২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

কে বেশি দামী!

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১২:২১ পূর্বাহ্ণ, ১৩ ডিসেম্বর ২০২০

এম. এম. মাহমুদ হাসান:: গত ১৪ নভেম্বর,২০২০ খ্রি থেকে আমি এবং আমার স্ত্রী (কোভিড-১৯) করোনায় আক্রান্ত হয়ে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল, রাজারবাগ, ঢাকায় ভর্তি ছিলাম। গত ৯ ডিসেম্বর করোনার ২য় টেস্ট নেগেটিভ হলে ওই দিনই বিকেল ৪:৩০ মিনিটে নিজ বাসার উদ্দেশে উবারযোগে  হাসপাতাল  ত্যাগ করি। আলহামদুলিল্লাহ, যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার–যিনি সকল সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা। কোভিড আক্রান্ত হয়ে আমি  HDU (High Dependency Unit) তে একটানা ১০ দিন High flow- তে ৯২% অক্সিজেন সাপোর্ট নিয়ে আল্লাহর অশেষ রহমত এবং মানুষের দোয়ায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বেঁচে ছিলাম, তবে আত্মবিশ্বাস আর মানসিক শক্তিতে মনোবল ছিল শতভাগ পরিপূর্ণ।
সুস্থ জীবন যে মহান রাব্বুল আ’লামিনের দেয়া  কত বড় নিয়ামত তা আমি মুমূর্ষু অবস্থায় প্রতি মুহূর্তে অনুধাবন করেছি। আমার শরীরে অক্সিজেনের Requirements দেখে বারবার মনে প্রশ্ন জেগেছিল একজন সুস্থ মানুষ সারাজীবন মুক্ত বাতাস থেকে যে পরিমান অক্সিজেন টেনে নেয়, তার আর্থিক মূল্য কত হবে? – এই প্রশ্ন আপেক্ষিক, ক্ষেত্র বিশেষ অবান্তর। উত্তরঃ তথৈবচ। কারণ মুক্ত বাতাসের সুলভ অক্সিজেনের দরদাম নির্ধারণের মাপকাঠি কারো হাতে নেই (এসব চিন্তা না করে বরং নিজ গ্রামে গিয়ে এলাকার যুবকদের নিয়ে গ্রাম্য রাস্তার দু’পাশে কিছু নিমগাছ, তালগাছ, খেঁজুরগাছ, অর্জুন গাছ…. লাগানো যেতে পারে- এতে কিছুটা হলেও বাতাসে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়বে)।
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন মানুষ আল্লাহ্ তা’আলার কি পরিমান নিয়ামত ভোগ করে তাকি কল্পনা করা যায়! সুস্থ দেহ, সুস্থ অঙ্গ – প্রত্যঙ্গ, সুস্থ মন, সুস্থ পরিবেশ – সব কিছুই তো একমাত্র আল্লাহর নিয়ামত। সামান্য অসুস্থতায় আক্রান্ত হলেই বুঝা যায় আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতের  মর্ম ও গুরুত্ব।উঠতে – বসতে, নিদ্রা-জাগরণে, ঘরে-বাইরে সর্বত্রই আমরা আল্লাহর নিয়ামতের প্রবাহমান সাগরে ডুবে আছি সর্বক্ষণ। এই নিয়ামত গনণার সাধ্য কারো নেই- আর এখানেই মানুষ চরম অসহায় ও চরম ব্যর্থ।
 প্রতি নিয়ত বেড়েই চলছে করোনা রোগীর সংখ্যা । চারিদিকে বেড়ে চলছে অক্সিজেনের জন্য হাহাকার। অক্সিজেনের সিলিন্ডার এদেশের সবচেয়ে প্রার্থিত ও দুর্লভ জিনিসগুলোর মধ্যে একটি। করোনায় আক্রান্ত অনেক রোগীকেই কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন দেয়ার প্রয়োজন পড়ছে এখন (যেমনটি আমার বেলায় ও লেগেছিল)। মুমূর্ষু প্রিয়জনদের বাঁচানোর প্রয়োজনে অনেক মানুষ অক্সিজেন সিলিন্ডার খোঁজ করে সিলিন্ডার বাসায় বা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। করোনা মহামারীতে ভুক্তভোগী মানুষ হারে হারে টের পাচ্ছে যে প্রতিদিন তারা মহান রাব্বুল আ’লামিনের কতো বড় নিয়ামত ভোগ করে।মানুষের অস্তিত্বই মহান রাব্বুল আ’লামিনের বিশেষ অনুগ্রহ। তিনি মানুষের পার্থিব জীবনের প্রয়োজনীয় উপকরণ সহজসাধ্য করে দিয়েছেন। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য মহান রাব্বুল আ’লামিন জীবন/জীবিকার পথ সুগম করেছেন। চাষাবাদের জন্য জমিন উর্বর করেছেন। বাতাস, ছায়া ও অক্সিজেনের জন্য বৃক্ষ সৃষ্টি করেছেন । প্রতিদিন একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ গড়ে ৫৫০ লিটার বিশুদ্ধ অক্সিজেন গ্রহন করে (helth.howstaffworks.com) যার জন্য কাউকে কোনদিন কোথাও কিংবা কারো নিকট কোন অর্থ গুনতে হয়নি; ধনী গরিব সবাই একই নিয়মে এই নিয়ামত ভোগ করে অথচ করোনা আক্রান্ত হয়ে বা অন্য কোন কারনে যদি কাউকে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন গ্রহণ করতে হয় তাহলে বর্তমান বাজার মূল্য অনুযায়ী ১.৪ কিউবিক মিটারের একটি সিলিন্ডার কিনতে গুণতে হচ্ছে ৪৭ হাজার টাকা পর্যন্ত, যার মধ্যে খালি সিলিন্ডারের দাম বাবদ ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা বাদ দিলেও শুধু ১.৪ কিউবিক অক্সিজেন মূল্য দাড়ায় ২২ হাজার  থেকে ২৭ হাজার টাকা অর্থাৎ প্রতিদিন একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ ২ লাখ  ৭১ হাজার টাকা  থেকে ৩ লাখ  ৩৯ হাজার টাকার অক্সিজেন বিনামূল্যে গ্রহণ করেন; সুবাহানআল্লাহ| তাই আমাদের উচিত প্রতিমুহূর্তে মহান রাব্বুল আ’লামিনের শুকরিয়া আদায় করা এবং তাঁর নির্দেশিত পথে জীবনকে পরিচালিত করা।
মহান রাব্বুল আ’লামিন সবাইকে তাঁর শুকরিয়া জ্ঞাপনকারী অনুগ্রহ বান্দা হিসেবে কবুল করুন। আ-মি-ন। মানুষের সুন্দর আকৃতি, রূপ, যৌবন, জ্ঞান, বুদ্ধি, সহায়-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি  সবকিছু আল্লাহর দান। এই পৃথিবী ও পৃথিবীর সবকিছুই মানুষের উপকারে সৃজীত, এসব নিয়ামতের জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করার শ্রেষ্ঠতম উপায় হলো তাঁর  উপর পূর্নাঙ্গ ঈমান এনে তাঁর  নির্দেশিত পথে জীবনকে পরিচালিত করা।
গভীর কৃতজ্ঞতা ও আন্তরিক ধন্যবাদ  জানাই বাংলাদেশ পুলিশের আইকন, মাননীয় আইজিপি  মহোদয়কে – যিনি পুলিশের সার্বিক কল্যাণে নানাবিধ যুগোপযুগী উদ্যোগ গ্রহন করেছেন। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন।
মাননীয় আইজিপি মহোদয়ের  ডাইনামিক নেতৃত্ব ও সঠিক দিক-নির্দেশনায় কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে; যার ফলে বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিটি সদস্য ও তাদের পরিবারবর্গ এখান থেকে সময়োপযোগী চাহিদা মত কাঙ্খিত ও প্রত্যাশিত সেবা পেয়েছে/পাচ্ছেন। আইজিপি মহোদয়ের  দিক-নির্দেশনায় চলমান করোনায় হাসপাতালে কর্মরত সকল পর্যায়ের পুলিশ সদস্যগন, চিকিৎসকগন , নার্স , স্বাস্থ্যকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই আন্তরিকভাবে অত্যন্ত মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি  নিয়ে সবাইকে সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সদিচ্ছায়  এবং আইজিপি মহোদয়ের গতিশীল নেতৃত্বে আধুনিক পুলিশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ এগিয়ে চলছে  দুর্বার গতিতে। জীবনের চরম সংকটাপন্ন মুহূর্তে নিজের জন্য এবং নিজ পরিবারের জন্য কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল থেকে বিনামুল্যে যে আধুনিক চিকিৎসা সেবা পেয়েছি এর জন্য বাংলাদেশ পুলিশের সদস্য হিসেবে আমি গর্বিত, আনন্দিত ও চিরকৃতজ্ঞ।
পুলিশ সদস্যদের সন্তানদের জন্য বিভাগীয় পর্যায়ে মান সম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ এবং বাসস্থান সুবিধা নিশ্চিতকরণের জন্য আইজিপি মহোদয় যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন এতে আমরা প্রত্যেক পুলিশ সদস্য আরও দায়িত্বশীল হয়ে মানবিক দর্শনে উজ্জীবিত হয়ে জনগণের পুলিশ হতে  আইজিপি মহোদয়ের নির্ধারিত  ৫ টি  নির্দেশনা ( ১. দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, ২. মদক নির্মূল, ৩. অমানবিক, ও অপেশাদার আচরণ বন্ধ করা, ৪. বিট পুলিশং, ৫. পুলিশের সার্বিক কল্যাণ) যথাযথভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করে সততা, দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে জনগণের আস্থা, ভালোবাসা ও বিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে ‘মুজিব বর্ষের অঙ্গিকার পুলিশ হবে
জনতার’ – এই নীতিতে কাজ করে মুজিব জন্মশত বর্ষে আমরা অবশ্যই আপনার স্বপ্নের ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’ হব, ইনশাআল্লাহ্।
কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের সম্মানিত ডিআইজি মহোদয়, পুলিশ সুপার মহোদয় এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহোদয় (সানতু স্যার একজন সত্যিকারের মানবিক মানুষ – শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রতিদিনই যার সান্নিধ্য পেয়ে মানসিক প্রশান্তি লাভ করেছি), আমার প্রিয় বন্ধু ডাঃ ইকবাল, ডাঃ আজহার, ডাঃ রবিউল হালিম মুন্না, ডাঃ রুবাইয়েত, ডাঃ শাহনাজ কুতুবী, ডাঃ জাহিদ, ডাঃ শোয়েব, ডাঃ ইমরান আলী, ডাঃ মাহফুজ, ডাঃ মোস্তাক আদনান, ডাঃ সাব্বির, ডাঃ তারিক, ডাঃ তারেক, ডাঃ মৌসুমি, ডাঃ ময়ূরী, ডাঃ মনীষা, ডাঃ মিলিসহ অন্যান্য ডাক্তারগণ, সকল নার্সগণ, পুলিশ সদস্যগণ, আর্টিগণ, ওয়ার্ডবয় ও খালাদের কাছে কৃতজ্ঞতা  জ্ঞাপন করছি। সত্যিকার অর্থেই, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে কর্মরত সকলের সেবায় মুগ্ধ, সকলের কাছেই চিরকৃতঙ্গ এবং চিরঋণী ।
 বাংলাদেশ পুলিশে বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত শ্রদ্ধেয় সিনিয়র স্যারগণ, প্রিয় ব্যাচমেটগন এবং বিভিন্ন পর্যায়ের জুনিয়র সহকর্মীগণ অসুস্থতাকালীন আমার শারীরিক অবস্থার আপডেট নিয়েছেন – আমি আপনাদের স্নেহ ও ভালোবাসায় সত্যিই মুগ্ধ ও বিমোহিত।
বরিশাল, ঝালকাঠি এবং আমার নিজ এলাকার সকলের কাছে আমি এবং আমার পরিবার চিরকৃতজ্ঞ, আপনারা আমার সুস্থতার জন্য বিভিন্ন দরবার শরীফ, মসজিদ ও মাদ্রাসায়, নিয়মিত দোয়া-মোনাজাতের আয়োজন করেছেন –  আপনাদের এমন ভালোবাসায় আমি সত্যিই আনন্দিত, গর্বিত ও ধন্য। আপনাদের আন্তরিক স্নেহ ও ভালোবাসাই আমার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা।
আমার বন্ধু মহলের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। মিডিয়া সংশ্লিষ্ট অনেকেই আমার শারীরিক অবস্থার সার্বক্ষণিক আপডেট নিয়েছেন- আপনাদের প্রতিও কৃতজ্ঞ।
সর্বোপরি, আমার পরিবারের কোন সদস্য কিংবা কোন আত্মীয়-স্বজনকে ” কোন প্রকার ধন্যবাদ নয়”। কোভিড আক্রান্ত হয়ে শুধু এটুকুই বুঝেছি যে “আপনারা আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসেন (মাত্রাতিরিক্ত)”।
পরিশেষে হাসপাতালের বেডে ২৬ দিন থেকে অনুধাবন করেছি যে ” কোভিড অভিশাপ নয়, আর্শীবাদ”। কোভিড আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ ২৬ দিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেছি পৃথিবীতে সবচেয়ে কে বেশি দামী!  আসলে এ প্রশ্নের উত্তর ও আপেক্ষিক ও অবান্তর। HDU/ICU তে থাকা একজন রোগী যখন তার খাওয়া-দাওয়া, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এবং যাবতীয় সকল কাজে একজন ওয়ার্ডবয়(মহিলা/পুরুষ)এর দিকে ২৪ ঘন্টাই যে অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকে, তা হাসপাতালে ভর্তি না থাকলে কোনদিনই বুঝতে পারতাম না।
“হায়রে মানুষ!
কিসের এতো অহংকার তোমার!
কিসের এতো বাহাদুরি! এতো বড়াই!
কি নিয়ে তোমার এতো ‘আমিত্ব’?
—নিজেকে অন্যের তুলনায় উত্তম ও শ্রেষ্ঠ এবং অন্যকে নিজের তুলনায় তুচ্ছ ও ঘৃণ্য মনে করাই কি তোমার বাহাদুরী”??
আসুন, মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে নিজেদের ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমা চাই। অহংকারের পোশাক খুলে আত্নাকে পরিশুদ্ধ করি। হে দয়াময় প্রভূ! তুমি আমাদেরকে অহংকার থেকে মুক্ত করে জাগ্রত করে দাও আমাদের বিবেকবোধ, দান কর আমাদেরকে এক আত্মশুদ্ধিময় পরিশুদ্ধ জীবন।
আমাদেরকে করোনার আক্রমন থেকে রক্ষা কর, আ-মি-ন।
সবশেষে, ইন্টারমিডিয়েট এর ইংরেজী পাঠ্য বইয়ে Samuel Taylor Coleridge(1798) এর লেখা The Rime of The Ancient Mariner এর ৪ টা লাইন রোমন্থন করে আমার লেখাটি শেষ করলাম(ইন্টারমিডিয়েটে পড়া অবস্থায় যে লাইন ৪ টি আমি বেশি বেশি পড়তাম আর প্রকৃতির সৃষ্টি জগৎকে অনুভব করতাম)–
He prayeth best, who loveth best
All things both great and small;
For the dear God who loveth us,
He made and loveth all.’
—সৃষ্টি জগতের ছোট-বড় সকলকেই ভালোবাসা উচিত, এটাই সর্বোত্তম ইবাদত-কেননা জগতের সবকিছুই তো মহান রাব্বুল আল-আমিন এঁর সৃষ্টি।
লেখক————————-
এম. এম. মাহমুদ হাসান, পিপিএম (বার)
অ্যাডিশনাল এসপি
এন্টি টেররিজম ইউনিট
বাংলাদেশ পুলিশ, ঢাকা।
6 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন