১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

গণমুখী সরকারের গণবিরোধী সিদ্ধান্ত!

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৬:০৬ অপরাহ্ণ, ০৩ জুন ২০২০

গণমুখী সরকারের গণবিরোধী সিদ্ধান্ত!  
✪___________আরিফ আহমেদ মুন্না।

করোনা আক্রান্ত হয়ে সরকারের প্রভাবশালী সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আমার কাছে খবরটা দুঃখের এবং সেইসঙ্গে সীমাহীন লজ্জারও বটে। কারণ, আমি যদি সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী হতাম তবে এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজনে আত্মহত্যা করতাম; তবুও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতাম না। দেশের স্বাস্থ্যখাতে বিগত বছরগুলোতে লাগামহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের যে মহোৎসব চলেছে এই ঘটনা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সরকারি হাসপাতালের দুরবস্থার নিদারুণ চিত্র ফুটে উঠেছে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে।

সরকারের প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী ও দেশের একজন নীতিনির্ধারককে চিকিৎসা দেওয়ার মতো দেশে আজ কোনো সরকারি হাসপাতাল তাহলে নেই! এ ঘটনায় এটাই প্রমাণিত হয়েছে। দায়িত্বশীল মন্ত্রী হয়েও সাধারণ মানুষের জন্য পর্যাপ্ত হাসপাতাল তৈরি করেননি, চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন করেননি! হয়তো ভেবেছিলেন, নিজ অসুস্থ হলে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি হবেন। অথবা ভেবেছিলেন, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া কিংবা লন্ডনে উড়ে গিয়ে সেখানের সেরা হাসপাতালে চিকিৎসা নেবেন সরকারি খরচে।

হয়তো এটাও ভেবেছিলেন, একান্তই যদি এদেশে চিকিৎসা নিতে হয় তবে কম্বাইন্ড মেডিকেল হসপিটাল (সিএমএইচ) তো আপনাদের জন্য ফ্রি আছেই। সরকারের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের জন্য সিএমএইচ ফ্রি, আপনাদের মতো ভিআইপি-ভিভিআইপিদের জন্য সিএমএইচ ফ্রি। কিন্তু সাধারণ মানুষ অসুস্থ হলে তারা কোথায় যাবে? ১৮ কোটি মানুষের জন্য দেশে কয়টা সিএমএইচ বানিয়েছেন? রাষ্ট্রের সেবক চাকর-কোতোয়ালদের চিকিৎসার জন্য এতো আয়োজন করলেন, অথচ রাষ্ট্রের আসল মালিক জনগণের জন্য কিছু নাই? শুধুই ফাঁকাবুলি আর আশ্বাস? যাদের ভাগ্যের উন্নয়ন করার অঙ্গীকার নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় এলেন সেই জনগণের জন্য তাহলে কী উন্নয়ন করলেন? উন্নয়নের মহাসড়ক দিয়ে তবে কি তাদের পরপারে পাঠাবেন?

ক্ষমতায় এসে আপনারা নাকি শিক্ষার উন্নয়ন করে ভাসিয়ে দিয়েছেন অথচ নিজের বাচ্চা সরকারি প্রাইমারি স্কুলে না পড়িয়ে পড়ান কিন্ডারগার্টেনে। উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠিয়ে দেন বিদেশে। লোকদেখানো অবকাঠামো উন্নয়ন করেছেন ঠিকই কিন্তু শিক্ষার মানোন্নয়ন করেননি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়িয়েছেন ঠিকই তবে বাড়াতে পারেননি শিক্ষার মান। জিপিএ-৫ আছে কিন্তু নেই সুশিক্ষা। এই নির্মম সত্যটা আপনারাও জানেন। আর জানেন বলেই নিজের ছেলেমেয়ে একটু বড় হলেই লেখাপড়ার জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছেন বিদেশে। এদিকে দেশে পাসের হার বাড়িয়ে দিনদিন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়াচ্ছেন। অথচ শিক্ষা শেষে নূন্যতম কাজ দিতে পারছেন না দেশের কোটি শিক্ষিত বেকারকে। চাকরির ইন্টারভিউ দিতে দিতেই অনেকে শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতিদের সরকারি চাকরির বয়সসীমা শেষ হয়ে যাচ্ছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে বিপথগামী হচ্ছে দেশের যুবসমাজ।

এটা অনস্বীকার্য যে, গত ১০ বছরে দেশের রাস্তাঘাট-ভবনসহ অবকাঠামোগত অনেক দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে। তবে সেই উন্নয়নকে কখনোই সুষম উন্নয়ন বলা যাবে না। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে আমি অন্তত মিথ্যাচার করতে পারবো না। দেশে উন্নয়ন হয়েছে বটে তবে সেটা সুষম নয়, অসম উন্নয়ন। দেশের নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর রাতারাতি উন্নয়ন হয়েছে। আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে দলীয় সাইনবোর্ড লাগানো বেশকিছু ব্যক্তি এবং তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। এর পাশাপাশি আরেকটা পুঁজিবাদী গোষ্ঠী, ধনিক ও দালাল শ্রেণীর উত্থান হয়েছে। মধ্যস্বত্ত্বভোগী আরও একটি মুনাফাখোর শ্রেণী ফুলেফেঁপে উঠে আজ পরগাছা থেকে রীতিমতো মহীরুহ-বটবৃক্ষতে পরিনত হয়েছে। পক্ষান্তরে দেশের নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত এই তিন শ্রেণীর শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের কার্যত তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। বরং তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। অথচ সেই অনুযায়ী তাদের আয় বাড়েনি। তাদের মাঝে বেড়েছে হতাশা এবং অনিশ্চয়তা।

অতীতের সরকার আর বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার এক কথা নয়। তাঁর কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশার পরিমাণ যেমন অসীম, তেমনি আমারও। এর যুক্তিসংগত কারণও রয়েছে। পরিবার-পরিজন সব হারিয়ে নিজের মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে চার দশক আগে যে এতিম মেয়েটি এসেছিল জনগণের ভাগ্যোন্নয়ন করতে, পিতার রেখে যাওয়া অসমাপ্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণ করতে যে মেয়েটি ১৯ বার প্রত্যক্ষ হত্যাচেষ্টার পরেও পালিয়ে বিদেশে চলে যায়নি, যাকে নিয়ে আজকে গোটা পৃথিবী আইডল হিসেবে গর্ববোধ করে, সেই এতিম মেয়েটি আজ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় হ্যাটট্রিক করে চালকের আসনে থাকার পরেও যদি দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন না হয় তবে সেটা হবে জাতির জন্য সীমাহীন লজ্জা এবং চরম দুর্ভাগ্য।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গণবিরোধী সিদ্ধান্তের কারণে আমি নিজেই আজ সন্দিহান এই দেশ কি আসলেই বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা চালান নাকি অন্যকেউ? তাঁর পেছনে কি লুকিয়ে আছে সেই মীরজাফর আর খন্দকার মোশতাকের উত্তরসূরীরা? তারা কি কৌশলে তাকে দিয়ে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে নিচ্ছে? সামনে পেলে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে আজ এসব প্রশ্ন করতাম। বিশ্ববাজারে জ্বালানী তেলের দাম যেখানে রেকর্ড পরিমাণ কমেছে সেখানে তেলের দাম না কমিয়ে উল্টো গণপরিবহন ভাড়া ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হলো কার স্বার্থে? যে অজুহাতে ভাড়া বৃদ্ধি করা হলো সেই কথিত স্বাস্থ্যবিধি মানার খেসারত চাপানো হলো সাধারণ জনগণের মাথায়। করোনার দোহাই দিয়ে সরকারের কাছ থেকে অতিরিক্ত ৬০ পার্সেন্ট ভাড়া বৃদ্ধির অনুমোদন নিয়ে এখন জনগণের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে ১০০ পার্সেন্ট। ১০ টাকার ভাড়া রাতারাতি ডবল হয়ে ২০ টাকা হয়ে গেছে। এটা ছিল ওদের দিগুণ ভাড়া আদায়ের একটা কৌশল মাত্র। ৪০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব নাকি করোনা মহামারির আগেই রেডি করে রেখেছিল বিআরটিএ এবং পরিবহন মালিক সিন্ডিকেট।

দেশের ভিআইপি এবং উচ্চবিত্তরা নিজেদের ব্যক্তিগত গাড়িই ব্যবহার করেন। গণপরিবহনে চড়েন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষ। তাদের পাশের সিট ফাঁকা রেখে বসার জন্য আবার তাদের কাছ থেকেই অতিরিক্ত ৬০ পার্সেন্ট টাকা আদায় করার সিদ্ধান্ত দিলো কে? যারা গণপরিবহনে চড়েন এই করোনায় তাদের কারো আয় বাড়েনি, বরং কমেছে। অথচ তাদের কথা বিবেচনা না করে ৬০ শতাংশ বাড়ানোর অনুমোদন দিলেন। এদিকে পরিবহন দস্যুরা এই সুযোগে আদায় করা শুরু করলো ডবল ভাড়া। গণপরিবহনের ভাড়া না বাড়িয়ে জ্বালানী তেলের দাম কমালে কিংবা পরিবহন মালিকদের জন্য প্রণোদনা বা ঋণসুবিধার প্যাকেজ ঘোষণা করলে এই মাফিয়াদের কোনো অজুহাত থাকতো না। অথচ স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্ত দিয়ে আজ বর্ধিত ভাড়ার দায় চাপানো হলো সাধারণ জনগণের কাঁধে। সরকারি কর্মকতা-কর্মচারী ছাড়া গত ৬৫ দিনের লকডাউনে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের আয় প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে আগের চেয়ে দিগুণেরও বেশি। বিদ্যুৎ বিল, বাজারখরচ, যাতায়াত, বাড়িভাড়া ইত্যাদি চাপ মেটাতে সাধারণ মানুষ এখন দিশেহারা। এরমধ্যে ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতোই জনগণকে আরেকবার শুভঙ্করের ফাঁকি দিয়ে ভাড়াটা বাড়িয়ে নিলো পরিবহন দস্যুরা। একবার ভাড়া বাড়ালে সেই ভাড়া এদেশে আর কখনো কমেছে, এমন কোনো নজির আছে? কেউ দেখাতে পারবে? তাহলে কার স্বার্থে এই গণবিরোধী সিদ্ধান্ত?

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরে একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পাইলাম চোরের খনি।’ সেই বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশ পরিচালনা করতে এসে নিজেও কিছুদিন আগে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘এদেশে আমাকে ছাড়া আর সবাইকেই কেনা যায়।’ এতেই স্পষ্ট হয়েছে তিনি কাদের নিয়ে সরকার পরিচালনা করছেন। কারা থাকেন তাঁর চারপাশে। সরকারপ্রধানকে ব্যর্থ করার জন্য সরকারের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা মীরজাফর আর মোশতাকদের আজ চিহ্নিত করতে হবে তাকেই। কারা এসব গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে সরকারকে আস্থাহীন করছে? দলীয় রাজনীতি এবং আমলাতন্ত্রের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থেকে কারা সরকারকে দিকভ্রান্ত করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করছে? কাদের কারণে আজ বঙ্গবন্ধুকন্যার সকল অর্জন সাধারণ মানুষের কাছে ম্নান হয়ে যাচ্ছে? মীরজাফর-মোশতাকদের ঘেরাটোপ পেরিয়ে এসব গণদুশমনদের খুঁজে বের করে বিতাড়িত করার দায়িত্ব আজ আপনাকেই নিতে হবে হে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। নাহলে ওরা যে ভাইরাসের মতোই বংশবিস্তার করে একদিন এদেশে আরেকটা কলঙ্কিত আগস্টের জন্ম দেবে!

লেখকঃ আরিফ আহমেদ মুন্না
(সাংবাদিক, কলামিস্ট, কবি ও মানবাধিকার কর্মী)
প্রতিবেদক, দৈনিক সমকাল ও দি নিউ নেশন।
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বিমানবন্দর প্রেসক্লাব।
যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, বরিশাল বিভাগীয় কমিটি।
উপজেলা সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
সদস্য সচিব, বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ, বাবুগঞ্জ উপজেলা কমিটি।
৩ জুন, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ।

9 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন