২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

সংসদ নির্বাচন : বরিশালে বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাইছেন ১৭৮ নেতা

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৫:১৭ অপরাহ্ণ, ১৯ নভেম্বর ২০১৮

নির্বাচনী রাজনীতির মনোনয়ন পর্বে একের পর এক চমকের ঘটনা ঘটছে বিএনপি’তে। বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় থাকা ২১ আসনে মনোনয়ন প্রার্থী হিসেবে মোট ২১৪ জন নেতা দলীয় মনোনয়নের আবেদন ফরম কিনলেও শেষ পর্যন্ত জমা দিয়েছেন ১৭৮ জন। টানা প্রায় ১০ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা এই দলটির মনোনয়নের রাজনীতি প্রশ্নে এবার বরিশালে যেসব ঘটনা ঘটছে তাতে এটা নিশ্চিত যে বুঝে শুনেই পা’ ফেলছেন দলটির নেতারা। পরিস্থিতি এমন যে কাউকে খুশি রাখা কিংবা খুশি করা নয়, স্রেফ জয়ের লক্ষ্য নিয়েই চলছে সব আয়োজন পরিকল্পনা। তবে এসবের মধ্যেও বেশ কিছু জটিলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে দলটিকে। মামলা আর দন্ডাদেশ সংক্রান্ত জটিলতায় অন্ততঃ ৩টি আসনে যোগ্য প্রার্থী প্রশ্নে সংকটে আছে দলটি। একইভাবে পিরোজপুর-১ আসনে জামায়াত নেতার সম্ভাব্য মনোনয়ন নিয়েও দেখা দিয়েছে ঝামেলা। এখানে জামায়াতের কাউকে মনোনয়ন না দেয়ার দাবীতে একাট্টা হয়ে মাঠে নেমেছে জেলা বিএনপি’র নেতারা।

ওয়ান ইলেভেন কালীন সময়ে সংস্কারে যাওয়ার কারনে মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় বিএনপি’র রাজনীতিতে অনেকটাই কোনঠাসা ছিলেন বরিশাল-১ আসনের সাবেক এমপি জহিরুদ্দিন স্বপন, বরিশাল-২ আসনের সাবেক এমপি শহিদুল হক জামাল, বরগুনা-২ আসনের সাবেক এমপি নূরুল ইসলাম মনি, পটুয়াখালী-২ আসনের সাবেক এমপি শহিদুল আলম তালুকদার এবং ভোলা-৩ আসনের সাবেক এমপি মেজর (অবঃ) হাফিজসহ আরো বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতা। মাত্র ক’দিন আগেও এদের অধিকাংশের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নানা সংশয় সন্দেহ ছিল তাদের নির্বাচনী এলাকাসহ দক্ষিনের বিএনপি’র রাজনীতিতে। তবে এবার শুরু থেকেই এরা এবং ঝালকাঠী-২’র সাবেক এমপি ইলেন ভুট্টো ও ভোলা-৪’র সাবেক এমপি নাজিম উদ্দিন আলমসহ আরো বেশ কয়েকজনের অনূকুলেই যেন বইছে হাওয়া। দলীয় মনোনয়ন ফরম কেনা ও জমা দেয়ার সময়ও এদেরকে দেখা গেছে ফুরফুরে মেজাজে। বিষয়টি সর্ম্পকে আলাপকালে শহিদুল আলম তালুকদার বলেন, ‘দলের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশেই মনোনয়ন দাখিল করেছি। এখন তারা কি করবেন সেটা তাদের সিদ্ধান্ত।’ বিএনপি’র কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক এমপি বিলকিস জাহান শিরিন বলেন, ‘কারা মনোনয়ন পাবেন না পাবেন তা পরিস্কার নয়। তবে যতদূর জানি নির্বাচনে জয় পরাজয়ের সাথে দলের অস্তিত্ব জড়িয়ে থাকায় কাকে প্রার্থী করা হলে দল জিতবে সেদিকেই বেশী গুরুত্ব দিচ্ছেন নীতি নির্ধারকরা।’

বিএনপি’র ভোটের ঘাটি হিসেবে পরিচিত বরিশাল-৫ (সদর) আসনে বহু বছর ধরে একাধিপত্য বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সাবেক এমপি মজিবর রহমান সরোয়ারের। পরপর ৪ বার এমপি, সাবেক মেয়র এবং সাবেক হুইপ তিনি। আসন্ন নির্বাচনে তাকেই মনোনয়ন দেবে দল এমনটাই ধারনা ছিল সবার। কিন্তু হঠাৎ করেই এই আসনের বিপরিতে দলীয় মনোনয়নের আবেদন ফরম ক্রয় এবং জমা দিয়ে ঝড় তুলেছেন বিএনপি’র আরেক যুগ্ম মহাসচিব সাবেক এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। একসময় বরিশাল-২ আসনের এমপি ছিলেন আলাল। ২০০৮’র নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন ঢাকা-১৩ আসনে। সেই দু’টি বাদ দিয়ে হঠাৎ বরিশাল-৫ আসনের জন্যে তার দলীয় মনোনয়ন চাওয়ার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে সকলকে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বিএনপি’র এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ‘হাই-কমান্ডের গ্রীন সিগন্যাল পেয়েই তিনি এই আসনে মনোনয়ন চেয়েছেন।’ জানতে চাইলে আলাল বলেন, ‘আমার জন্ম এবং বেড়ে উঠা সবই বরিশাল নগরীতে। একসময় আমি জেলা বিএনপি’র সাধারন সম্পাদকও ছিলাম। রাজনীতির প্রথম পাঠ থেকে শুরু করে বরিশালই আমার মূল ঠিকানা। আমি আবার সেই ঠিকানায় ফিরতে চাই। এজন্যেই বরিশাল-৫এ’ মনোনয়ন চেয়েছি।’
বরিশাল-৫’র জন্য আলাল এবং সরোয়ার ছাড়াও মনোনয়ন চেয়েছেন ১৩ জন নেতা। এদের মধ্যে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন, সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামাল, বরিশাল দক্ষিন জেলা বিএনপি’র সভাপতি এবায়েদুল হক চানসহ প্রায় ৯জনই নাকি সরোয়ারকে বাদ দিয়ে অন্য যে কাউকে মনোনয়ন দেয়ার দাবী জানাবেন কেন্দ্রের কাছে।

বিষয়টি সর্ম্পকে সাবেক মেয়র কামাল বলেন, ‘বরিশালে বিএনপি’র দক্ষ এবং যোগ্য অনেক নেতা আছে। তাছাড়া ৩০/৩২ বছর ধরে একই দৃশ্য দেখছে সবাই। মাঠের নেতা-কর্মীরা এবার পরিবর্তন চায়।’ মনোনয়ন নিশ্চিতের লড়াইয়ে বসে নেই সরোয়ারও। বরিশালে এসে চেষ্টা করছেন জেলা-মহানগর-ইউনিয়ন এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের কাছ থেকে পর্যন্ত তাকে মনোনয়ন দেয়ার রেজুলেশন নেয়ার। এসব তিনি জমা দেবেন ঢাকায়। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জেলা বিএনপি’র এক নেতা বলেন, ‘এই পদ্ধতি বোধহয় এবার আর কাজ করবেনা। কারন এসব ইউনিট কমিটি যে তার করা এবং পদ-পদবীতে তার লোকজনই বসা তা জানে কেন্দ্র। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে সর্বশেষ সিটি নির্বাচনে তার ভুমিকা ভালভাবে নেয়নি হাই কমান্ড। নির্বাচনে বিএনপিকে হারানো হবে সেটা সবাই জানতো কিন্তু তাই বলে তিনি (সরোয়ার) মাঠ ছেড়ে দেবেন তা কেউ কল্পনাও করেনি। বিষয়টি সর্ম্পকে আলাপকালে মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, ‘দলীয় মনোয়নন যে কেউ চাইতে পারে। দল কাকে প্রার্থী করবে সেটাই বড় ব্যাপার। আমি এ ব্যাপারে আশাবাদী।’

পিরোজপুর-১ আসনে বিএনপি নাকি জামায়াতের কাউকে দেয়া হবে মনোনয়ন তা নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। নির্বাচনী এলাকা পূর্নবিন্যাসের আগে এই আসনে এমপি ছিলেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে বর্তমানে আমৃত্যূ কারাদন্ড ভোগরত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। ২০০৮’র নির্বাচনের আগে সাঈদীর নিজের এলাকা ইন্দুরকানী উপজেলা আলাদা করে দেয়া হয় পিরোজপুর-১ আসনে। সেখানে তার এক ছেলে মাসুদ সাঈদী বর্তমানে উপজেলা চেয়ারম্যান। এই মাসুদ সাঈদী ও তার আরেক ভাই শামিম সাঈদী পিরোজপুর-১ এবং ২ আসনে মনোনয়ন চাওয়ায় বেধেছে জটিলতা। পিরোজপুর জেলা বিএনপি’র সাধারন সম্পাদক আলমগীর হোসেন এবং স্বরুপকাঠী উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি ফখরুল আলম বলেন, ‘কোন অবস্থাতেই পিরোজপুর-১ আসনে বিএনপি ছাড়া অন্য কোন দলের প্রার্থী মানবো না আমরা। নির্বাচনী এলাকা বদলে যাওয়ায় আগের সেই পরিস্থিতিও নেই। ইন্দুরকানী বর্তমানে পিরোজপুর-২’র অধীন। প্রয়োজনে সেখানে তাদের মনোনয়ন দেয়া হোক। পিরোজপুর-১এ’ নয়। সর্বশেষ পাওয়া খবরে জানা গেছে, শনিবার রাজধানী ঢাকায় বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করেছেন পিরোজপুরের বিএনপি নেতারা। সেখানেও একই দাবী জানানো হয়েছে কেন্দ্রের কাছে।

ভোলা-৩ ও পটুয়াখালী-২’এ’র সাবেক দুই এমপি দলের প্রভাবশালীনেতা যথাক্রমে হাফিজ ইব্রাহিম এবং শহিদুল আলম তালুকদার ও বরিশাল-২ আসনে ২০০৮’র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করা সরফুদ্দিন সরদার সান্টু বিএনপি’র মনোনয়ন পাচ্ছেন এটা ছিল প্রায় নিশ্চিত। কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছ থেকেই মূলতঃ মিলেছিল এমন গ্রীন সিগন্যাল। তবে মামলা এবং দন্ডাদেশ সংক্রান্ত জটিলতার কারনে এরা শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হতে পারবেন কিনা তাই নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সংশয়। বিএনপি’র একাধিক সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, এদের মনোনয়নে ঘাপলা দেখা দিলে কপাল খুলে যেতে তাদেরই স্ত্রী-দের। সেরকম আগাম প্রস্তুতও নিয়ে রেখেছেন হাফিজ এবং শহিদুল। তাদের স্ত্রী বিএনপি’রই দুই নেত্রী যথাক্রমে মাফরুজা সুলতানা এবং সালমা আলমের নামেও দলীয় মনোনয়নের আবেদন ক্রয় ও জমা দেয়া হয়েছে দলীয় কার্যালয়ে। সাবেক এমপি শহিদুল আলম বলেন, ‘নির্বাচন করতে না পারার মতো কোন আইনী জটিলতা দেখছিনা। তবু যদি সমস্যা হয় তো আমার স্ত্রীকে মনোনয়ন দেয়ার আবেদন জানাবো।

সেক্ষেত্রে দল কোন আপত্তি করবে বলে মনে হয়না।’ অপরদিকে হাফিজ ইব্রাহীম বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে থাকা রায়ের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। অতএব আমার প্রার্থী হতে কোন বাঁধা নেই।’ আইনী জটিলতায় সরফুদ্দিন সান্টু’র প্রার্থীতা অনিশ্চিত হলে সবচেয়ে বেশী লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা সাবেক এমপি শহিদুল হক জামাল’র। ওয়ান ইলেভেন কালীন সময়ে সংস্কারে গিয়ে দলীয় কর্মকান্ড থেকে দূরে থাকা এই জায়ান্ট নেতা সেক্ষেত্রে নিশ্চিত মনোনয়ন পেতে পারেন বরিশাল-২ আসনে। আর তেমনটা হলে এখানেও শক্ত কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বীতার মুখে পড়বে ক্ষমতাসীন দল।

2 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন