২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

কি রে মুকুল ভালো আছিস…!

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১১:৫৯ পূর্বাহ্ণ, ০৪ মার্চ ২০২১

মুকুল দাস, বরিশাল:: আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষাগুরু প্রফেসর মোহাম্মদ হানিফ আর নেই। দিন কয়েক আগে তিনি পাড়ি জমিয়েছেন দ্বিতীয় গন্তব্যে। যেখানে থেকে কেউ আর কোন দিন ফিরে আসেনা। পঁয়ষট্টি সালে আমি বিএম কলেজে ইলেভেন ক্লাসে ভর্তি হই বাণিজ্য বিভাগে। প্রথম দিনের ইকনমিক্স’র ক্লাস নিয়েছিলেন তিনি। ইংলিশ মিডিয়ামে তখন সবাইকে পড়তে হত। বেঙ্গলী মিডিয়ামের চল ছিলোনা। স্যার ফান্ডামেন্টাল এবং কমোডিটি এই শব্দ দুটি এতো বেশি বার বার উচ্চারণ করেছিলেন, যা আমার কাছে ক্লিশে মনে হয়েছিল। এ ভাবেই ইকনমিক্স’র পাঠ নিয়ে মালথ্যাস বাদ, রিকার্ডিয়ান থিযোরী অব মানি, ল অব ডিমিনিশিং ইউটিলিটি শিখে ফেলি। সাতষট্টি সালে বিএম কলেজ থেকে এডুকেশনাল এক্সকারশনে পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকটি দর্শনীয় স্থানে যাওয়ার জন্য নেতৃত্ব পেয়েছিলেন হানিফ স্যার। শুধু ফার্স্ট ইয়ার এবং থার্ড ইয়ার’র শিক্ষার্থীরাই এই এক্সকারশনে অংশ নিতে পারবে। আমরা তখন ইন্টার ফাইন্যাল দিয়েছি।

স্যারের মতে আমরা বিএম কলেজের ছাত্রত্বহীন। সবাইকে দিতে হবে চল্লিশ টাকা। আমরা তিন জন সাফায়াত রেজা (ওয়াশিংটন প্রবাসী), গোলাম কিবরিয়া মনু এবং আমি। পরে স্যার বললেন, যে কোন দুজন তোমরা যেতে পারবে। দিতে হবে পঁচাত্তর টাকা। যাওয়ার আগের দিন মনু রাত বারোটায় তুমুল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সাইকেল চালিয়ে আমার বাসায় এসে বলে, স্যার আমার ভাবীর কাছ থেকে আমার চল্লিশ টাকা নিয়ে এসেছেন। বাকী রইলাম আমি ও রেজা। পরদিন সকালে আমরা গিয়ে রকেটে উঠলাম। স্যার এগারোটায় চা খাওয়ার সময় আমাদের নাম লিখে নিলেন। দুপুরে বাটলারে ভাত খেলাম। তিনটেয় চাঁদপুরে পৌঁছে ট্রেন ধরে লাকসাম এলাম। লাকসামে বৈকালিক জলযোগ শেষে চিটাগাং এর উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। আমাদের সবাইর থাকার যায়গা নির্ধারিত হয়েছিল আগ্রাবাদ কমার্স কলেজ হোস্টেলে।

স্যার থাকতেন তার ভায়রার বাসায়। আগ্রবাদ কমার্স কলেজ হোস্টেল থেকে গনি রেস্তোরাঁয় টিফিন করে এসে সকালে শুনি রেজা স্যারকে চল্লিশ টাকা দিয়ে দিয়েছে। আমার কাছে টাকা চাইতেই আমি স্যারকে বলি, বাবা আমাকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বলেছেন চল্লিশ টাকা স্যার কে দেবে আর ১০ টাকা তোমার হাত খরচ। চিটাগ্যাং এ প্রথম যাই পাহাড়তলী রেলওয়ে ওয়ার্কশপে। যেখানে রেলগাড়ি অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য আসে। পরে চিটাগাংয়ের দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে দেখলাম পতেঙ্গা মেটারিওলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট, আমিন জুট মিল, হযরত বায়েজীদ বোস্তামীর মাজার, কাপ্তাই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, চন্দ্রঘোনা পেপার মিল, রাঙ্গামাটি লেকসহ অন্যান্য। ইতোমধ্যে বিপণী বিতান থেকে একটা ক্যারোলীন শার্ট কিনে ফেলেছি। চিটাগাংয়ের সব কিছু দেখার পর যাই সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে। তখন কক্সবাজারে মাত্র দুটি হোটেল ছিল। একটি “সৈকত” অপরটি “সাইম্যান”। সৈকত এ উঠেছি আর ভাত খেয়েছি সাইম্যান-এ। তার আগে স্যুইমিং কস্টিউম পরে সমুদ্র স্নানও করে ফেলেছি। ফেরার সময় পাহাড়ে যাই রেজাকে নিয়ে। একটা বার্মিজ লুঙ্গী কেনার জন্য।

দোকানের মালিকান এক আদিবাসী তরুণী। লুঙ্গীর ওপরে নীল রঙের সেমিজ পরা, চুলে এক থেকে দেড়শো ক্লিপ আঁটা। রুজের ব্যবহার ছাড়াই সারামুখে গোলাপী আভা ছড়ানো। এরপরে আমাদের যাত্রা হযরত শাহজালালের পুণ্যভুমি সিলেট। সেখানে গিয়ে হযরত শাহজালালের দরগা দর্শন, চা বাগান এবং ফেঞ্চুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অন্যতম। পরের গন্তব্য নাটোর। বাহাদুরাবাদ ফেরীতে বসে স্যার সুলেখক শংকরের পেপার ব্যাক নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবোরেটরী উপন্যাসটি কিনেছিলেন। ফেরীতে ভাত খাওয়ার ফাঁকে বইটা পড়ে ফেলি। কীট বিজ্ঞানী জীমূত বাহন সেনের মেয়ে মদালসাকে ভালো লেগে যায়। স্যার বললেন বলতো নাটোর কি জন্য বিখ্যাত? আমি চটজলদি বলি স্যার সন্দেশের জন্য। স্যার ধ্যাৎ বলে মুখে একটা অদ্ভুত ভঙ্গী করে বললেন কোথায় বলবি বনলতা সেনের কথা আর বললি কিনা সন্দেশ। এখন সতেরো জনকে সন্দেশ খাওয়াতে হবে। তখন ষোলআনায় একটাকা। এক টাকায় ষোল পিস রকমারি সন্দেশ পাওয়া যেত।

নাটোরের রাণী ভবানীর প্রাসাদ দেখতে গিয়ে শুনি সেটা এখন ‘গভর্ণর হাউস’। দেখা যাবে তবে ক্যামেরা নেওয়া যাবেনা। রাজশাহী থেকে একশো ফজলি আম কিনে ছিলাম কুড়ি টাকায়। দু টাকার দুটি ঝুড়িতে করে। রাজশাহীর একবন্ধু বলল পদ্মার চরে দাঁড়িয়ে ওপারের লাল গোলা মুর্শিদাবাদের আলো দেখা যায়। আম রেখেছিলাম লাগেজ ভ্যানে। প্রতিটি স্টেশনে গাড়ি দাঁড়ালে ছুটে যেতাম লাগেজ ভ্যানের দিকে। ভাবনা একটাই আম হাপিস হয়ে যায় কিনা। খুলনায় এসে আমের ঝুড়ি নামাতে গিয়ে ধরা খেলাম। স্যার বললেন, চিটাগ্যাং এ ক্যারোলিন শার্ট, কক্সবাজারে বার্মিজলুঙ্গী, রাজশাহীর ফজলি আম অথচ টাকা দেয়ার বেলায় কঞ্জুসি। সঙ্গে সঙ্গে ঝুড়ি থেকে দুটি প্রমাণ সাইজের ফজলি আম বের করে বললাম স্যার এ দুটি আপনার জন্য, আপনি খান।

বিরাশিতে আমার স্ত্রী তাপসী বিএম কলেজে ইকনমিক্স এ অনার্স এবং মাস্টার্স করেছে স্যারের ছাত্রী হয়ে। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের তাপসীর অনার্সের সার্টিফিকেট রেজিস্টার্ড বিল্ডিং থেকে বিএম কলেজে পাঠিয়েছিল স্যারের ঠিকানায়। আমি সার্টিফিকেট আনতে গেলে আমাকে সার্টিফিকেট না দিয়ে বলেন যারটা তার হাতে দেব। তাপসীকে নিয়ে যাই বাধ্য হয়ে। সার্টিফিকেট হাতে দিয়ে তাঁর বৌমার জন্য মিষ্টি আমার ভাগ্যে চা মুড়ি।

অগ্রগণ্য রবীন্দ্র প্রেমী ওয়াহিদুল হকের স্মরণসভার কার্ড দিতে গিয়ে বিমলা ধামের লোহার গেটে কপাল ঠুকে ট্যাম হয়ে গিয়েছিল। স্যার তাড়াতাড়ি ফ্রিজ থেকে বরফ বার করে কপালে মেজে দিয়েছিলেন। স্যার আজ নেই। কখনো কোনদিন কেউ আর আন্তরিকতার সুরে বলবেন না, কিরে মুকুল ভালো আছিস…!

লেখক
শিক্ষক ও কলামিস্ট

5 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন