২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

‘নৌকার ছাদে জানাজা পড়ে লাশ ফেলা হতো সাগরে’

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৮:৪৩ অপরাহ্ণ, ২৮ মে ২০২০

বার্তা পরিবেশক, অনলাইন :: খোদেজা বেগমের সমুদ্রযাত্রার কাহিনী পুরোনো দিনের দস্যুজাহাজের ভয়ংকর অভিযানকেও যেন হার মানায়। যে নৌকায় তারা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে গিয়েছিলেন মালয়েশিয়ার উপকূল পর্যন্ত, সেটি একের পর এক ভয়ংকর সব ঘটনার শিকার হয়েছে। পথে তারা ঝড়ের কবলে পড়েছেন। নানান দেশের উপকূলরক্ষীরা তাদের তাড়া করেছে। খাবার আর পানির অভাবে প্রতিদিন মানুষ মরেছে নৌকায়। তাদের লাশ ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে সাগরে।

নৌকার বার্মিজ নাবিকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন রোহিঙ্গারা। সেখানে ধর্ষণ, খুন-খারাবির মতো ঘটনা ঘটেছে। ৫৪ দিন সাগরে ভেসে অবশেষে উপকূলে ফিরেছেন তারা। বাংলাদেশের টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবির থেকে টেলিফোনে দেয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে খোদেজা বেগম তার এই ভয়ংকর সমূদ্রযাত্রার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।

তিনি বলেন, ‘মেয়েটার নাম আমার মনে নেই। তবে তার কোন অসুখ ছিল না। আমাদের নৌকায় খাবার পানি ফুরিয়ে গিয়েছিল। তাই ও সাগরের নোনা পানি খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আমার সামনে ও মারা যাচ্ছিল। আমি এই ঘটনাটা ভুলতে পারি না। ওর ছিল চারটা ছেলে-মেয়ে। মা মরা ছেলে-মেয়েগুলোকে দেখে আমার বুক ভেঙ্গে যাচ্ছিল।’

খোদেজা বেগম ঠিক মনে করতে পারেন না, ঠিক কত তারিখে, কোথায় এই ঘটনা ঘটেছিল। কারণ প্রায় দুমাস ধরে যখন একটা বড় নৌকায় পাঁচশোর বেশি মানুষকে সাগরে প্রতিদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে হচ্ছিল, তখন তারা স্থান-কাল-দিন-তারিখের হিসেব হারিয়ে ফেলেছিলেন।

তিনি শুধু মনে করতে পারেন, এটি ঘটেছিল মালয়েশিয়ার উপকূল থেকে তারা ফিরে আসার পথে। নৌকার দোতলায় যে অংশটিতে মেয়েদের রাখা হয়েছিল সেখানে মেয়েটির তখন একেবারে শেষ অবস্থা। একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল। আর আবোল-তাবোল বকছিল।

খোদেজা বলেন, ‘নৌকার যে জায়গায় আমরা বসে ছিলাম, সেখানে পা সোজা করার উপায় পর্যন্ত নেই। গাদাগাদি করে বসে আমরা সবাই। প্রচন্ড গরম। আমি জানতাম এরপর মেয়েটার ভাগ্যে কী ঘটবে।’

খোদেজা বেগমের ছেলে নুরুল ইসলামের কাজ ছিল নৌকায় মারা যাওয়া লোকজনের জানাজা পড়া। কেউ মারা গেলে তার লাশ নিয়ে যাওয়া হতো একদম উপরে। সেখানে জানাজা পড়ানো হতো। তারপর লাশ ফেলে দেয়া হতো সাগরে।

তিনি বলেন, ‘মারা যাওয়ার পর লাশ নৌকার একদম উপরে নিয়ে গেল ওরা। ছেলে-মেয়েগুলোকে ওরা নিয়ে গেল নৌকার অপর পাশে। বড় মেয়েটির বয়স হবে ১৫/১৬, নাম শওকত আরা। পরেরগুলো একদম ছোট। ওদের হাতে বিস্কুট ধরিয়ে দিয়েছিল। আর অন্যদিকে তখন ওদের মায়ের লাশ ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছিল সাগরে।’

দুই মাস ধরে সাগরে ভেসে বেড়ানোর সময় এরকম আরও বহু মৃত্যু দেখেছেন খোদেজা বেগম। ভাগ্যক্রমে নিজে বেঁচে গেছেন, প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছেন টেকনাফের শরণার্থী শিবিরের পুরোনো ঠিকানায়, কিন্তু নৌকায় স্বচক্ষে দেখা এসব মৃত্যুর ঘটনা এখনো তাকে তাড়া করছে।

তিনি বলেন, ‘আমাদের নৌকায় কত মানুষ মারা গিয়েছিল কেউ জানেনা। কেউ বলছে ৫০ জন কেউ বলছে ৭০ জন। তবে আমি জানি অন্তত ১৬/১৮ জন মহিলা মারা গেছে। আর পুরুষ মারা গেছে তার চেয়ে বেশি।’ সূত্র: বিবিসি বাংলা

4 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন