। তিনি এ শিল্পের সাথে জড়িত ক্ষতিগ্রস্থদের প্রয়োজনীয় সহায়তার বিষয়টি বিবেচনার কথাও জানিয়েছেন।

10 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন