২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

জ্বর নিয়ে এ কী কাণ্ড ঘটে গেল!

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০২:১২ অপরাহ্ণ, ১৭ এপ্রিল ২০২০

” মাস্টার বাড়ির ৪ জন করোনায় আক্রান্ত”।

*”বাড়ির সবাইকে এম্বুল্যান্স এ বরিশাল নিয়ে গেছে”।

* ” রুমা ঢাকা থেকে করোনা নিয়ে আসছে। একমাস ধরে সে অসুস্থ ছিল।”

* ” মাস্টার বাড়ির সবার শরীরে করোনা ভাইরাস পাওয়া গেছে।

*” সবার জামাকাপড় খুলে আগুনে পুড়ে দিয়ে গেছে ওরা।”

* মাস্টার বাড়ি লক ডাউন করে দিছে”।

*পুলিশে সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে।

* রাতে ওই বাড়িতে পুলিশ এসে ওষুধ দিয়ে গেছে।

গত ৪ দিন ধরে বহুল প্রচারিত গুজবগুলোর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখ করলাম। সাথে প্রকৃত ঘটনা এখানে ব্যক্ত করতে চাই, যাতে মানুষ কিছু ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে এবং দুনিয়াজুড়ে চলমান সংকটের মুহূর্তে নিজেরা সচেতন হতে পারে।

ঘটনা আমি প্রায় একমাস আগে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ আসি। বাড়ি আসার কয়েকদিন পর করোনা পরিস্থিতির অবনতির জন্য সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়া হয়।যার কারণে আমার আর ঢাকা ফেরা হয়নি।

গত ১২ এপ্রিল বিকেল থেকে আমার শরীরে হালকা জ্বর এবং কাশি দেখা দিলে আমি অনলাইনে এক ডাক্তারের সাথে কথা বলি। সে কিছু অষুধের নাম লিখে দেয়। যেহেতু আমার ছোট বাচ্চা আছে তাই চেয়েছিলাম জ্বর নিয়ে অপেক্ষা না করে প্রথমদিন থেকেই ব্যবস্থা নেই। আমি সুস্থ না থাকলে বাবুকে দেখাশোনা করব কিভাবে, এই ভাবনা থেকে অষুধগুলো আনানোর চেষ্টা করি।

কিন্তু মেহেন্দিগঞ্জ লকডাউন থাকায় আমাদের বাড়ি থেকে বাজারে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা ছিল না। অতি উৎসাহী কিছু মানুষ রাস্তায় গাছ ফেলে, কাঁটা দিয়ে বাজারে যাওয়া আসার পথ বন্ধ করে দেয় এবং এলাকায় গুজব ছড়ায় “যেই বাজারে যাচ্ছে পুলিশ পিটিয়ে আধামরা করে দিচ্ছে।”

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামে, আমার জ্বর, কাশির সাথে দুশিন্তাও বেড়ে চলে। তখন ভাবলাম পুলিশের সহযোগিতা নিলে কেমন হয়।

রাত ৯টার দিকে আমি মেহেন্দিগঞ্জ থানার ওসি সাহেবকে কল করে হেল্প চাইলে সে খুবই আন্তরিকতার সাথে সাড়া দেন এবং আমার কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য জেনে আশ্বস্ত করে বলেন, চিন্তা করবেন না, দেখি কি করা যায়। তিনি আমার কাছ থেকে ওষুধের নামগুলো লিখে নেন।

সে জানতে চাইলেন আমি আইইডিসিআর এর হটলাইনে কল করেছিলাম কিনা? আমি বললাম, না করিনি। জানতে চাইলেন আমি ঢাকা থেকে আসছি কিনা। আমি বাড়ি আসার তারিখ বললে সে বললেন, ১৪ দিন তো পার হয়ে গিয়েছে। তারপরেও দেখি কি করা যায়…

তার সাথে কথা বলার পর একঘন্টার মধ্যেই রাত দশটার দিকে বাড়িতে ওষুধ নিয়ে একজন হাজির। যাতে বাড়ির মানুষও তাজ্জব বনে যায়।

তিন দিন পর

আমার জ্বর কাশি একটু কমে আসে। মোটামুটি নিজের কাজ নিজেই করি, শুয়ে বসে থাকি না। এরকম সময়ে ১৫ এপ্রিল আচমকা আমাদের বাড়িতে সকাল ১১টার দিকে পিপিই পরা একটি টিম আসে। যা দেখে বাড়ির সবাই ভয়ে আতংকে কেঁপে ওঠে। ভয় আমিও পেয়েছিলাম কিন্তু বাবা -মা, বাচ্চাদেরকে সাহস দেয়ার জন্য নিজের মনে ভয় চেপে রেখে সাভাবিক থাকার চেষ্টা করলাম। আমি সামনে গিয়ে কথা বললাম। তারা আমার স্যম্পল নিয়ে গেলেন। এবং মুখে বললেন, আপনার লক্ষণে বোঝা যায় আলহামদুলিল্লাহ রেজাল্ট নেগেটিভ আসবে, টেনশন করবেন না।

এরপর তারা আমাদের বাগানে খড়পাতা জ্বেলে তাদের পরিহিত পিপিই আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন। এই ঘটনাটা রাস্তায় দাড়িয়ে অনেকে দেখছেন।

মেহেন্দিগঞ্জ এ গাড়ি বা এম্বুল্যান্স এর ব্যবহার খুব কম বলে পুরো মেহেন্দিগঞ্জ মুহুর্তেই ছড়িয়ে গেল মাস্টার বাড়িতে পুলিশ গেছে, করোনা পাওয়া গেছে, সবাইরে ধরে নিয়ে গেছে, দু একজন মরেও গেছে,,,,ইত্যাদি। আরও আরও নানান কথা পরের ৩টি দিন ধরে আমরা শুনতে থাকি। অসংখ্য ফোনকল আসতে থাকে বাড়ির প্রত্যেকের কাছে।

এতসব ঘটনার পরে গতকাল রাত ১০টার দিকে আমার টেস্ট এর রেজাল্ট জানানো হয়।

রেজাল্ট নেগেটিভ আসে, আলহামদুলিল্লাহ। এবং আমিও সুস্থ।

এই ঘটনায় আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সাথে মেহেন্দিগঞ্জ থানার ওসি সাহেবকে ধন্যবাদ জানাই। তার ব্যবস্থাপনায়ই সবকিছু এত সহজ এবং সুন্দরভাবে সম্পন্ন হল।

মেহেন্দিগঞ্জের মতো এমন একটি প্রত্যন্ত এলাকায় যেখানে অনেকেই জানেনা “করোনা” কি, অনেকেই বলে এটা বিদেশি অসুখ, আমাদের হবে না। অনেকেই বলে, বিদেশ থেকে ১০ লাখ কিট এনে ছেড়ে দিয়েছে। কিট মানে কীট-পতঙ্গ। বিদেশি কীট-পতঙ্গে করোনা ভাইরাসকে কামড়ে কামড়ে খেয়ে ফেলবে। যেখানে ‘করোনা’ আসছে বলে মানুষ করলা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে- আরও কত কি।

সেই মেহেন্দিগঞ্জে সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকার পরেও মাত্র ৩ দিনে আমার করোনা টেস্ট করা হল এবং রেজাল্টও পেলাম। আর আল্লাহর অশেষ রহমতে, আপনজনের দোয়ায় আমি পুরোপুরি ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ।

যারা এই সংকটের সময়ে আমার পাশে থেকেছেন, খোঁজ নিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং ভালোবাসা সবসময়ের জন্য। আল্লাহ সবাইকে এই মহামারি থেকে রক্ষা করুন। সকলকে ভালো রাখুন, এই দুঃসময়ের খুব দ্রুত অবসান হোক, আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে ক্ষমা করুন।

লেখক: লেখক।

3 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন