২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

ঝুঁকির মুখে সম্ভাবনা: ১৫ বছরে ৫৭৬ নৌদুর্ঘটনায় ১৮২২ প্রাণহানি

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৬:১১ অপরাহ্ণ, ২৭ ডিসেম্বর ২০২১

ঝুঁকির মুখে সম্ভাবনা: ১৫ বছরে ৫৭৬ নৌদুর্ঘটনায় ১৮২২ প্রাণহানি

নাঈম কামাল >> এক সময়ের নৌপথনির্ভর বাংলাদেশ গত কয়েক দশকেই বহুমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্ভাবনাময় অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তবে সময় ও ব্যয় সাশ্রয়ী হিসেবে আবহমানকালের যোগাযোগ ব্যবস্থা নৌপথ এখনও সমান জনপ্রিয়। বলা যায়- নানা পদক্ষেপের ফলে দিন দিন নৌপথে বাণিজ্যের বহুমুখী সম্ভাবনা বাড়ছেই। এর মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াতের সবচেয়ে নিরাপদ ও আরামদায়ক পথ হিসেবে দশকের পর দশক ধরেই জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে। স্বল্প ভাড়া, যানজট সমস্যা থেকে মুক্তি, পর্যাপ্ত পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা থাকায় নৌপথে যাত্রীর চাপ বেড়েছে অনেক বেশি। সবকিছু মিলিয়ে নৌবাণিজ্যের সম্ভাবনাময় পথ হিসেবে গুরুত্ব বেড়ে চলেছে। কিন্তু নৌপথ কেন্দ্রিক অপরাধ প্রবণতা আর দুর্ঘটনার সঙ্গে নাব্যসংকট দীর্ঘদিন ধরেই পিছু ছাড়ছে না। এতে যাত্রীদের ভয় ও আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথ।

প্রতিবছরে ছোট-খাট দুর্ঘটনার পাশাপাশি দেশবাসীর নজরে এসেছে নৌডুবিতে একের পর এক মৃত্যুর মিছিল। দুদিন আগে নদীর বুকে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড বিষয়টিকে আবারো আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। নৌখাতে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণকে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পর্যাপ্ত তদারকি না থাকা, কর্তৃপক্ষের দায়সার মনোভাব আর দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা না নেয়ার কারণেই বেড়েছে নৌদুর্ঘটনা। তাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, লঞ্চডুবির প্রায় প্রতিটি ঘটনায় একাধিক তদন্ত কমিটি হলেও তাদের দেয়া সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না। যদিও বিশেষজ্ঞদের এমন পর্যবেক্ষণের বিপরীতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক বলছেন, সব ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া হয়।

যাত্রীদের কল্যাণে কাজ করা একাধিক সংগঠনের নেতারা বলছেন, অদক্ষ কর্মী, ফিটনেসহীন নৌযান এবং অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণেই ঘটে চলেছে একের পর এক দুর্ঘটনা। তাদের ব্যাখ্যা হচ্ছে, কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, দায়িত্বে অবহেলা এবং দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের কারণে দুর্ঘটনার পরিমাণ বেশি। তাদের মতে, প্রতিটি লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার আগে ছাড়পত্র নিতে হয়। সবকিছু যদি নিয়ম মতো থাকে তাহলেই ছাড়পত্র দেয়ার কথা সংশ্লিষ্টদের। তবে দুর্ঘটনার পর তদন্ত রিপোর্টে দেখা যায় কোনোটির ফিটনেস ছিলো না, কোনোটির আগে থেকেই ইঞ্জিনে সমস্যা, কোনোটিতে ছিলো না পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা আবার কোনোটিতে নেই দক্ষ জনবল। এসব তদন্ত প্রতিবেদনই প্রমাণ করে কতটা দুর্নীতিপরায়ণ তারা।

নৌখাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একেবারেই ঢিলেঢালাভাবে চলছে নৌ সেক্টর। এখানে না আছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, না আছে নজরদার। ফলে ইচ্ছেমতো নৌযান পরিচালনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। যেকারণে দুর্ঘটনাও দিন দিন বাড়ছে। দুর্ঘটনা রোধে সুপারিশও বাস্তবায়ন হয় না। সবচেয়ে নিরাপদ এ যোগাযোগ ব্যবস্থায় নজরদারি সবচেয়ে কম। সড়ক খাতের উন্নয়ন বাজেটের তুলনায় নৌ খাত একেবারেই অবহেলিত। নদীগুলো রক্ষায়ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।

স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘সেভ দ্য রোড’ সূত্রমতে, গত ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত নৌপথে দুর্ঘটনায় ১৮৮ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আবার যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সালে এমন দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ছিল ৩১৩ জন। চলতি বছরের এপ্রিলে বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিউটের প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত ১৫ বছরে দেশের নৌপথগুলোয় ৫৭৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন এক হাজার ৮২২ জন, আহত হয়েছেন ৪১৯ জন এবং এখনও সন্ধান মেলেনি ৮৬৪ জনের। বেসরকারি সংস্থা কোস্ট বিডির গবেষণা অনুযায়ী, গত ২০ বছরে বাংলাদেশের নৌপথে বড় ধরনের ১২টি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন দেড় হাজারের বেশি মানুষ।

২০০০ সালের ২৯ ডিসেম্বর চাঁদপুরের ষাটনল এলাকায় মেঘনায় এমভি রাজহংসী লঞ্চডুবিতে ১৬২ জনের প্রাণহানি ঘটে। এর আগে ৩ মে চাঁদপুরের ষাটনলে সালাহউদ্দিন-২ যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবিতে প্রাণ হারান প্রায় ৪০০ যাত্রী। ২০০৩ সালের ৮ জুলাই এমভি নাসরিন-১ লঞ্চ ডুবিতে সরকারের হিসাবে প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয়শ। দুবছর পর ২০০৫ সালে একটি ফেরি ডুবে প্রাণ হারায় ১১৮ জন। এছাড়া ২০০৯ সালে কিশোরগঞ্জের মিঠামইনের দায়রা নদীতে ফেরি দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে ৪৭ জনের। একইসালে ভোলাগামী এমভি কোকো-৪ লঞ্চের দুর্ঘটনা ঘটে। বছর তিনেক পর ২০১২ সালে মুন্সীগঞ্জমুখী ২০০ যাত্রী নিয়ে নৌকাডুবি এবং মেঘনায় এমভি শরীয়তপুর-১-এর দুর্ঘটনা ঘটে। দুবছর পর ২০১৪ সালের এমএল পিনাক-৬ ও এমভি মিরাজ-৪-এর দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ১০৩ জন। ২০১৫ সালে এসে পদ্মায় ফেরি দুর্ঘটনায় ৬৮ জন প্রাণ হারান। ২০১৬ সালে কীর্তনখোলা নদীতে লঞ্চ দুর্ঘটনা, ২০১৯ সালে বঙ্গোপসাগরে ট্রলারডুবিতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। চলতি বছরের ৪ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ শহরের কয়লাঘাট এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চ এমএল সাবিত আল হাসান ডুবে ৩৪ জন প্রাণ হারান। এছাড়া গত ২৯ জুনে বুড়িগঙ্গায় ‘মর্নিং বার্ড’ লঞ্চডুবিতে ৩৩ জনের প্রাণহানি হয়। পরিসংখ্যানের দেখা যায়, এক বা দুই বছরের ব্যবধানে বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। ঘটনার পরই কেবলমাত্র জানা যায় দুর্টনাকবলিত লঞ্চের নানা নেতিবাচক তথ্য।

সূত্রমতে, স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি গেল অর্ধশকে দেশে কোনো নৌ শুমারি হয়নি। যে কারণে যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযানের কোনো পরিসংখ্যান নেই সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে। সরকারি হিসেবে, নৌ পরিবহন অধিদফতরে যাত্রী ও পণ্যবাহী মিলিয়ে নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি। বেসরকারি হিসেবে সারাদেশে চলাচলরত নৌযানের সংখ্যা ৬০ হাজারের বেশি। এর মধ্যে প্রতি বছর ফিটনেস পরীক্ষা করা হয় ৮ হাজারের। বাকিগুলো ফিটনেস ও রুট পারমিট ছাড়াই চলাচল করে।

নৌদুর্ঘটনা প্রতিরোধে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া হয় এমনটা উল্লেখ করে বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক বলছেন, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নৌযানের ক্রু সদস্যদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সব ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। প্রত্যেকটি দুর্ঘটনার তদন্ত করে এবং আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়। অথচ ২০২১ সালে প্রকাশিত বিআইডব্লিউটিসি’র একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১১ বছরে ৩৮৭ নৌযান ডুবির ঘটনা ঘটেছে। তবে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেনি বিআইডব্লিউটিএ। যে কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা বরাবরই ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে, নৌ দুর্ঘটনার জন্য সংশ্লিষ্টরা যেমন দায়ি ঠিক তেমনই যুগোপযোগী আইন না থাকাও বড় একটি কারণ। বাংলাদেশে বর্তমানে মাত্র একটি মেরিন আদালত রয়েছে, যেখান ‘ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স-১৯৭৬’ অনুসারে জাহাজ ও নৌযানের সংশ্লিষ্ট ত্রুটি ও অবহেলার অভিযোগগুলি নিষ্পন্ন করা হয়। এই আইনের আওতায় নৌযান দুর্ঘটনার জন্য দোষীদের শাস্তি পাঁচ বছরের জেল বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা। আইনকে যুগোপযোগী করার পাশাপাশি যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারলেই সমস্যা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ যাত্রী অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক কেফায়েত উল্যাহ চৌধুরী শাকিল বলেন, প্রতিটি দুর্ঘটনায় নিহতরা কাঠামোগত হত্যার শিকার। ভাড়া বাড়ানোর দাবি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে অথচ দীর্ঘদিনের দাবি ফিটনেসবিহীন নৌযান বন্ধ করা এবং নজরদারি বাড়ানোর বিষয়ে তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। যদিও এটি তাদের প্রধানতম দায়িত্ব ছিলো। তাদের অব্যবস্থাপনার কারণেই এ ধরনের ঘটনা বার বার ঘটছে। যা কাঠামোগত হত্যার সামিল। এ ক্ষেত্রে নৌযানের মালিক যতটা না দায়ি তার চেয়ে কোনো অংশে কম দায়ি নয় বিআইডব্লিউটিএ। কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর কর্তৃপক্ষের নানা অনিয়ম সবার সামনে আসে। তখন তড়িঘড়ি করে লোক দেখানো ব্যবস্থা নিয়ে দায় এড়াতে চায় তারা। এরপর আবারো সেই আগের অবস্থায় ফিরে যায় তারা। কেফায়েত উল্যাহ চৌধুরী বলেন, আমরা এসব বিষয়ে সবসময়ই কথা বলছি। বিভিন্ন দাবি তুলছি। তবে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হচ্ছে না। এসব নৌযানের ফিটনেসদাতাদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবাইকে তদন্ত করে দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে পারলেই এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না।

নৌসড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, একটি নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠনগুলো আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জনস্বার্থে নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নে কালক্ষেপনের কারণে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে পদক্ষেপগুলো খুব একটা দৃশ্যমান হচ্ছে না। সবার আগে নৌ সেক্টরে নজরদারি বাড়াতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, আমরা সব অনিয়ম, অব্যবস্থাপনাগুলো চিহ্নিত করেছি। নৌখাতের উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। নৌ দুর্ঘটনা রোধেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। সবকিছু জবাবদিহিতার মধ্যে আনার চেষ্টা চলছে। এতে করে ইচ্ছেমতো নৌযান পরিচালনার আর সুযোগ থাকবে না।

2 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন