২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

দীর্ঘ ৭০ বছরেও স্বীকৃতি পায়নি বন প্রজারা

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:৩২ অপরাহ্ণ, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

কাজী সাঈদ, কুয়াকাটা:: পটুয়াখালী বন বিভাগের কুয়াকাটা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ৭০ বছর ধরে বিনা বেতনে কাজ করার পরও স্বীকৃতি দেয়া হয়নি বন প্রজাদের। উল্টো অবৈধ দখলদার আখ্যা দিয়ে ভোগ দখলীয় জমি-বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদে নোটিশ দিয়েছে বনবিভাগ ও ভূমি প্রশাসন।

পাকিস্তান আমলে ৩৩ বনপ্রজাকে ৪একর করে জমি বরাদ্দ দিলেও সত্তর বছর পর বনবিভাগ এসব বন প্রজাদের বাড়িঘর ও ভোগ দখলীয় জমি থেকে উচ্ছেদে ষড়যন্ত্র করছে বলে বন প্রজাদের অভিযোগ। এনিয়ে বনবিভাগ ও ভূমি কর্তৃপক্ষের সাথে বন প্রজাদের বিরোধ চলছে। এমন পরিস্থিতিতে এসব ভূক্তভোগী বন প্রজারা বৈধতা পেতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।

কুয়াকাটা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বসবাসকারী বন প্রজা সূত্রে জানা গেছে, ১৯৪৫ ও ১৯৫০ সালের দিকে পাকিস্তান সরকার আমলে কুয়াকাটা সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার বিরান ভূমিতে বাগান সৃজন করার লক্ষ্যে কক্সবাজারের মহেষখালীর সোনাদিয়ায় সমুদ্র ভাঙনে সহায়-সম্বলহীন ২৩ পরিবার ও বরগুনার কাকচিড়া এলাকার ১০টি পরিবারকে বন সৃজন করার শর্তে ৪ একর করে জমি বরাদ্দ দেয় তৎকালীন মহিপুর বনবিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা গোলাম কাদের সিকদার। এরপর থেকে এসব বন প্রজারা বাড়িঘর নির্মাণ করে বসবাস এবং চাষাবাদ করার মাধ্যমে ভোগ দখল করে আসছে এসব বরাদ্দকৃত জমি।

বনবিভাগের শর্তানুযায়ী বন প্রজারা পটুয়াখালী জেলা ও বরগুনা জেলার কুয়াকাটা লেম্বুর চর, গঙ্গামতির চর, কাউয়ার চর, চর মৌডুবী, চর মোন্তাজ, সোনার চর, ফাতরার বনসহ বিভিন্ন স্থানে বনবিভাগের নির্দেশে কাকড়া চারা, গোলগাছ, কেওড়া, কড়াই, রেইনট্রি, নারিকেলসহ বিভিন্ন প্রজাতির চারা রোপন করে আসছে। এ কাজের জন্য বন প্রজাদের কোন পারিশ্রমিক দেয়া হয় না। বন প্রজাদের সৃজনকৃত বনের বয়স প্রায় ৬০-৬৫ বছর হয়ে গেছে। সৃজনকৃত এসব বনের অধিকাংশই সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেছে। ৩৩ বন প্রজা থেকে সন্তান ও নাতিসহ এখন ৬৭ পরিবার হয়ে গেছে।

বরাদ্দকৃত ৩৩ বন প্রজাদের মধ্যে বেশিরভাগই মারা গেছে। দু’য়েকজন বেঁচে থাকলেও তারা বয়সের ভারে এখন আর চলাফেরা করতে পারছে না। বন প্রজারা হিংস্র জীবজন্তুর সাথে লড়াই করে বিনা বেতনে বন পাহারা, বাগান সৃজন করার মাধ্যমে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বন বিভাগের নিয়ম মেনে প্রায় সত্তর বছর ধরে স্ত্রী সন্তান ও পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করে আসছে।

১৯৬৫ ও ১৯৭০ সালের জলোচ্ছ্বাসে এসব পরিবারের অনেকেই মারা গেছে। আবার কেউ কেউ বাগান সৃজন করতে গিয়ে বাঘের আক্রমনে মারা গেছে। জীবন যুদ্ধে লড়াই করা বনপ্রজারা পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে শান্তিতেই বসবাস করে আসছিলো। এতো বছর পর হঠাৎ করেই বনবিভাগ এসব বন প্রজাদের অবৈধ উল্লেখ করে বাড়িঘর ও চাষাবাদের জমি ছেড়ে দেয়ার জন্য বলে। বন প্রজারা কাগজ কলমে বৈধতা পেতে জনপ্রতিনিধি, বনবিভাগ, জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরে তাদের অবস্থান তুলে ধরে। দেশের বৈধ নাগরিক হিসেবে নিজেদের মৌলিক অধিকার আদায়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে আবেদনও করে বন প্রজারা।

কুয়াকাটা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বসবাসরত বন প্রজারা অবৈধভাবে বন দখল ও বন উজাড় করছে মর্মে উল্লেখ করে তাদেরকে উচ্ছ্বেদে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গত ৩ মার্চ ২০২০ প্রতিবেদন চেয়ে একটি চিঠি দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় কলাপাড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জগৎবন্ধু মন্ডল গত ৬ আগষ্ট ২০জনের নাম উল্লেখ করে তাদের ভোগ দখলীয় জমির স্ব-পক্ষীয় কাগজপত্র ও সাক্ষী প্রমাণসহ ৩ সেপ্টেম্বর সরেজমিনে তদন্তকালে উপস্থিত থাকার জন্য প্রত্যেককে নোটিশ প্রদান করে। স্থানীয় ভূমি প্রশাসন তদন্তও করেন।

বন প্রজাদের হেডম্যান আঃ কাদের, বন প্রজা আঃ সোবাহান, গনেশ চন্দ্র মিস্ত্রী, মৌলভী মোঃ জবেদ আলী, মোঃ মতিউর রহমান, নজীর মাঝি সহ একাধিক বন প্রজারা অভিযোগ করেন, তৎকালীন সময়ে খুলনা বনবিভাগের আওতাধীন মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা মোঃ গোলাম কাদের সিকদার অবৈতনিক বনপ্রজা হিসেবে ৩৩ জনকে নিয়োগ দেন। এ সময় বন সৃজন করার শর্তে বাড়িঘর নির্মাণ ও চাষাবাদ করার জন্য প্রত্যেক পরিবারকে ৪একর করে জমি প্রদান করেন। বন সৃজন ও পাহারার পাশাপাশি প্রায় ৭০বছর ধরে বসবাস করে আসছে তারা। ওই সময়ে বনবিভাগ থেকে তাদেরকে একটি টোকেন দেয়া হলেও ১৯৬৫ ও ৭০ সালের জলোচ্ছ্বাসে তা হারিয়ে যায়।

বন প্রজারা বলেন, এতো বছর পর বনবিভাগ তাদেরকে অবৈধ দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করে ভোগদখলীয় জমি ও বাড়িঘর ছেড়ে দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। বনপ্রজাদের অভিযোগ একদিকে তারা তাদেরকে অবৈধ দখলদার বলছে অপরদিকে বনবিভাগ তাদেরকে বন প্রজা হিসেবে উল্লেখ করে বন সৃজনের জন্য চিঠি দেয়া হচ্ছে। বন প্রজারাও এখনও বন সৃজন করে আসছেন। কাগজ কলমে তাদেরকে বৈধতার দাবীতে একাধিকবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে। এ সময় বৈধতা দেয়ার কথা বলে সাবেক রেঞ্জ কর্মকর্তা মোঃ হারুন-অর-রশিদসহ একাধিক কর্মকর্তারা দফায় দফায় মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। তারপরও বৈধতা দেয়া হয়নি তাদের। এ সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন ভূক্তভোগী বন প্রজারা।

এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা হয় মাঠ পর্যায়ের তদন্ত কর্মকর্তা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জগৎবন্ধু মন্ডল’র সাথে। তিনি বলেন, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সরেজমিনে তদন্তে দেখা গেছে, বন প্রজারা দীর্ঘ বছর ধরে এখানে বসবাস করে আসছে। বনবিভাগের বৈধ কোন কাগজপত্র দেখাতে না পারলেও নিজেদের বন প্রজা হিসেবে দাবী করেছে তারা। তাদের দাবী নামা সম্মিলিত তদন্ত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ঠ দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।

পটুয়াখালী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ আমিনুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, বন প্রজারা দীর্ঘ বছর বসবাস করে আসলেও তাদের স্ব-পক্ষে কোন কাগজপত্র নেই। আইন অনুযায়ী তারা অবৈধ ভাবে বসবাস করছে। তিনি আরও বলেন, বন প্রজারা জেলা প্রশাসক, বনবিভাগ ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বৈধতার জন্য আবেদন করেছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন।

3 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন