২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র : আরও এক ধাপ এগিয়ে

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১২:৪৫ পূর্বাহ্ণ, ০৬ অক্টোবর ২০১৯

অরুণ কর্মকার::  দিনটি ছিল গত ১৯ সেপ্টেম্বর। দুপুর ২টা বাজার সাত মিনিট আগে বিশালাকৃতির জাহাজটি এমন নিখুঁতভাবে ২৫০ মিটার দীর্ঘ জেটিতে এসে ভিড়ল যে কেউ কিছু টেরই পেল না। জেটিতে উপস্থিত সবাই তখন আনন্দে উদ্বেলিত। সমগ্র জেটি মুখরিত করতালিতে।

অবশ্য এই করতালি এবং নানা প্রকার আনন্দধ্বনি শুরু হয়েছিল আরো প্রায় আধা ঘণ্টা আগে, যখন ১৯০ মিটার দীর্ঘ ও প্রায় পাঁচতলা ভবনের সমান উঁচু জাহাজটি জেটিতে উপস্থিত সবার দৃষ্টিসীমায় প্রথম আসে। আর জাহাজটি জেটিতে পৌঁছার ক্ষণ গণনা শুরু হয়েছিল তারও কয়েক ঘণ্টা আগে, সকাল ১০টায়। কারণ ওই সময়ই জাহাজের ক্যাপ্টেন রহমতউল্লাহ খানের কাছ থেকে খবর এসেছিল যে তিনি জাহাজটি নিয়ে রামনাবাদ চ্যানেলে ঢুকছেন।

রহমতউল্লাহ খান যদিও এই জাহাজের মূল ক্যাপ্টেন নন। তিনি এসেছিলেন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে ‘পাইলটিং’ করার জন্য। পাইলটিং মানে হলো—কোনো বিদেশি জাহাজ যখন আসে তখন বিদেশি ক্যাপ্টেন সেটি নোঙর করেন বন্দরের বহির্নোঙরে। সেখান থেকে স্বদেশি একজন ক্যাপ্টেন বন্দরের চ্যানেল দিয়ে চালিয়ে জাহাজটি নিয়ে আসেন নির্দিষ্ট জেটিতে। রহমতউল্লাহ খান সে কাজটিই করেছেন। তিনি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের একজন প্রথম শ্রেণির ‘মাস্টার মেরিনার’। গত ১৭ বছর ধরে প্রেষণে আছেন চট্টগ্রাম বন্দরে। সেখানে প্রতিদিন তিনি গড়ে ৫০টি জাহাজ পাইলটিং করেন। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ তাঁকে এনেছিল কয়লাবাহী প্রথম জাহাজটি রামনাবাদ চ্যানেল দিয়ে নিরাপদে জেটিতে নিয়ে আসার জন্য।

‘জিং হাই টং ৮’ নামের ৫০ হাজার টন কয়লা বহনে সক্ষম জাহাজটি ইন্দোনেশিয়া থেকে নিয়ে এসেছেন একজন চীনা ক্যাপ্টেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন পাঁচ নারীসহ ২১ জন ক্রু। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ভোর সাড়ে ৪টায় চীনা ক্যাপ্টেন জাহাজটি পায়রা বন্দরের বহির্নোঙরে নোঙর করেন। পরদিন ১৯ তারিখ সকাল ৭টায় ক্যাপ্টেন রহমতউল্লাহ বহির্নোঙরে গিয়ে জাহাজের কমান্ড গ্রহণ করেন। সকাল ১০টায় সমুদ্রে জোয়ার এলে তিনি জাহাজটি নিয়ে রামনাবাদ চ্যানেলে ঢোকেন।

জাহাজটি পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটিতে ভেড়ার পর সবাই নিশ্চিত হন যে ড্রেজিং করে এরই মধ্যে পায়রা বন্দরের রামনাবাদ চ্যানেলে যে নাব্যতা তৈরি করা হয়েছে তাতে ২০ হাজার টন কয়লাবাহী জাহাজ অনায়াসে আসতে পারবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটিতে। ফলে চ্যানেলের কার্যকারিতা নিয়ে বন্দর এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের যে উৎকণ্ঠা ছিল তার অবসান হয়। তা ছাড়া চ্যানেলটিতে আরো ড্রেজিং অব্যাহত রাখা হয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা নিয়ে একটি জাহাজ পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটিতে আসতে সময় লাগে প্রায় সাত দিন। প্রতিটি জাহাজে ২০ হাজার টন করে কয়লা আনা হলে সেই কয়লা দিয়ে কি পূর্ণ ক্ষমতায় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো যাবে? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে জানা গেল, কয়লা সরবরাহকারী জার্মান প্রতিষ্ঠানটি আন্দামানে একটি জেটি তৈরি করছে। ইন্দোনেশিয়া থেকে এক লাখ টন বা তারও বেশি ধারণক্ষমতার জাহাজে কয়লা এনে রাখা হবে সেই জেটিতে। সেখান থেকে ছোট (লাইটারেজ) জাহাজে করে প্রতিদিন ২০-২৫ হাজার টনের এক বা একাধিক জাহাজ কয়লা নিয়ে আসবে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে।

কিন্তু বর্ষা মৌসুমে? যখন সাগর উত্তাল থাকার কারণে জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটবে, তখন কী হবে? সেই পরিস্থিতির জন্য তৈরি করা হচ্ছে কয়লা মজুদ রাখার স্থান ‘কোল ডোম’। একেকটি ডোমের ধারণক্ষমতা হবে এক লাখ ৮০ হাজার টন। এ রকম মোট ছয়টি ডোম তৈরি করা হবে। কাজেই কোল ডোমে মজুদ করা কয়লা ব্যবহার করে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে কোনো সমস্যাই হবে না।

তবে তার পরও বছরে ৪০ লাখ টন কয়লা আমদানি করে প্রতিটি এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখা এমন একটি কাজ, যার ব্যবস্থাপনার প্রতি পদে চ্যালেঞ্জ থাকে। নতুন নতুন সমস্যার সমাধান করতে হয়। তাই কোনো একটি পর্যায় সফলভাবে শেষ হলেই উৎকণ্ঠার অবসান হয় না। এরপর শুরু হয় অন্য আরেকটি পর্যায় নিয়ে উদ্বেগ। সেদিনও ঠিক তাই হলো।

জাহাজ জেটিতে ভেড়ার পর মোনাজাত হলো। মিষ্টি বিতরণ হলো। পাশাপাশি আলোচনা শুরু হলো নতুন উৎকণ্ঠার বিষয়ে। সেই উৎকণ্ঠা বিশালাকার ক্রেনের সাহায্যে জাহাজ থেকে কয়লা খালাস এবং সম্পূর্ণ আবৃত কনভেয়ার বেল্টের মাধ্যমে তা কোল ডোমে নিয়ে মজুদ করার স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাটি যথাযথভাবে কাজ করবে কি না—এই ব্যবস্থা কাজ না করার যদিও কোনো কারণ নেই। তবু যেহেতু প্রথমবার করা হচ্ছে, তাই একটা উৎকণ্ঠা থেকেই যায় প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও কর্তৃপক্ষের।

ঠিক হলো, সব প্রস্তুতি শেষ করে বিকেল ৪টায় কয়লা খালাসের কাজ শুরু করা হবে। সে অনুযায়ী ৪টার আগেই সবাই হাজির জেটিতে। প্রস্তুতিও প্রায় শেষ। বিকেল ৪টার পরপরই ক্রেন সচল হলো। শুরু হলো কয়লা খালাস। জাহাজের খোল থেকে একেকবারে ১০ টন করে কয়লা তুলে ক্রেন সেটা ফেলতে লাগল কনভেয়ার বেল্টের সংযোগস্থলের একটি কনটেইনারে। চলতে শুরু করল স্বয়ংক্রিয় কনভেয়ার বেল্ট। কয়লা চলে যেতে শুরু করল ‘কোল ডোম’-এর ভেতরে।

উপস্থিত সবাই খুশি। সবাই ভাবলেন, জাহাজ আসা এবং কয়লা খালাসের এই পর্বটি সফল হওয়ায় আপাতত সব উৎকণ্ঠার অবসান হলো কিন্তু না। কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর পাওয়া গেল, কয়লা খুবই ভেজা। তাই ক্রেনে পরিমাণমতো উঠছে না। ক্রেন থেকে যেখানে ফেলা হয় সেখানে এবং কনভেয়ার বেল্টে আঠার মতো আটকে যাচ্ছে। অনেকে ভাবলেন, এমন তো হওয়ার কথা নয়।

কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইপিসি কন্ট্রাক্টরের প্রকৌশলীরা জানালেন অন্য কথা। জাহাজের চারটি আলাদা খোলের প্রতিটির মধ্যে পাঁচ হাজার টন করে কয়লা আছে। এর মধ্যে একটি খোলের কয়লা বেশি গুঁড়া এবং কাদামাটির মতো ভেজা। এই কয়লার নাম ‘কর্পেটিং কোল’। এই কয়লা ব্যবহার করা হবে কোল ডোমের মেঝে কার্পেটিং করার জন্য। সেই কার্পেটিংয়ের ওপর শুকনা কয়লা রাখা হবে। এ কারণে প্রথম খোলটির কয়লা খালাসে একটু সমস্যা হবে। সব ক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক। পরে ঠিকই দেখা গেল, অন্য খোলগুলোর কয়লা ভেজা নয়। খালাসেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

সফলভাবে এই কয়লা আমদানির মধ্য দিয়ে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র আরো এক ধাপ এগিয়ে গেল। এখন সেখানে বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি চালু করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এরপর বয়লারে আগুন ধরানো হবে। সেই কাজে প্রথম ব্যবহার করা হবে ডিজেল। তার পরই শুরু হবে কয়লার ব্যবহার। সে জন্য আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। আগামী মাসেই পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বয়লারে কয়লা পড়বে। আর আগামী মাসের শেষদিকে কয়লার পরবর্তী জাহাজটিও নোঙর করবে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটিতে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

arkrbd@gmail.com

6 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন