২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

প্রলয়ঙ্ককরী ঘূর্ণিঝড়ের অর্ধশত বছরে উপকূল দিবস

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০১:০৬ অপরাহ্ণ, ০৯ নভেম্বর ২০২০

এম. আমীরুল হক পারভেজ চৌধুরী:: ভয়াল ১২ নভেম্বর উপকূল জীবন ইতিহাসের এক ভয়াবহ কালরাত। ১৯৭০ সালের এ দিনে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ১০ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। উপকূলীয় দ্বীপচরসহ বহু এলাকার ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে বিরাণ জনপদে পরিণত হয়। এই ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা আজও অনেকে শিউরে উঠেন; প্রবীণরা বর্ণনা দিতে গিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠেন। ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে ভোলা এবং তৎকালীন নোয়াখালী (নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর) উপকূলে। রামগতি, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ভোলা এবং পটুয়াখালী পরিণত হয়েছিলো ধ্বংসস্তুপে। তজুমুদ্দিন উপজেলায় ১ লাখ ৬৭ হাজার মানুষের মধ্যে বেঁচে ছিল মাত্র ৭৭ হাজার। মনপুরা দ্বীপের ৩২ হাজার মানুষের মধ্যে ২০ হাজার মানুষ সেই ভয়াল রাতে প্রাণ হারায়। সাগর, নদী, খাল-বিলে ভেসেছিল অসংখ্য লাশ। স্বাভাবিকভাবে মৃত দেহের সৎকার করাও সম্ভব হয়নি। ঘরবাড়ি, স্বজন হারিয়ে পথে বসেন উপকূলের লাখ লাখ মানুষ। ওই সময়ে মানুষ আবহাওয়ার পূর্বাভাসও সঠিকভাবে পায়নি। কারণ আজকের মতো যোগযোগ ব্যবস্থা সেদিন ছিল না। এবছর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়েরর অর্ধশত বছর পূর্ণ হবে।

জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) বিশ্বের পাঁচ ধরনের ভয়াবহ প্রাণঘাতি আবহাওয়া ঘটনার শীর্ষ তালিকায় বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ৭০ এর ভয়াল ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়টিকে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতি ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উল্লেখ করেছে। তথ্য মতে, ১২ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে ১৩ নভেম্বর ভোর পর্যন্ত বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) উপকূল অঞ্চলে সর্বকালের প্রাণঘাতি ঘূর্ণিঝড়টি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৮৫ কিলোমিটার গতিবেগে আঘাত হানে। ১৫ থেকে ২৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপগুলো প্লাবিত হয়। এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড়সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ। জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ থেকেও উপকূলের জন্য ১২ নভেম্বর দিনটি গুরুত্বপূর্ণ। এই ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দেয় উপকূল। এই ঘূর্ণিঝড় গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এটি সিম্পসন স্কেলে ক্যাটাগরি ৩ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল। উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়কে ‘ভোলা সাইক্লোন’ও বলা হয়। এছাড়াও দেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি পরোক্ষ কারণও প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়।

ঘূর্ণিঝড়ের বাতাস, জোয়ার-ভাটার বিস্তৃতি ও লবণাক্ততার প্রভাব এই তিনটি নির্দেশকে উপকূলীয় ১৯টি জেলা আওতাভুক্ত; এর মধ্যে ১৬ জেলা প্রত্যক্ষ উপকূল। এগুলো হলো; পূর্বউপকূলে ৬ জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুর; মধ্যউপকূলে ৭ জেলা ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, শরীয়তপুর এবং পশ্চিম উপকূলে ৩ জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা। বাকি ৩ জেলা অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ পরোক্ষ উপকূল; তা হচ্ছে যশোর, নড়াইল ও গোপালগঞ্জ। টেকনাফের নাফ নদের মোহনা থেকে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্ত নদী রায়মঙ্গল-কালিন্দী পর্যন্ত উপকূল অঞ্চলের দৈর্ঘ্য ৭১০ কিলোমিটার তটরেখা। এসব উপকূলজুড়ে রয়েছে সংকট ও সমস্যা; তেমনি রয়েছে অবারিত সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিকাশের ধারা। জাতীয় অর্থনীতিতে উপকূল জিডিপির কমবেশি প্রায় ২৫ শতাংশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বিপুল সংখ্যক মৎস্যজীবী সমুদ্র-নদীতে মাছ ধরে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। সেই আহরিত মাছ জাতীয় অর্থনীতির বড় অংশীদার।

উপকূলের সংকট, সমস্যা, সম্ভাবনা এবং উপকূলের মানুষের অধিকার ও ন্যায্যতার দাবি আদায়ে উপকূলের জন্য একটি বিশেষ দিন অপরিহার্য। তাই আমরা উপকূল ফাউন্ডেশন ১২ নভেম্বরকে ‘উপকূল দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চাই। কেননা উপকূলের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ; উপকূলকে প্রাকৃতিক বিপদ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবমুক্ত রাখা; উপকূলের দিকে নীতিনির্ধারনী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ; উপকূলের মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা; উপকূলের সকল সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক বিকাশের ধারা সুগম করা; উপকূলের দিকে দেশী-বিদেশী প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার নজর বাড়ানো; উপকূলের ইস্যুগুলো জাতির সামনে সহজে তুলে ধরাসহ ৭০ সালের ১২ নভেম্বরের সাইক্লোনে নিহতদের স্মরণ। ‘উপকূল দিবস’ হলে সকল বিষয়গুলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ণ করা সম্ভব হবে। প্রাথমিকভাবে ২০১৫ সালে উপকূল ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ‘উপকূল দিবস’ এর দাবি উঠে। পরবর্তী ২০১৬, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে উপকূল ফাউন্ডেশন সীমিত পরিসরে ‘উপকূল দিবস’ পালন এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দাবি করে আসছে। ২০১৯ সালে বৃহৎ পরিসরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে মানব বন্ধন শেষে গোলটেবিল আলোচনায় সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মোঃ এনামুর রহমান ১২ নভেম্বরকে ‘উপকূল দিবস’ ও ‘উপকূল উন্নয়ন বোর্ড’ কেবিনেটে উপস্থাপন করার আশ^স্ত করেন। দেশের বিভিন্ন স্থানেও উপকূল ফাউন্ডেশন ‘উপকূল দিবস’ এর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দাবি জানিয়ে কর্মসূচি পালন করে আসছে। উপকূল ফাউন্ডেশনের পাশাপাশি অন্যান সংগঠনও দাবির পক্ষে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছে গণমাধ্যকর্মীদের সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান, কিশোর-তরুণদের ফোরাম ইত্যাদি। মহান স্বাধীনতার পাঁচ দশক অতিক্রান্ত হলেও ভয়াল ১২ নভেম্বর দুর্যোগের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আজও মেলেনি। উপকূলের প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বহুমুখী দুর্যোগের সঙ্গে বাস করেন। ঝড়-ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ এক জনপদের নামই উপকূল। বৈরী প্রতিকূলতা, জলোচ্ছ্বাস, নদী-ভাঙন, লবণাক্ততার প্রভাব নিয়ে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে ফেরে উপকূলের শ্রমজীবি মানুষ। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, ৭০-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের পাঁচ দশকে সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে। ১২ নভেম্বরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘উপকূল দিবস’ হিসেবে পালন করার দাবি বাস্তবায়ন করবে।

প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের অর্ধশত বছরে বাস্তবায়ন হোক ১২ নভেম্বর ‘উপকূল দিবস’ । বাংলাদেশে ‘উপকূল দিবস’ দিবস পালন শুরু হলেই বিশ্বে প্রথমবারের মত এ ধরণের একটি দিবস উদযাপন হবে। শুধু বাংলাদেশের নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই এ দিনটি ‘ওয়ার্ল্ড কোস্টাল ডে’ তথা ‘বিশ^ উপকূল দিবস’ হওয়া উচিত বলে দাবি করি।

লেখক: পিএইচ.ডি গবেষক, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, উপকূল ফাউন্ডেশন।
ই-মেইল: ahcparvezdu@gmail.com

2 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন