২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার

গণপরিবহনে পত্রিকার স্টিকার লাগিয়ে বরিশালে কথিত সাংবাদিকদের চাঁদাবাজির ব্যতিক্রম স্টাইল

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৬:৩৬ অপরাহ্ণ, ০৪ মার্চ ২০২১

গণপরিবহনে পত্রিকার স্টিকার লাগিয়ে বরিশালে কথিত সাংবাদিকদের চাঁদাবাজির ব্যতিক্রম স্টাইল

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল:: বরিশালের অভ্যন্তরীণ সড়কপথে ছোট পরিসরের গণপরিবহনের সামনে পিছনে লাগানো থাকে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার ও টিভি চ্যানেলের চটকদার স্টিকার। দেখলে মনে হয় প্রচারমূলক বিজ্ঞাপন। স্টিকার লাগানো এই গাড়িগুলো দেখলে সড়কে দায়িত্বরত সার্জেন্ট এবং পরিবহন শ্রমিকরাও সমীহ করতে দেখা যায়। এই রহস্য অনুসন্ধানে নামলে বেরিয়ে আসে অন্তরালের খবর। আসলে প্রচার নয়, প্রশাসনিক হয়রানি এবং পরিবহন শ্রমিকদের চাঁদা যেনো না দিতে হয়, তার সতর্কস্বরূপ প্রতিকী হিসেবে এই স্টিকার সাঁটানো হয়ে থাকে। বিশেষ করে মাহিন্দ্র ও সিএনজি মালিকপক্ষ মিডিয়াকর্মীদের ব্যবহার করে সড়কপথে নিজেদের গাড়িগুলো নিয়ে নির্ঝঞ্জাট থাকতেই এই কৌশল নিয়েছে। বিপরীতে মিডিয়াকর্মীদের দেওয়া হয় মাসিক “বিটমানি”। অর্থাৎ গাড়িপ্রতি একহাজার টাকা হারে উত্তোলন করে। এভাবে একেকজন মিডিয়াকর্মীর ভাগে রয়েছে অন্তত ১০ থেকে ১৫টি গাড়ি।

একজন শ্রমিক নেতা অনেকটা অভিযোগের সুরে জানালেন, এনিয়ে নানা সময়ে সাংঘর্ষিক সম্পর্ক থেকে সাম্প্রতিক মিডিয়াকর্মীদের সাথে মাহিন্দ্র শ্রমিক ইউনিয়নের সস্পর্কের টানাপোড়ন দেখা দিয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট পরিবহন শ্রমিক সংগঠন কোনেভাবেই পেরে উঠছে না অতিব প্রভাব দেখানো এই মিডিয়াকর্মীদের সাথে। এমনকি ট্রাফিক বিভাগও যেনো অসহায়। এবিষয় সম্পর্কিত তথ্যাদি জানতে গত কয়েকদিন ধরে অনুসন্ধানে যা জানা গেলো, তা শুনে আক্কেলগুড়ুম অবস্থা!

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রের দাবি, বরিশাল নগরী এবং নগরী থেকে বাইরে যাওয়া এবং আসা অন্তত ১২’শ মাহিন্দ্র ও সিএনজি নিয়ন্ত্রণ করে বরিশাল জেলা সিএনজি ও অটোরিকশা মালিক সমিতি ইউনিয়ন। রেজিস্ট্রিভুক্ত ইউনিয়নটি তাদের নিয়ন্ত্রিত গাড়িগুলো দেখভাল করার পাশাপাশি প্রতি গাড়ি থেকে মাসে বিশেষ অঙ্কের টাকা উত্তোলন করে শ্রমিক তহবিল তৈরী করে।
বিভিন্ন সময়ে দুর্যোগ এবং দুর্ঘটনায় আহত অথবা নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে ওই তহবিল থেকে অর্থসহায়তা দেয়া হয়। পাশপাশি শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষে বিভিন্ন পয়েন্টে থাকা শ্রমিকদের বেতন অনুসারে মাসিক পারিশ্রমিক দেয়া হয়। যতোটা জানা গেলো, ট্রাফিকদের সহায়তায় এই শ্রমিকদেরও ভুমিকা রয়েছে। মিডিয়ার একটি অংশ মাহিন্দ্র ও সিএনজি এবং অটোচালিত মোটরযান থেকে শ্রমিক ইউনিয়নের ব্যানারে অর্থ উত্তোলনের বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারছে না।

অভিযোগ রয়েছে, এই টাকা উত্তোলনের কারণে শ্রমিক ইউনিয়নের কাছে আর্থিক সুবিধা চেয়ে দীর্ঘদিন ধরে বায়না ধরেছিলো। কিন্তু সাড়া না মেলায় প্রথমে তারা কোন গাড়ি ধরলেই সুপারিশ রাখতেন, এবং গাড়ি মালিকপক্ষ থেকে আর্থিক সুবিধা নিতেন। এখন প্রতিদিন সুপারিশ নয়, বরং তাদের পত্রিকা এবং ঢাকার মিডিয়ার প্রতিনিধিত্বকারী বিশেষ এই সংবাদকর্মীরা তাদের স্ব-স্ব অবস্থান থেকে শ্রমিক নেতৃবৃন্দের কাছে প্রকারান্তরে গাড়ি নাম্বারসহ একটি তালিকা ধরিয়ে দেয়. যাতে তাদের তালিকায় থাকা নম্বরধারী মাহিন্দ্র ও সিএনজি থেকে মাসিক চাঁদা উত্তোলন অথবা রিকুইজিশনের অন্তর্ভূক্ত করা না হয়।

ওই শ্রমিক নেতা জানান এবং বেশ কয়েকজন চালক স্বীকারও করেন, এরপর থেকেই সংবাদকর্মীরা তাদের সংশ্লিষ্ট মিডিয়ার স্টিকার এই গণপরিবহনগুলোর সামনে এবং পিছনে বিশাল আকারে সেটেঁ দেয়। মাঝেমধ্যে ট্রাফিক সার্জেন্টরা কাগজপত্র ত্রুটিপূর্ণ থাকায় ওই তালিকায় থাকা গাড়ি ধরলেই মিডিয়ার পরিচয়ে কখনো ওভার সেলফোনে শাসিয়ে কথা বলে গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার একধরনের হুমকি ছুঁড়ে দেয়। কোনো কোনো নাছোড়বান্দা সার্জেন্ট এই হুমকি উপেক্ষা করে ত্রুটিপূর্ণ কাগজ এবং রংসাইডে চালানোর অভিযোগে মামলা জুড়ে দেয়াসহ ধরে নিয়ে আসলে স্বয়ং সেই মিডিয়াকর্মীরা উপাস্থিত হয়ে যান। নিজের গাড়ি বলে ট্রাফিক বিভাগের প্রধান উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি)র কাছে নিজের পরিচয় এমনভাবে জাহির করে, যেনো তিনি বড়ো মাপের সাংবাদিক! সুতরাং সহানূভূতির চোখে গাড়িটি ছেড়ে দেওয়া এবং মামলার ক্ষেত্রে জরিমানার অঙ্ক হ্রাস করা হয়।

আবার শোনা গেলো, মাসের শেষে শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে মাসিক চাঁদার জন্য এধরনের গাড়ি আটকালেই আলোচনায় আসা এই সংবাদকর্মীরা নিজের পরিচয় দিয়ে কেনো গাড়ি ধরা হলো, তার কৈফিয়ত চান। পুলিশ ও শ্রমিকের একটি সূত্র জানায়, জেলা ও মেট্রো পুলিশের নৈশকালীন ডিউটিতে তাদের গাড়ি স্বল্পতায় রিকুজিশনের মাধ্যমে সিএনজি এবং অটোচালিত জান মাহিন্দ্র মাসিক চক্রবৃদ্ধি হারে প্রতিদিন অন্তত ৪০ টি প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে এই গাড়ি সংগ্রহের জন্য জেলা সিএনজি ও অটোরিকশা শ্রমিক সমিতি ইউনিয়নের দায়িত্বে কোন গাড়ি কোনদিন ডিউটিতে যাবে, তার তালিকা অনুসারে জেলা পুলিশ লাইনে পাঠানো হয়। সেক্ষেত্রে সংবাদকর্মীদের দেয়া তালিকায় থাকা গাড়ি ধরামাত্রই শুরু হয় ছাড়িয়ে নেওয়ার জোর-জবরদস্তিমূলক প্রভাব। একেতো বড় সাংবাদিক, তার ওপর কেউ নিজেকে ক্ষমতাসীন দলীয় শীর্ষ নেতার আত্মীয় আবার কেউ জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের একান্ত লোক হিসেবে প্রভাব দেখানোর ফলে মাসিক চাঁদা তো দূরের কথা, রিকুজিশনেও তাদের গাড়ি অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়না।

একেকজন সাংবাদিকের ২০ থেকে ১৫টি গাড়ি। আবার এমন সাংবাদিকও রয়েছেন, লিখতে গেলে কলম ভাঙ্গে অথবা ছবি তুলতে গেলে নিজের পরিচয় সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-দীক্ষার দৌড় কতখানি তা আপনা আপনি প্রকাশ পায়, এধরনের মিডিয়াকর্মীদের নামেও ৫/৭ টি গাড়ি রয়েছে। শ্রমিক ও ট্রাফিক পুলিশ একপর্যায়ে নিশ্চিত হয় প্রকৃত অর্থে গাড়িগুলোর মালিক তারা নন।মূলত শ্রমিকদের চাঁদা ও প্রশাসনের হাত থেকে রক্ষায় এধরনের সাংবাদিকরা বিভিন্ন মালিকের সাথে গাড়িপ্রতি একহাজার টাকা চুক্তিতে পুলিশ ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দের ভাষায় বিটমানি নিচ্ছেন। অর্থাৎ ব্যতিক্রমী চাঁদাবাজি। এই পন্থায় কোনো কোনো সাংবাদিক মাসে দশ থেকে পনেরো হাজার টাকা নিচ্ছেন অনেকেরই অলক্ষে। কাকতালীয়ভাবে খুঁজে পাওয়া গেলো এই তালিকায় থাকা একটি বেশ জনপ্রিয় একটি টিভি চ্যানেলের স্বনামধন্য এক সাংবাদিকের নাম। যার অনুকূলেও রয়েছে বেশ কিছু মাহেন্দ্র ও সিএনজি।
শ্রমিক নেতাদের দাবি, পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে যে, শ্রমিক ইউনিয়ন যেনো এখন দুই ভাগে বিভক্ত। একাংশের নেতৃত্ব দিচ্ছে মিডিয়ার একটি অংশ।

বাস্তবতাও সেকথা বলে। সড়কে দেখা যায় , যেসমস্ত গাড়িতে পত্রিকার স্টিকার রয়েছে, সেই গাড়িতে পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের স্টিকার নেই। অর্থাৎ মাসিক চাঁদা পরিশোধকারী মাহেন্দ্র ও সিএনজির সম্মুখভাগে তাদের নিজস্ব প্রতীক সম্বলিত স্টিকার দেখা যায়। বলা যায় এখন দুই কূল থেকে মাহেন্দ্র, সিএনজি ও অটোচালিত মোটরযান নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এই নিয়ে প্রায় সাংবাদিক ও সংশ্লিষ্ট শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সাথে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির অবতারণা ঘটে। মালিকপক্ষ থাকে দূরত্বে অথবা অন্তরালে। পরস্পর পরস্পরকে চাঁদাবাজ বলে আখ্যা দিচ্ছে।

বরিশাল জেলা সিএনজি ও অটোরিকশা শ্রমিক সমিতি ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক দুলাল বরিশালটাইমসকে জানান, তাদের সংগঠন রেজিস্ট্রেশনভুক্ত। এবং দেখভাল করার দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি শ্রমিকদের কল্যাণে তহবিল গঠনের জন্য মাসের একটি নির্ধারিত অঙ্কের টাকা মালিকপক্ষের কাছ থেকে নেয়া হয়। প্রায় ১২’শ গাড়ি নিয়ন্ত্রণ থাকলেও এখন একটি বৃহৎ অংশ গুটিকয়েক সাংবাদিক নিয়ন্ত্রণ করছে। ট্রাফিক বিভাগও এদের কাছে অসহায়।

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়. এই সাংবাদিক অংশের সাথে জেলা ও মেট্রো পুলিশের বেশ কয়েকজন শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে সখ্যতা থাকায় তারাও এদের পক্ষে ট্রাফিক বিভাগে সুপারিশ রাখার নজির রয়েছে। তাছাড়া ট্র্রাফিক বিভাগও এনিয়ে বাড়াবাড়ি করতে চায়না। কারণ তাহলেই “ট্রাফিক সার্জেন্টদের সাথে পরিবহন শ্রমিকদের” ঐক্যে শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে পত্রিকার প্রথম স্থানে গুরুত্বসহকারে ছাপিয়ে দেয়। অথচ গুটিকয়েক সাংবাদিকদের ব্যতিক্রমী এই চাঁদাবাজি নিয়ে কেনো হইচই নেই।

বিটমানির নামে এই চাদাবাজি শুধু মাহিন্দ্র ও অটোচালিত মোটরযানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে হলুদ অটোও নিয়ন্ত্রণ করছে একই ধারার সাংবাদিকরা। নিবন্ধনবিহীন হলুদ অটো শহরে চলাচল নিষিদ্ধ বিধায় শহরতলীর বিশেষ বিশেষ জায়গায় স্ট্যান্ড থেকে তা ছাড়া হচ্ছে গ্রামীণ জনপদে। সেই স্ট্যান্ড থেকেও চাঁদা দিতে হচ্ছে সাংবাদিক নামের প্রভাবশালী এই ব্যক্তিদের। অথবা সার্জেন্টরা যেনো না ধরে সেজন্যে এ খ্যাতেও চালু করেছে বিটমানি- মাসিক ৫’শ টাকা।

এপ্রসঙ্গে নগর ট্রাফিকের প্রধান পুলিশ সুপার পদমর্যাদার উপ-পুলিশ কমিশনার ডিসি জাকির হোসেন জানান, মিডিয়াকর্মীদের উৎপাতে শহরে গণপরিবহন নিয়ন্ত্রণ অনেকক্ষেত্রে ব্যহত হচ্ছে। বিটমানির নামে চাঁদাবাজির বিষয়টি তিনি শুনেছেন স্বীকার করে বলেন, এজন্য তিনি পদক্ষেপ নিয়েছেন, কোনো গাড়িতে পত্রিকার স্টিকার থাকলেও কোনো ছাড় নেই বলে তার অধীনস্থ সার্জেন্টদের একটি নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। কয়লা ধুলে ময়লা যায়না যেমন, তেমন সংবাদকর্মীরা এখন তাদের মিডিয়ার ব্যানার গণপরিবহন থেকে অপসারন শুরু করেছে বটে কিন্তু কোনো গাড়ি আটক করলে এমনভাবে সুপারিশ রাখছে, ছেড়ে না দিয়ে উপায় নেই। কারণ সর্বশেষ তাদের পক্ষে মিডিয়ার মূলধারার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সুপারিশ রাখছে।

5 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন