১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

সাংবাদিকতার বাতিঘর গোলাম সারওয়ারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০২:৫৫ পূর্বাহ্ণ, ১৩ আগস্ট ২০১৯

কিংবদন্তির মহাগুরু গোলাম সারওয়ারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

✪ আরিফ আহমেদ মুন্না || বাংলাদেশের সংবাদপত্র অঙ্গনে সাফল্য, পেশাদারিত্ব, সততা, নিষ্ঠা ও আদর্শের প্রতীক হিসেবে যার নামটি সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয় তিনি সাংবাদিকতার কিংবদন্তি, পিআইবি চেয়ারম্যান, দৈনিক সমকাল ও যুগান্তরের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম সারওয়ার। আজ ১৩ আগস্ট তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৮ সালের এই দিনে সবাইকে কাঁদিয়ে সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মহাসিন্ধুর ওপারে পাড়ি জমান সাংবাদিকতার বাতিঘরখ্যাত গোলাম সারওয়ার। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ‘গোলাম সারওয়ার স্মৃতি পরিষদ’ আজ ১৩ আগস্ট রাজধানী ঢাকায় এবং তাঁর জন্মভূমি বরিশালের বানারীপাড়ায় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে। এছাড়াও তাঁর শেষ কর্মস্থল দৈনিক সমকাল, পিআইবি এবং জাতীয় প্রেসক্লাবে তাঁর স্মরণসভাসহ বিভিন্ন শোক কর্মসূচি পালিত হবে।
১৯৪৩ সালের ১ এপ্রিল বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার এক ঐতিহ্যবাহী সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে গোলাম সারওয়ার জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মরহুম গোলাম কুদ্দুস মোল্লা ও মা মরহুমা সিতারা বেগম। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। মেজ ভাই গোলাম সালেহ মঞ্জু মোল্লা বানারীপাড়া পৌরসভার টানা ৪ বারের সফল মেয়র ছিলেন। বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছোট ভাই গোলাম মির্জা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের মহাব্যবস্থাপক।
গোলাম সারওয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রাবস্থায় ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী’র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। পরের বছর দৈনিক সংবাদের সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। তাঁর সততা ও পেশাদারিত্বের কারণে বঙ্গবন্ধু তাকে ভীষণ পছন্দ করতেন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে গোলাম সারওয়ার মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন নিজ এলাকা বানারীপাড়া ও আশেপাশের এলাকাকে হানাদারমুক্ত করতে। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে দেশ স্বাধীন করার পরে তিনি ভাবলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে বাঙালিকে শিক্ষিত করতে হবে। তাই তিনি বানারীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন কিছুদিন।
এরপর ১৯৭২ সালে তিনি সিনিয়র সহ-সম্পাদক (শিফট ইনচার্জ) হিসেবে যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। এখানে প্রধান সহ-সম্পাদক, যুগ্ম-বার্তা সম্পাদক ও বার্তা সম্পাদক পদে ছিলেন তিনি। ২৭ বছরের বর্ণিল কর্মজীবন শেষে তিনি ১৯৯৯ সালে ইত্তেফাক ছেড়ে প্রতিষ্ঠা করেন দৈনিক যুগান্তর। যুগান্তরের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে কয়েক বছরের মধ্যেই পাঠকের আস্থা ও জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছান দৈনিক যুগান্তরকে। ২০০৫ সালে যুগান্তর ছেড়ে প্রতিষ্ঠা করেন দৈনিক সমকাল। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে আপন মেধা ও দক্ষতায় অল্প সময়ের মধ্যে সমকালকেও দেশের অন্যতম সেরা জনপ্রিয় সংবাদপত্রে পরিণত করেন। সমকাল সৃষ্টির ১০ বছরের মধ্যে আবার যুগান্তরের প্রয়োজনে বছর দু’য়ের জন্য যুগান্তরে প্রত্যাবর্তন করলেও আমৃত্যু সমকালের সম্পাদক ও অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
সাংবাদিকতার দীর্ঘ ৫০ বছর পথপরিক্রমার পাশাপাশি গোলাম সারওয়ার সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও রেখেছেন গৌরবোজ্জ্বল অবদান। তিনি সংস্কৃতি বিষয়ক সাপ্তাহিক পূর্বাণীর নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। চলচ্চিত্র সাংবাদিকদের সংগঠন ‘বাচসাস’-এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ষাটের দশকে সাংবাদিকতার শুরু থেকে একটানা ৫০ বছর তিনি এই পেশায় মেধা, যুক্তিবোধ, পেশাদারিত্ব, দায়িত্বশীলতা, মুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার নিরবচ্ছিন্ন চর্চা করে গেছেন। মুক্তিযু্দ্ধের পক্ষে তিনি বরাবর ছিলেন আপোষহীন এবং অকুতোভয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সর্বদা প্রতিবাদী ও সত্য প্রকাশে সবসময় অবিচল থাকার কারণে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়েছিল। তবে সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় ওই গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। দীর্ঘ সংবাদিকতার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে তাকে একাধিকবার হত্যার অপচেষ্টা করেছিল ঘাতকরা। রাস্ট্রীয় ভিআইপি বিবেচনায় তাকে রাস্ট্রীয়ভাবে নিরাপত্তা প্রদানসহ তাঁর সাথে সরকার থেকে ব্যক্তিগত সশস্ত্র গানম্যানও দেয়া হয়েছিল।
সংবাদপত্রের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ বার্তা বিভাগে গোলাম সারওয়ারের সৃজনশীলতা, সংবাদবোধ ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা উদাহরণ হিসেবে গণ্য। সাংবাদিকতায় আজ তিনি একটি প্রতিষ্ঠানিক মডেল হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত। “সাংবাদিকদের শিক্ষক” গোলাম সারওয়ারের হাতে গড়া সহস্রাধিক সাংবাদিক এখন দেশের বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভি মিডিয়ায় কাজ করছেন। তাঁর হাতে সরাসরি কাজ শেখা বেশকিছু সাংবাদিক এখন দেশের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশন মিডিয়ার সম্পাদক, প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগ্যতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন।
ষাটের দশকে অসংখ্য ছড়া লিখেছেন গোলাম সারওয়ার। ‘রঙিন বেলুন’ নামে তাঁর একটি ছড়ার বই প্রকাশ করে শিশু একাডেমি। তাঁর নানা স্বাদের লেখার সমারোহে সমৃদ্ধ ‘সম্পাদকের জবানবন্দি’, ‘অমিয় গরল’, ‘আমার যত কথা’, ‘স্বপ্ন বেঁচে থাক’ প্রভৃতি গ্রন্থগুলো ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে।
বিভিন্ন সময়ে নানা সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রেও অনবদ্য ছিলেন গোলাম সারওয়ার। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে তিনি বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) চেয়ারম্যান হিসেবে সর্বশেষ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়াও তিনি জাতীয় সম্পাদক পরিষদের সভাপতি, ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন পরিষদের আহবায়ক, সাংবাদিক কল্যাণ তহবিলের প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড ও আপিল কমিটির সদস্য। চলচ্চিত্র অনুদান কমিটি ও সম্প্রচার খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন কমিটিরও সদস্য ছিলেন। তিনি বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি, বানারীপাড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি, রাজধানীর খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উত্তরা হাই স্কুল এ্যান্ড কলেজের সভাপতি হিসেবে ১৮ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। গোলাম সারওয়ার বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) পরিচালক ছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত, পাকিস্তান, ডেনমার্ক ছাড়াও বহু দেশ সফর করেছেন। তাঁর সম্মানে যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাকে সে দেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেছিল।
গোলাম সারওয়ার ২০১৪ সালে সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য একুশে পদক লাভ করেন। বিগত ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বর্ণাঢ্য এক জমকালো অনুষ্ঠানে তাঁর হাতে এ পদক তুলে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা।
সাংবাদিক-অন্তপ্রাণ বর্ষীয়ান গোলাম সারওয়ার শুধু একজন আদর্শ সাংবাদিকতার পথিকৃতই নন, তিনি বৃহত্তর বরিশাল বিভাগের উন্নয়নের একজন নেপথ্য কারিগরও ছিলেন বটে। প্রতিনিয়ত দেশের মানুষ ও মানবতার কল্যাণে যিনি আমরণ নিভৃতে কাজ করে গেছেন। ভীষণ রকমের প্রচার বিমুখ ও নিভৃতচারী এই দেশপ্রেমিক মানুষটি যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিনই দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করেছেন। ৭১’র এই বীর মুক্তিযোদ্ধা দেশকে দিয়ে গেছেন অনেক কিছু। কীর্তিমান এই মহাপুরুষ তার লাখোকোটি ভক্ত-অনুরাগীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে গতবছর না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। ফুসফুস ও কিডনি রোগে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন সাংবাদিকতার এই কিংবদন্তির প্রবাদপুরুষ। #
8 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন