২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

জনপ্রিয়তায় নেই, তবুও নৌকা বাগাতে চান জেবুন্নেসা!

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৮:২২ অপরাহ্ণ, ১৯ নভেম্বর ২০১৮

বরিশাল মহানগর ও সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত সংসদের বরিশাল-৫ আসন। এ আসনটি দক্ষিণাঞ্চলের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। তাই আসনটির দিকে নজর সব রাজনৈতিক দলের। ভোটের পরিসংখ্যান বলছে- আসনটি বিএনপির ঘাঁটি। শুধু সংসদ নিবার্চনে নয়, সিটি ও অন্যান্য স্থানীয় নিবার্চনেও পাল্লা ভারী বিএনপির দিকে। মাঝে বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও ব্যক্তি ইমেজ কাজে লাগিয়ে মেয়র পদে জয় ছিনিয়ে নেন আওয়ামী লীগের শওকত হোসেন হিরন। কিন্তু ২০১৩ সালের সিটি নিবার্চনে জনপ্রিয় মেয়র ‘উন্নয়নের রূপকার’ হিরনকে হারিয়ে ‘জনবিচ্ছিন্ন’ আহসান হাবিব কামালের বিজয় প্রমাণ করে বিএনপির অবস্থান শক্ত।

তবে সংসদীয় আসনে সেই জয় আবারও ছিনিয়ে নেয় আওয়ামী লীগ। মেয়র নিবার্চনে পরাজিত হয়ে ২০১৪ সালে সংসদ নিবার্চনে এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন শওকত হোসেন হিরন। ক্ষমতায় থাকাকালীন তার আকস্মিক মৃত্যুতে স্ত্রী জেবুন্নেসা আফরোজকে উপ-নিবার্চনে মনোনয়ন দিলে তিনিও বিজয় লাভ করেন।

টানা দুই মেয়াদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ মযার্দার এবারও আসনটি ধরে রাখতে চায়। তবে সংসদ নিবার্চনে দলটির ফলাফল নির্ভর করবে কে দল থেকে মনোনয়ন পাচ্ছেন তার ওপর। তৃণমূল আওয়ামী লীগের দাবি তরুণ প্রজন্ম থেকে স্থানীয় কাউকে মনোনীত করলে আসনটি পুনরুদ্ধারে সহায়ক হবে।

অন্যদিকে বিএনপি চাচ্ছে পূবের্র বিজয় ফিরিয়ে আনতে। জাতীয় সংসদের ১২৩ নম্বর (বরিশাল-৫) নিবার্চনী এলাকাটিতে বিএনপি বরাবরই বড় ব্যবধানে জয়লাভ করে। ১৯৯১ সালের সংসদ নিবার্চনে বিজয়ী আবদুর রহমান বিশ্বাস স্পিকার থেকে রাষ্ট্রপতি হলে উপ-নিবার্চনে বিএনপির বতর্মান যুগ্ম-মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার প্রথমবারের মতো নিবাির্চত হন। ১৯৯৬ সালের দুই সংসদ নিবার্চনেই রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের ছেলে নাসিম বিশ্বাস নিবাির্চত হন। ১৯৯৮ সালে তার আকস্মিক মৃত্যুর পর উপ-নিবার্চনে আবার সরোয়ার নির্বাচিত হন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালের নিবার্চনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন তিনি এবং পরে সিটি মেয়রও হন।

২০০৮ সালের জাতীয় নিবার্চনেও চতুথর্বারের মতো নিবাির্চত হন মজিবর রহমান সরোয়ার। তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক সেনা কমর্কর্তা জাহিদ ফারুক শামিম ভোট পাওয়ার দিক থেকে দলের অবস্থান অনেকটাই পাল্টাতে পেরেছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামিম মাত্র ৬ হাজার ভোটে হারেন।

সিটি নির্বাচনে হেরে যাওয়া হিরন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হন। ১৯৭৩ সালের পর এই আসনে এটা আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় বিজয়। ওই বছরই তার আকস্মিক মৃত্যুর পর উপ-নিবার্চনে হিরনের স্ত্রী জেবুন্নেসা আফরোজ নির্বাচিত হন।

আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্রগুলো বলছে- জেবুন্নেসার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও দূরদশির্তার অভাবে শুরুতেই হোঁচট খেতে হয় তাকে। স্বামীর অনুসারীদের বেশির ভাগই তাকে ছেড়ে এখন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর কাছে ভিড় জমিয়েছে। এক সময় হাসানাতকে গুরু মানলেও মেয়র নিবাির্চত হয়েই হিরন পাল্টে যান। দু’জনের মধ্যে তৈরি হওয়া সেই দূরত্ব ও প্রকাশ্য দ্ব›েদ্বর অবসান ঘটিয়েছেন জেবুন্নেসা। তবে এর নেপথ্যে রয়েছে নিবার্চনে জেবুন্নেসার দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা।

এমন বাস্তবতায় একাধিক নেতা-কর্মী এই সাংসদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন- বিগত সময়ে তিনি নির্বাচয়ে জয়লাভের পরে নেতা-কর্মীদের কোন খোঁজ-খবর রাখেননি। এমনকি কেউ তার কাছে গিয়েও সহযোগিতা পাননি।

তাছাড়া তিনি সদর আসনের জনগণের উপকারে আসার উদাহরণ নেই বললেই চলে। বরং কেউ কেউ তার কাছে গিয়ে সহযোগিতা চাইলে তাদেরও বিমুখ করার একাধিক অভিযোগ রয়েছে জেবুন্নেছার বিরুদ্ধে। যে কারণে তার কাছে এখন আর নেতাকর্মীরা ভিরছে না।

ফলে জেবুন্নেছা অনেকাংশে জনবিচ্ছিনা হয়ে পড়ে ‘এখন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ ওপর ভর করে মনোনয়ন বাগাতে চাইছেন।

যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করে জেবুন্নেসা আফরোজ বলেন- শওকত হোসেন হিরনের মৃত্যুর পরই দলীয় সভানেত্রীর হাত ধরে তার আওয়ামী লীগে পদাপর্ণ। দীর্ঘদিন বরিশাল আওয়ামী লীগে পূণার্ঙ্গ কমিটি না থাকায় সাংগঠনিক অনেক প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। তবে ২০১৬ সালে কমিটি গঠনের মাধ্যমে তা দূর হতে শুরু করে। এখন বরিশাল আওয়ামী লীগ বিগত যে কোনো সময়ের তুলনায় শক্তিশালী। সংসদ সদস্য হওয়ার পর এই চার বছরের রাজনৈতিক কমর্কান্ড তার একটা অবস্থান তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিকভাবেও তিনি এখন প্রতিষ্ঠিত। তাছাড়া তিনি চার বছর সংসদ সদস্য হিসেবে জনগণের জন্য যে কাজ করেছেন তাতে দলে ভাবমূতির্ উজ্জ্বল হয়েছে। বিশেষ করে তার কোনো কমর্কান্ডে দল ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা লজ্জাজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি।

মনোনয়নের ক্ষেত্রে শতভাগ আশাবাদী জেবুন্নেসা আফরোজ বলেন- তার উন্নয়ন ও ইমেজের কথা বিবেচনা করে দলনেত্রী তাকে পুনরায় মনোনয়ন দেবেন বলে আশা করেন।

তবে স্বাধীনতার পর প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনে এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়ী হতে পারেননি।

এর কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে- স্বাধীনতার পর এই আসনে স্থানীয় কোনো প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন পাননি। যারা পেয়েছেন তারা বরিশালের বাইরের। ফলে নিবার্চনে ফলাফল ঘোষণার পর তাদের আর মাঠে পাওয়া যায়নি। নিবার্চন পরবর্তি সহিংশতায় অনেক কর্মী মামলা হামলার স্বীকার হয়েছেন। তাদের খোঁজ নেননি পরাজিত প্রার্থী। তৃণমূলের কর্মীদের কখনই খোঁজ রাখেননি মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। পাশাপাশি সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে ভোটের ফলাফলে সব সময়ই আওয়ামী লীগ পিছিয়ে ছিল। কারণ প্রার্থীরা তৃণমূলের সঙ্গে তেমন কোনো যোগাযোগ রক্ষা করেননি।

কিন্তু এবারই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রচার ও প্রকাশনা কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন রিপন ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে তিনি ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রায় ৮০ হাজার দুস্থ নারী ও পুরুষকে আর্থিক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে সহযোগিতা দিয়েছেন। উপকারভোগীদের ৯০ ভাগই নারী। প্রায় ৩০ হাজার প্রবীণ নারী-পুরুষের চোখের চিকিৎসা করিয়েছেন। আড়াই হাজার মেধাবী গরিব শিক্ষার্থীকে আসছে এসএসসি পরীক্ষার ফরম পুরনের সম্পূর্ণ টাকা দিয়েছেন। এভাবে তিনি নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করে যাচ্ছে। একান্ত ব্যক্তিগত অনুদানে তিনি এক লাখ পরিবারকে সহযোগিতা করেছেন। সদরের ১০টি ইউনিয়নে তিনি দলীয় নেতাকর্মী আর সাধারণ ভোটারদের নিয়ে উঠান বৈঠক করেছেন। প্রতিটি বৈঠকে হাজার হাজার নারীরা অংশ নিয়েছেন। তারা বলছেন, জনপ্রতিনিধি না হয়েও সালাহউদ্দিন রিপন যেভাবে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তিনি নৌকার প্রতীক নিয়ে এ আসনে নিবার্চনে আসলে বিপুল ভোটে জয়ী হবেন।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘এসআর সমাজকল্যাণ সংস্থা’র উদ্যোক্তা সালাহউদ্দিন রিপন বরিশালটাইমসকে বলেন- ‘পারিবারিকভাবেই আমরা আশি দশক থেকে দুস্থদের সহযোগিতা করে আসছি। দুই বছর ধরে আমি নিজেই দুস্থ নারী-পুরুষদের আর্থিক, শিক্ষা আর চিকিৎসায় সহযোগিতা করছি। এই সময় প্রায় এক লাখ লোককে আমি কোন না কোনভাবে সহযোগিতা করেছি।’

বরিশাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ও সদর উপজেলার চেয়ারম্যান এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টুও এ আসনে মনোনয়ন চাইছেন। বিগত জাতীয় ও সিটি নির্বাচনে মুখ্য ভুমিকা পালনকারী এই নেতা দলীয় সকল কমর্সূচিতে অংশ নিচ্ছেন।

মনোনয়ন প্রসঙ্গে রিন্টু বলেন- আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা চাইলে নির্বাচন করবেন। সব কিছুই নির্ভর করে দলীয় সভানেত্রীর ওপর। তবে দীর্ঘদিন থেকে দলের হয়ে রাজনৈতিক অভিভাবক আলহাজ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর নির্দেশে সদর উপজেলার সব ইউনিয়নবাসীর জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।

বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলালও মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি বলেন- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্য কাজ করছেন। তার রাজনৈতিক অভিভাবক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও দলীয় সভানেত্রী যা সিদ্ধান্ত দেবেন, তাই তিনি মাথা পেতে নেবেন।

মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম এর আগে একাধিকবার দলীয় মনোনয়ন পেয়েও জিততে পারেননি। এমনকি বরিশালের বাইরে তার জন্মস্থান মুন্সিগঞ্জে নির্বাচন করেও হেরেছেন। তবু হাল না ছেড়ে জাতীয় দিবসগুলোতে বরিশালে আসছেন, কমর্সূচিতে অংশ নিচ্ছেন।

বরিশালে বেশি থাকেন না এ কথা স্বীকার করে মাহবুব উদ্দিন বলেন- তিনি নিয়মিত এলাকা ও এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন- প্রধানমন্ত্রী মনোনয়নের ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত দেবেন তাই মাথা পেতে নেবেন।

বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় রয়েছেন দলের যুগ্ম-মহাসচিব বরিশাল মহানগর বিএনপির সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার ও যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ অন্তত ১২ জন নেতা।

কিন্তু নেতা-কর্মীদের ধারনা শক্তিশালি দুই নেতার মধ্যে একজন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবেন।

সেখানে আ’লীগ থেকে জেবুন্নেসার মত দুর্বল অর্থাৎ জনবিচ্ছিন্ন প্রার্থী তাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ধোপে না টেকার সম্ভবনা বেশি বলে মনে করছে রাজনৈতিক বোদ্ধরা। কারণ তাদের মতে এবারের নির্বাচন আ’লীগ বিএনপির জন্য বড় ধরনের একটি চ্যালেঞ্চ। সরোয়ার বা আলালের বিপরীতে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হলে আসনটি ছাড়া হওয়ার সম্ভবনা বেশি।

ফলে এই আসনে জেবুন্নেছার বিকল্প সালাউদ্দিন রিপন বা সাইদুর রহমান রিন্টুর মত জনপ্রিয় প্রার্থীকে মনোনীত করা জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে।’

অবশ্য হাইকমান্ডও এই বিষয়টি ইতিমধ্যে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।’

6 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন