২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

পটুয়াখালীর ৮ ইউনিটে বিএনপির কমিটি নিয়ে টালবাহানা

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৪:১০ অপরাহ্ণ, ০১ জানুয়ারি ২০২২

পটুয়াখালীর ৮ ইউনিটে বিএনপির কমিটি নিয়ে টালবাহানা

পটুয়াখালী প্রতিনিধি >> পটুয়াখালীর ৭টি উপজেলায় বিএনপির কমিটি গঠনে ব্যাপক অনিয়ম ও স্বজনপ্রিতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। দলের হাই কমান্ডের নির্দেশনা না মেনেই নিস্ক্রীয় এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত এমন লোকদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়াও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসকারীদেরও কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা হয়েছে।

গত ২৩ নভেম্বর পটুয়াখালী জেলা বিএনপি বাউফল উপজেলা, বাউফল পৌর, গলাচিপা উপজেলা, গালাচিপা পৌর, দশমিনা উপজেলা, কলাপাড়া উপজেলা, কলাপাড়া পৌর ও রাঙ্গাবালী উপজেলা বিএনপি সহ ৭টি কমিটি গঠণ করে। এ কমিটি গঠনে ব্যাপক অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে। এসব কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কোনো নির্দেশনা মানা হয়নি। তাদের নির্দেশনা অমান্য করেই এ কমিটিগুলো ঘোষণা করা হয়েছে বলে বিএনপির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

গলাচিপা-দশমিনা বিএনপির কমিটি গঠনে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তুলে ২৬ অক্টোবর ৩০ জন নেতা মহাসচিব বরাবর একটি আবেদন করেন। চিঠিতে অভিযোগ করা হয়েছে, গলাচিপা উপজেলা কমিটির আহ্বায়ক সিদ্দিকুর রহমান একাধিক চেক জালিয়াতি মামলার আসামী। তার একমাত্র সন্তান মুশফিকুর রহমান রিচার্ড সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত এবং বর্তমান এমপি শাহজাদা সাজু ও বর্তমান সিইসি নুরুল হুদা তাদের ঘনিষ্ট আত্মীয় এই উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব হিসেবে আব্দুস সাত্তার হাওলাদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার ছেলে হারুনুর রশীদ সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারণে সাত্তারের মালিকানাধীন হাওলাদার এন্টারপ্রইজসহ একাধিক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নামে কোটি কোটি টাকার কাজ এবং মামা ব্রিকস নামে একটি ইটভাটা পরিচালনা ও দশমিনা উপজেলার সদস্য সচিব হিসেবে ফখরুজ্জামান বাদল সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ করে তাদের দ্বারা কমিটি গঠনের আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

আবেদনের প্রেক্ষিতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বরিশাল বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিনকে অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করে ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় দপ্তরে জমা দেয়ার নির্দেশ দেন। পরে ১ নভেম্বর অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে এবং সংগঠনের ঐক্য ও গতিশীলতার স্বার্থে উভয় গ্রুপের সমন্বয়ে এবং ৩টি কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে জেলার সাথে বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করার সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দেন বিলকিস জাহান শিরিন।

বিলকিস জাহান শিরিনের সুপারিশে মির্জা ফখরুলে নির্দেশে ২৫ নভেম্বর সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক, সদস্য সচিব ও বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদককে নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু রিজভীর স্বাক্ষরিত চিঠি পেয়ে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব বিলকিস জাহান শিরিনকে না জানিয়ে ২৬ নভেম্বর বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান মামুনের এজেন্ডায় আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব করে একটি একপেশে কমিটি ঘোষণা করেন।

গত ২৯ নভেম্বর মহাসচিবের নির্দেশে রুহুল কবির রিজভী গলাচিপা দশমিনা উপজেলার ৩টি সাংগঠনিক কমিটি কেন্দ্রীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করে পিছনের তারিখে কমিটি দেয়ার অভিযোগে কমিটি স্থগিত করেন এবং জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য কেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তা জানিয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়।

এদিকে গত ২৯ অক্টোবর বাউফলের সাবেক এমপি ও বর্তমান জেলা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সালমা আলম লিলি মহাসচিব বরাবর একটি আবেদন করেন। তারা উল্লেখ করেন পটুয়াখালী জেলা বিএনপির আহবায়ক আব্দুর রশীদ চুন্নু ও তার ছেলে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িতদের দিয়ে কমিটি গঠনের পাঁয়তারা করছেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে মহাসচিব বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদককে বিষয়টি তদন্ত করে ৭ দিনের মধ্যে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়ান নির্দেশ দেন। নির্দেশনা অনুযায়ী বিলকিস জাহান শিরিন আওয়ামী লীগ ঘরানার লোকদের বাদ দিয়ে ত্যাগী, নির্যাতিত ও যোগ্য নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করার সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দেন।

তবে জেলা বিএনপি বিলকিস জাহান শিরিনের সুপারিশ উপেক্ষা করে এবং কেন্দ্রকে কিছু না জানিয়ে চুন্নু ও তার ছেলে বিতর্কিত লোকদের দিয়ে ২৫ নভেম্বর ব্যাক ডেটে কমিটি ঘোষণা করেন। পরে এই কমিটির স্থগিতাদেশ চেয়ে ৩০ নভেম্বর আবেদনকারীরা মহাসচিব বরাবর আরেকটি আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মহাসচিব বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশে সমন্বয় করে কমিটি গঠিত না হওয়ায় কমিটি স্থগিত করে বিলকিস জাহান শিরিনকে বাউফল উপজেলা ও পৌর কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। এই নির্দেশনা অনুযায়ী ৩১ নভেম্বর রুহুল কবির রিজভী আহমেদ কমিটি স্থগিত করে বিলকিস জাহান শিরিনকে কমিটি করার নির্দেশ দিয়ে দপ্তর থেকে চিঠি দেন।

অন্যদিকে গত ২৯ অক্টোবর কৃষক দল কলাপাড়া থানার প্রতিষ্ঠিতা সভাপতি মো. সাইদুর রহমান সাইদ মহাসচিব বরাবর একটি আবেদন করেন। আবেদনে তিনি অভিযোগ করেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রসৈনিক তার পুত্রকে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছেন। তিনি নিজেও রাজনীতিতে সক্রিয়। তার সবধরণের যোগ্যতা থাকা সত্বেও তিনি কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে যে তালিকা জেলা কমিটিকে দিয়েছেন তাতে তাদেরকে রাখা হয়নি।

এই আবেদনে মহাসচিব বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদককে বিষয়টি তদন্ত করে ৭ দিনের মধ্যে একটি প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেন। নির্দেশ অনুযায়ী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক গত ৪ নভেম্বর মহিপুরের নবগঠিত কমিটিতে ঐক্যের স্বার্থে রাজনৈতিক যোগ্যতা, মানবিক কারণে সন্তান হারা পিতা সাইদুর রহমানকে স্বাক্ষর ক্ষমতা দিয়ে মহিপুর থানা কমিটিতে ও কলাপাড়া বিএনপির সাবেক সভাপতি, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, সাবেক এমপি অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, সাবেক আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান মনির ও বর্তমান সিনিয়র সহ সভাপতি আব্দুল মালেক খানের সুপারিশ অনুযায়ী দলের ঐক্য এবং দলকে শক্তিশালী করার স্বার্থে রাংগাবালী উপজেলা, মহিপুর থানা ও কুয়াকাটা পৌর কমিটিতে অন্তত ৫ জন করে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দেন।

পরে গত ২৫ নভেম্বর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য মহাসচিবের নির্দেশে রুহুল কবির রিজভী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকে চিঠি দেন। ওই সময় বিলকিস জাহান শিরিন সাইদুর রহমান সাইদকে স্বাক্ষর ক্ষমতাসহ ৩ ইউনিটে ১৫ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জেলা কমিটিকে নির্দেশ দেন। কিন্তু সেই নির্দেশ অদৃশ্য কারণে আজও কার্যকর হয়নি।

এরপরে গত ৩০ নভেম্বর মোস্তাফিজুর রহমান, মালেক খান ও জাহাঙ্গীর তালুকদার কলাপাড়া উপজেলা, পৌর কমিটিতে ত্যাগী, যোগ্য ও নির্যাতিতদের বাদ দিয়ে একপেশে, বিতর্কিত এবং আওয়ামী ঘরোনার লোকদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি বাতিল করার জন্য মহাসচিবকে চিঠি দেন। চিঠিতে তারা নবগঠিত কমিটির কতিপয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা, বয়স্ক, ঢাকায় অবস্থান করার কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেন। আবেদনের জবাবে মহাসচিবের নির্দেশে রুহুল কবির রিজভী জেলা বিএনপিকে কমিটি ২টি স্থগিত করতে এবং বিলকিস জাহান শিরিনকে বিষয়টি তদন্ত করে রিপোর্ট দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় বিএনপির এক সিনিয়র নেতা বলেন, গত ৬ ডিসেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদককে প্রত্যেকটি কমিটি সমন্বয় করার জন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু জেলা বিএনপি, এবিএম মোশাররফ হোসেন ও হাসান মামুনের গোয়ার্তুমির কারণে করা যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, কমিটি গঠন ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এতে কেউ খুশি হবে। আবার কেউ অখুশি হবে। আর এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। জাতীয় বিষয় নয়।

পটুয়াখালীর ৭টি উপজেলায় কমিটি গঠনে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগের বিষয়ে জানতে মোবাইলে ফোনে বরিশাল বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তার কাছে কমিটি গঠনের অনিয়মের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে পরে কথা বলবো।

9 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন