১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

প্রতিপক্ষের হামলা-মামলায় নিঃস্ব বরিশালের একটি পরিবার

Zahir Khan

প্রকাশিত: ০৪:৫৪ অপরাহ্ণ, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২

প্রতিপক্ষের হামলা-মামলায় নিঃস্ব বরিশালের একটি পরিবার

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল: জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে বরিশালের উজিরপুরের বামরাইল ইউনিয়নের ভরসাকাঠি গ্রামে প্রভাবশালী প্রতিপক্ষের হামলা ও মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে অসহায় একটি পরিবার নিঃস্ব হতে চলেছে। ভুক্তভোগী পরিবারটির ভোগ দখলীয় জমিজমা গ্রাস করতে প্রভাবশালী ওই প্রতিপক্ষ একের পর এক হামলা-মামলার পাশাপাশি জমিতে আবাদকৃত ধান, পাট, মুশুর ডাল ও সরিষাসহ নানা প্রজাতির ফসলেরও ক্ষতিসাধন করছে।

সবশেষ গত শুক্রবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৮টার দিকে উপজেলার ভরসাকাঠি গ্রামের অসহায় মিজানুর রহমানের আবাদকৃত মুরসি ডাল ও সরিষা উঠিয়ে পানিতে ফেলে দেয় প্রতিপক্ষ আবুল হোসেনসহ তার লোকজন। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী মিজানুর রহমান (বাচ্চু) বাদী হয়ে ওইদিনই প্রতিপক্ষ আবুল হোসেন, তার পুত্রবধু সেলিনা বেগম, একই এলাকার গোলাম মোস্তফা ও স্থানীয় ইউপি সদস্য শাহিন হাওলাদারকে আসামি করে একটি সাধারণ ডায়েরী করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার বামরাইল ইউপির ভরসাকাঠি গ্রামের মৃত সেকেন্দার আলী আকনের ছেলে মিজানুর রহমান বাচ্চুসহ তার পরিবারের সাথে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে একই গ্রামের মৃত ওয়াজেদ আলী হাওলাদারের ছেলে আবুল হোসেন হাওলাদার গংদের জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ চলছে। যা নিরসনে ২০১৫ সালে তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পৃথকভাবে শালিস বৈঠকের মাধ্যমে উভয় পক্ষকে মিমাংসা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু অসহায় মিজানের প্রতিপক্ষ প্রভাবশালী আবুল হোসেন ওই শালিসের রায় না মেনে উল্টো মিজানের ভোগ দখলীয় সম্পত্তি ও বসতঘর থেকে উৎখাতের চেষ্টা চালায়। যার প্রেক্ষিতে মিজানুর রহমান বাদী হয়ে ২০১৮ সালে প্রতিপক্ষ আবুল হোসেন গংদের বিরুদ্ধে বরিশাল বিজ্ঞ আদালতে ১৪৫ ধারায় একটি এমপি মামলা (১৯৫/১৮) দায়ের করেছিলেন। সেই মামলার জের ধরে প্রতিপক্ষ আবুল হোসেন বাদী হয়ে একই বছরের ডিসেম্বরে অসহায় মিজানুর রহমান, তার মা হোসনেয়ারা বেগম, স্ত্রী রানী বেগম, বোন আঙ্গুরি, মেরি, সাথী, বিথী ও পারুলসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে ১০৭ ধারায় বরিশাল আদালতে পাল্টা মামলা (১৮৭/১৮) দায়ের করেন।

উভয় পক্ষের এই দুই মামলা চলাকালীন ২০২০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর প্রতিপক্ষ আবুল হোসেন, তার ছেলে মানিক, মিলন, স্বপন, স্থানীয় গোলাম মোস্তফাসহ কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ জন মিলে অসহায় মিজান ও তার পরিবারের ওপর অতর্কিতভাবে হামলা চালিয়েছিল। ভাঙচুর করা হয়েছিল মিজানের ফসলী জমিতে থাকা কাঁচাঘর। তখন প্রতিপক্ষের হামলায় মিজান, তার মা-বোনসহ কমপক্ষে পাঁচজন আহত হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় মিজানুর রহমান বাদী হয়ে প্রতিপক্ষ আবুল হোসেন গংদের বিরুদ্ধে বরিশাল বিজ্ঞ আদালতে মামলা (সিআর ২৬৯/২০) দায়ের করেছিলেন। এরই মধ্যে মিজানের দায়ের করা এমপি মামলায় (১৯৫/১৮) ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর বরিশাল বিজ্ঞ আদালত রায় ঘোষণা করেন। রায়ে উল্লেখ করা হয়, উপজেলার ৭৯নং ভরসাকাঠি মৌজার এস.এ-২৩৯ ও ৩৭১ খতিয়ানের ৯০৭ ও ৮৭২ নং দাগের মধ্যকার ৬২ শতাংশ জমিতে বাদী মিজানুর রহমান ভোগ দখলে রয়েছেন। উক্ত জমি নিয়ে বাদীর দায়েরকৃত মামলায় বিবাদী পক্ষে কোন বক্তব্য প্রদান না করায় এবং বিরোধীয় জমিতে বাদীর (মিজান) ভোগদখল থাকায় উক্ত জমিতে প্রতিপক্ষকে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা করা হয়। আদালতের এই রায়ের প্রেক্ষিতে মিজানকে হয়রানি করতে প্রতিপক্ষ আবুল হোসেন বাদী হয়ে অসহায় মিজানুর রহমান, তার বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও পাঁচ বোনসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে একই বছরের ৩ ও ২৮ ডিসেম্বর বরিশাল আদালতে পৃথক দুটি মামলা (২৭১/২০ ও ৩০৫/২০) দায়ের করেন। মামলা দুটি এখনও আদালতে চলমান রয়েছে।

অপরদিকে মিজানের দায়েরকৃত এমপি মামলায় (১৯৫/১৮) আদালতের রায় বাস্তবায়নের আদেশপত্র পেয়ে উজিরপুর মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) কামাল হোসেন ২০২১ সালের ২ এপ্রিল মিজানের ভোগ দখলীয় জমিতে প্রতিপক্ষ আবুল হোসেন গংদের প্রবেশ না করার জন্য নোটিশ প্রদান করেন। কিন্তু বিজ্ঞ আদালত ও আইনের তোয়াক্কা না করে প্রভাবশালী আবুল হোসেন, তার সহযোগী গোলাম মোস্তফাসহ বেশ কয়েকজন মিলে পরেরদিন ৩ এপ্রিল সকালে অসহায় মিজানের জমিতে প্রবেশ করে এবং খুন-জখমের হুমকি দেয়। এ ঘটনায় ওইদিনই মিজানুর রহমান বাদী হয়ে আবুল হোসেন গংদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী (১১০) করেন। এতে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিপক্ষ আবুল হোসেন বাদী হয়ে একই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর মিজানুর রহমান ও পাঁচ বোনসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে বরিশাল আদালতে ১০৭ ধারায় একটি মামলা (১১৭/২১) দায়ের করেন। এর দুই মাস না যেতেই একই বছরের ১৭ ডিসেম্বর প্রতিপক্ষ আবুল হোসেন ফের মিজানকে খুন-জখমের হুমকি দেয়। সেই ঘটনার দিনই মিজানুর রহমান বাদী হয়ে আবুল হোসেন গংদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় সাধারণ ডায়েরী (৮২২) করেন।

এখানেই শেষ নয়, আর থেমে নেই মামলাবাজ খ্যাত আবুল হোসেন। মিজানুর রহমান, তার বৃদ্ধ মা, স্ত্রী, পাঁচ বোন, চাচা হাবিবুর রহমান, চাচাতো ভাই আলিম আকন ও বক্কর আকনসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারিও বরিশাল অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৪৪/১৪৫ ধারায় একটি মামলা (২০/২২) দায়ের করেছেন। এই মামলায় আবুল হোসেন শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গের শঙ্কা জানিয়ে আদালতের নিকট বিরোধীয় জমিতে স্থিতাবস্থার আদেশের আবেদন করেন। এর প্রেক্ষিতে আদালত সম্প্রতি ওই জমির ওপর স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য বাদী-বিবাদি উভয় পক্ষকে আদেশ দেন। কিন্তু আদালতের এই আদেশ বাদী আবুল হোসেন নিজেই অমান্য করে বিরোধীয় সম্পত্তিতে বিভিন্ন ধরনের ফসল আবাদ করছেন।

ভুক্তভোগী মিজানুর রহমানের মা বৃদ্ধা হোসনেয়ারা বেগমের দাবি, প্রতিপক্ষরা প্রভাব খাটিয়ে মামলা করলেও শেষ পর্যন্ত আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এভাবে একের পর এক মিথ্যা মামলা করলেও থেমে নেই তারা। আবুল হোসেনের দায়ের করা নয়টি মামলায় আমরা এখন প্রায় নিঃস্ব। যার মধ্যে তিনটি মামলা এখনও বিজ্ঞ আদালতে চলমান রয়েছে।

ভারসাকাঠি গ্রামের একাধিক বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জমি সংক্রান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন মামলা করেছে আবুল হোসেন। গ্রেপ্তার, হয়রানির পর প্রায় প্রতিটি মামলাই আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে আসছে। এলাকার লোকজন তাকে ‘মামলাবাজ আবুল’ নামেই চিনে। আবুল হোসেন ওই ভুক্তভোগী পরিবারের বৃদ্ধা ও নারী সদস্যদের বিরুদ্ধেও অনেকগুলো মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন।

ভুক্তভোগী মিজানুর রহমান জানান, জমির বিরোধের জের ধরে প্রভাবশালী আবুল হোসেনের হয়রানি, হামলা-মামলার শিকার হয়ে বৃদ্ধা মা, পাঁচ বোনসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিনি মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আবুল হোসেন মামলা দিয়ে দিয়ে তার পরিবারকে নিঃস্ব করে ছাড়বে বলে অব্যাহতভাবে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় ইউপি সদস্য শাহিন হাওলাদার। ইতিমধ্যে আবুল হোসেনের সাথে আমাদের বিরোধ মিমাংসার করা দিবেন জানিয়ে ইউপি সদস্য শাহিন আমার কাছে এক লাখ টাকা দাবি করেছেন।

তিনি আরও জানান, বর্তমানে প্রতিপক্ষ আবুল হোসেন, তার সহযোগী গোলাম মোস্তফা ও স্থানীয় ইউপি সদস্য শাহিন হাওলাদারের হুমকি-ধমকির কারণে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছেন পরিবারের লোকজন। তিনি ও তার পরিবার প্রতিপক্ষের হামলা-মামলা থেকে রেহাই পেতে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

মিজানুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, গত ২ ফেব্রুয়ারি ভোর ৫টার দিকে তার সম্পত্তিতে থাকা একটি টিনসেড ঘর স্থানীয় মেম্বার শাহিন হাওলাদারের সহযোগীতায় প্রতিপক্ষ আবুল হোসেন ও গোলাম মোস্তফাসহ বেশ কয়েকজন মিলে ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় ওইদিনই উজিরপুর মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করলেও বিষয়টি নিয়ে থানা পুলিশের ভূমিকা রহস্যজনক। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট আমি নিজে অভিযোগটি দিয়ে আসার ২৭ দিন অতিবাহিত হয়ে গেলেও অদ্যবদি পর্যন্ত তদন্তে কোনো পুলিশ সদস্য আসেনি।

এদিকে থানায় অভিযোগের ২৭দিন অতিবাহিত হলেও পুলিশ তদন্ত না হওয়ার বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আলী আর্শাদ জানান, মিজানুর রহমান বাচ্চুর এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন। জমিজমা নিয়ে আবুল ও মিজানের মধ্যে বিরোধ দীর্ঘ ৮ থেকে ৯ বছরের। আমি নিজে বিরোধীয় পরিদর্শন করেছি, উভয় পক্ষের বিরোধ স্থায়ীভাবে নিরসনের চেষ্টায় পুলিশ কাজ করছে।

এসব বিষয়ে কথা বলতে আবুল হোসেন হাওলাদারের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ফোন ধরে তিনি বলেন, মিজানের সাথে আমাদের জমির বিরোধ নিয়ে আদালতে মামলা চলমান রয়েছে। বিরোধীয় সম্পত্তিতে আদালতের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ অমান্য করেছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গের শঙ্কা জানিয়ে আদালতের নিকট আমিই স্থিতাবস্থা বজায়ের জন্য আবেদন করেছিলাম। তাহলে সেই আদেশ আমার অমান্য করার প্রশ্নই ওঠে না।

9 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন