১৬ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার

শিরোনাম

ফেসবুক ও সমকালীন ভাবনা: ইকবাল হোসেন তাপস

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৩:২৫ পূর্বাহ্ণ, ০৭ মার্চ ২০২০

মার্ক এলিয়ট জাকারবার্গ আমরা যাকে মার্ক জাকারবার্গ নামে চিনি, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে সহপাঠীদের সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখার মতো উপযোগী একটা মাধ্যম খুঁজতেছিলেন। সেই চিন্তা থেকেই ২০০৪ সালে ফেসবুক নামে একটি শক্তিশালী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উদ্ভাবন করে ফেলেন তিনি। ব্যক্তিগত চিন্তা ও প্রয়োজন থেকে শুরু হওয়া ফেসবুক এখন সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। তথ্যমতে সারা পৃথিবীতে এখন ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ২৫০ কোটি। বাংলাদেশও ফেসবুক ব্যবহারে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। সর্বশেষ জরিপের তথ্যমতে এদেশেও কমবেশি ফেসবুক ব্যবহার করেন প্রায় ৩ কোটি মানুষ। প্রতিদিনই এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। তাই অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম ফেসবুকের অপব্যবহার নিয়ে কিছু লিখবো।

ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে বয়সের যেমন তারতম্য রয়েছে তেমন ভিন্নতা রয়েছে তাদের উদ্দেশ্যেও। বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ফেসবুক ব্যবহার করে থাকেন। মার্ক জাকারবার্গের মতো কেউ ফেসবুক ব্যবহার করেন কাছের বন্ধু এবং প্রয়োজনীয় মানুষজনের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রাখার জন্য। আবার কেউ এটাকে ব্যবসাবাণিজ্যের মাধ্যম কিংবা কেউ শুধু অবসর সময় কাটানোর মাধ্যম বা বিনোদন মনে করেন। আবার কেউ কেউ আত্মপ্রচার বা প্রকাশ কিংবা প্রচারণার সেরা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন ফেসবুক। যে বা যারা, যে উদ্দেশ্যেই ফেসবুক ব্যবহার করুন না কেন সবারই মনে রাখা উচিৎ এটা একটা উন্মুক্ত প্লাটফর্ম। একটা খোলা জানালার মতো। এখানে আপনি যা করছেন সবাই তা দেখতে পাচ্ছে। আপনি যা লিখছেন, যা শেয়ার করছেন, যা আপলোড দিচ্ছেন তা কিন্তু সবাই দেখছে। অর্থাৎ এখান থেকেই সবাই আপনার মানসিকতা ও রুচিবোধ সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা নিচ্ছে। আপনার লেখা, ছবি বা পোস্টগুলো পর্যালোচনা করলেই কিন্তু আপনার মন-মানসিকতা, চিন্তা-ভাবনা ও রুচির একটা কল্পচিত্র মানুষের চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

অশিক্ষিত কিংবা স্বল্পশিক্ষিত মানুষের কথা নাহয় বাদই দিলাম। সেদিন দেখলাম আমারই পরিচিত এক শিক্ষিত ভদ্রলোক পিরোজপুর গিয়ে রিকসায় চড়ে একটা ছবি তুলে আপলোড দিয়েছেন। আবার আরেকজন ভদ্রলোককে দেখলাম সপরিবারে চেন্নাই গিয়েছেন ডাক্তারি চেকআপে এবং সেটা লিখে একটা হাস্যোজ্জ্বল ফ্যামিলি ফটো ফেসবুকে আপলোড দিয়েছেন। আমার প্রশ্ন হলো- ব্যক্তিগত কাজে আমাদের অনেককেই অনেক জায়গায় যেতে হয়। কাজে বা ভ্রমনে গিয়ে কোনো অনন্য বা বিশেষ ঘটনা ঘটলে সেই গল্প বা ছবি সবাইকে দেখানো অথবা সবার সাথে শেয়ার করা যেতেই পারে। কিন্তু সাধারণ কিংবা ব্যক্তিগত ছবি অন্যকে দেখানোর অর্থ কী নিজেকে জাহির করা নয়? কিংবা নিজস্ব প্রাইভেসি নষ্ট করা নয়?

অনেকে হয়তো বলবেন তাতে সমস্যা কী? আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা খেয়াল-খুশি থাকতেই পারে। হ্যাঁ, আমিও বলছি পারে। তবে সবসময় খেয়াল রাখতে হবে আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছা কিংবা খেয়াল-খুশিটা যেন অন্যের বিরক্তির কারণ হয়ে না ওঠে। সেটা যেন অন্যের কাছে আপনাকে হেয় কিংবা ছোট না করে। আপনার অহেতুক কাজটি যেন মানুষের কাছে আপনার রুচির দৈন্যতাকে প্রকাশ না করে। আমাদের ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার যেমন আছে তেমনি অন্যেরও আছে। তাই অন্যের বিরক্তি উদ্রেক করে এমন কোনো কাজ করার অধিকার আমাদের নেই।

সেদিন দেখলাম, উচ্চশিক্ষিত আমার পরিচিতজন উচ্চপদস্থ এক সরকারি কর্মকর্তার সাথে ছবি তুলে সেটা ফেসবুকে আপলোড দিয়েছেন। ছবিটা পোস্ট দিয়ে তিনি নিজেকে জাহির করতে চাইলেন নাকি সরকারি পদস্থ কর্মকর্তার সমকক্ষ কিংবা ক্ষমতাবান হিসেবে প্রকাশ করতে চাইলেন সেটা স্পষ্টভাবে বুঝতে ব্যর্থ হলাম। অনেক সময় দেখি আমার পরিচিতজনসহ অনেকেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামীদামী রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে খাবারসহ নিজেদের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেন। এটা দিয়ে তারা ঠিক কি বোঝাতে চান তা আমার বোধগম্য হয় না! আবার সেদিন আরেকজনকে দেখলাম উড়োজাহাজে চড়া ছবি আপলোড দিয়ে লিখেছেন উখিয়া যাচ্ছি। তিনি উখিয়া যাচ্ছেন সেটা বোঝাতে চাইলেন নাকি প্লেনে চড়েছেন সেটা জাহির করতে চাইলেন তা হয়তো তিনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে আমার কথা হলো- সবার উড়োজাহাজে চড়া কিংবা নামীদামী রেস্তোরাঁয় খাবার সৌভাগ্য হয় না। সবার সেই সামর্থ্য থাকে না। যাদের এই সামর্থ্য থাকে না তাদের মনে এটা দেখে কি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে সেটাও মনে হয় আমাদের একটু বিবেচনা করা উচিৎ।

প্রসঙ্গতঃ একটি ঘটনা না লিখে পারছি না। ঘটনাটি আজ থেকে ৭-৮ বছর আগের। আমার ছোট ছেলে তখন ক্লাস এইটে পড়ে। যেকোনো কারণেই হোক আমি তাকে একটি আইফোন কিনে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। ছোটরা যা করে আমার ছেলেও এর ব্যতিক্রম করলো না। সে আইফোন নিয়ে স্কুলে গেলো এবং তার সহপাঠী বন্ধুদের খুব গর্বভরে ফোনটা দেখিয়ে বললো এটা তাকে তার বাবা কিনে দিয়েছে। তার বন্ধুদের একজনের পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারের খুব ভালো সম্পর্ক এবং বাসায় যাতায়াত ছিল। আমার ছেলের হাতে আইফোন দেখে তার বন্ধু বাসায় গিয়ে যথারীতি তার বাবা-মায়ের কাছে আইফোনের বায়না ধরলো। এর পরের দিন সেই ছেলের মা অনেকটা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে এসে আমার স্ত্রীকে বললেন-‘আপনারা অন্যায় করেছেন। আপনাদের এতোটুকু ছেলেকে লক্ষ টাকা দামের মোবাইল ফোন কিনে দেয়া উচিৎ হয়নি। আপনার ছেলে সেটা স্কুলে নিয়ে সবাইকে দেখাচ্ছে। আপনাদের ভাবা উচিৎ ছিল, এতে অন্য ছেলেরা কষ্ট পেতে পারে। তারাও তাদের বাবা-মায়ের কাছে এমন দামী ফোনের বায়না ধরতে পারে। সব ছেলেমেয়ের অভিভাবকের সেই সামর্থ্য নেই। যাদের সেই সামর্থ্য নেই তারা সন্তানের কাছে ছোট হচ্ছে। এতে সন্তানরা যেমন কষ্ট পাচ্ছে তেমন সন্তানের আবদার রক্ষা করার সামর্থ্য না থাকায় বাবা-মায়েরাও কষ্ট পাচ্ছে।’ একথা শুনে আমার স্ত্রী খুব লজ্জিত হলেন এবং বাসায় এসে ঘটনাটি আমার সাথে শেয়ার করলেন। আমিও ভীষণ লজ্জিত হলাম এবং তৎক্ষনাৎ ছেলেকে বললাম, সে যেনো আর কখনোই ফোনটা নিয়ে তার স্কুলে না যায়।

আসলে আমাদের প্রত্যেকের ছোট-বড় সব ধরনের কাজ করার আগে কিছু বিষয় অন্তত ভেবে নেয়া উচিৎ। যেমন- আমি কাজটা কী করছি? কেন করছি? এতে আমার কতটুকু লাভ হচ্ছে? তাছাড়া এতে অন্যের কিংবা সমাজের কোনো ক্ষতি হচ্ছে কিনা? আমার কাজে নিজের লাভ হলেও তাতে অন্যের কোনো ক্ষতি কিংবা সমাজে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ছে কিনা সেটা ভেবে দেখা জরুরি। আমরা অনেক সময়ই অযথা বা বিনাকারণে অনেক নামীদামী মানুষের সাথে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড দেই। এটাকে আমি গর্হিত কাজ কিংবা অন্যায় বলছি না। তবে আমার মতে, বিশেষ কারণ বা প্রয়োজন ছাড়া নামীদামী মানুষের সাথে ছবি পোস্ট করে নিজেকে মূল্যবান ভাবার চেষ্টা করাটা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, দামী জিনিসের পাশে রাখলেও কমদামী জিনিসের দাম কখনো বাড়ে না। মূল্যহীন জিনিস আর মূল্যবান জিনিসের দাম কখনো এক হয় না। হীরক খন্ডের সাথে কাঁচের টুকরো রাখলে সেই কাঁচের টুকরো কখনো হীরা হয় না। বরং হীরকখণ্ডের উজ্জ্বলতার কাছে কাঁচের টুকরোটি আরো বেশি ম্লান বলে মনে হয়। ঠিক তেমনি আমরাও অনেক সময় নিজেকে দামী প্রমাণ করতে গিয়ে নামীদামী মানুষের সঙ্গে ছবি তুলে নিজের গুরুত্ব বাড়াতে চাই। কিন্তু দামী মানুষের পাশে দাঁড় করাতে গিয়ে আমরা বরং নিজেকেই সস্তা করে ফেলি। দামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে নিজের প্রকৃত দামটাও চোখে আঙুল দিয়ে অন্যকে বুঝিয়ে দেই।

প্রসঙ্গতঃ আমার জীবনের একটা বাস্তব ঘটনা দিয়ে লেখাটার ইতি টানতে চাই। ঘটনাটি আজ থেকে প্রায় ১৭-১৮ বছর আগের। তখন বিশ্বব্যাপী স্মার্টফোনের তেমন প্রচলন ছিল না। ব্যাংকক এয়ারপোর্টের এক স্টুডিওতে দেখলাম অনেক নামীদামী মানুষের সাথে বিভিন্ন মানুষের ছবি টাঙানো রয়েছে। আমি দোকানিকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি আমাকে বললেন- তুমি কার সাথে ছবি তুলতে চাও? আমি বললাম- আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে। তখন মুচকি হেসে স্টুডিওতে থাকা লোকটি বললেন- বিনিময়ে তুমি ৩০ ডলার (মার্কিন ডলার) দিও? আমি তোমাকে বর্তমান এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টের মাঝখানে বসিয়ে ছবি তুলে দেবো। আমি ভাবলাম, মন্দ কি? মাত্র ৩০ ডলারে পরাক্রমশালী দুই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এবং ক্লিনটনের সাথে ছবি! তাই রাজি হয়ে গেলাম। কিন্তু ছবি তুলতে গিয়ে দেখলাম দুই প্রেসিডেন্টই কোট-টাই পরিহিত। কিন্তু আমার তো টাই দূরের কথা গায়ে কোটও নেই। তাই দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম- তোমার কাছে কি কোট আছে? দোকানি হেসে ফেললেন এবং বললেন- দাঁড়াও ব্যবস্থা করছি। কোট-টাই ছাড়া ছবি তোলা হয়েছিল দেখে মনটা যদিও উসখুস করছিল, কিন্তু খানিক পরেই দেখলাম ফটোশপের যাদুতে দোকানি আমাকে কোট-টাই পরিয়ে ফেললেন এবং হুবহু তা দুই প্রেসিডেন্টের কোট-টাইয়ের মতোই। ছবি দেখে আমিতো মহাখুশি।

ছবি দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই এটা আসল নাকি নকল। ফটোশপের কারসাজি দেখে আমিও অবাক। আমি মাঝখানে বসা আর আমার দুইপাশে আমেরিকার দুই পরাক্রমশালী রাষ্ট্রনায়ক। একজন বর্তমান আর একজন সদ্য বিদায়ী। প্রিন্ট করা ছবিটা হাতে পেয়ে আমার নিজেকে খুবই গর্বিত মনে হচ্ছিল। তাই দেশে এসে একদিন খুব গর্ব করে আমার এক বন্ধুকে ছবিটা দেখালাম। আমার বন্ধু ছবিটা দেখে আমাকে বললেন-‘ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো না? আমেরিকার মতো একটা দেশের দুজন প্রেসিডেন্ট একসাথে তোমার সাথে ছবি তুলছেন?’ তখন আমার মনে হলো- আমি মিছেই দামী জিনিসের মাঝে বসিয়ে নিজেকে দামী ভাবার চেষ্টা করছি, যা আমাকে বড় না করে বরং বন্ধুর সামনে নিতান্তই ছোট করে দিয়েছিল। ৩০ ডলার খরচ করে বানানো আমার সেই ছবিটা আর কখনোই কাউকে দেখাইনি। এখন সেটা অযত্নে-অবহেলায় কোথায় পড়ে আছে তাও জানিনা।

আমরা অনেক সময়ই না বুঝে কিছু চিন্তা-ভাবনা বা যাচাই-বাছাই ছাড়াই ফেসবুকে অনেককিছু আপলোড কিংবা শেয়ার করি। অনেক ভুয়া খবর, অনেক ভুয়া নিউজ লিংক, অনেক গুজব, ইত্যাদি ঠিকমতো যাচাই না করে নিজের টাইমলাইনে শেয়ার করি কিংবা অন্যের ম্যাসেঞ্জারের ইনবক্সে পাঠাই। এটা অনেক সময় অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দেয়। যেমন কিছুদিন আগে পদ্মাসেতুতে মানুষের খন্ডিত মাথা দরকার বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা সবার জানা। সেই গুজবটি ছড়ানো হয়েছিল ফেসবুকের মাধ্যমেই। আর এই মাথাকাটা গুজবের কারণে সারাদেশে বেশ কয়েকজন নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি ছিল রাজধানীর বাড্ডার গৃহবধূ রেনু বেগমের।

রেনু বেগম নিজের সন্তানের ভর্তির ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে গিয়েছিলেন। অথচ গুজবপাগল জনতা তাকে স্কুলের সামনে ঘোরাঘুরি করতে দেখে ছেলেধরা সন্দেহে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করে! কল্লাকাটা তথা ছেলেধরা গুজবে তখন সারাদেশে এমন বেশকিছু মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। এছাড়াও সর্বশেষ লবনের মূল্যবৃদ্ধির গুজবের কথা তো সবারই জানা। এসব গুজবের ফলে সৃষ্ট পরিনতির দায়ভার কি শুধু সরকারের? নাকি যারা বুঝে কিংবা না বুঝেই ফেসবুকে এসব গুজব ছড়াচ্ছি তাদের? কেউ রাজনৈতিক কারণে কিংবা কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গুজব ছড়াতেই পারে। কিন্তু আমরা কেন সেই গুজবে কান দিচ্ছি? সত্যমিথ্যা যাচাই-বাছাই করা ছাড়াই কেন তা ফেসবুকে এবং অন্যের কাছে শেয়ার করছি?

আমার মতে, ফেসবুকে কোনোকিছু পোস্ট বা শেয়ার করার আগে একবার অন্তত ভেবে নেওয়া উচিৎ- (১) আমরা কি পোস্ট বা শেয়ার করছি? (২) এটা আসলে কেন করছি? (৩) আমার শেয়ার করা পোস্ট বা ছবি আমার সামাজিক অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা? (৪) আমার পোস্ট বা ছবি কারো বিরক্তির কারণ হচ্ছে কিনা? (৫) আমার শেয়ার করা ছবি বা লেখায় আমার ব্যাক্তিগত গোপনীয়তা ফাঁস হচ্ছে কিনা? (৬) আমার শেয়ারে অন্য মানুষের কাছে আমার অবস্থান হালকা হয়ে যাচ্ছে কিনা? (৭) আমি ফেসবুকে অহেতুক অন্যের নিন্দা কিংবা সমালোচনা করছি কিনা? (৮) আমি ফেসবুকে নিজের মতাদর্শ প্রচার করতে গিয়ে অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত কিংবা সমাজ অথবা রাষ্ট্রবিরোধী কিছু করে ফেলছি কিনা? (৯) আমার লেখায় ধর্মীয় উগ্রবাদ কিংবা জঙ্গিবাদ উস্কে দিচ্ছে কিনা? (১০) আমার পোস্ট বা শেয়ারে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট কিংবা দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে কিনা?

ফেসবুকে কোনোকিছু পোস্ট কিংবা শেয়ার করার আগে আমার মনে হয় এসব বিষয়গুলো আমাদের প্রত্যেকেরই একটু ভেবে দেখা দরকার। প্রত্যেক জিনিসেরই সুফলের পাশাপাশি কিছু কুফল থাকে। ফেসবুকেরও তেমনি সুফলের পাশাপাশি অনেক কুফলও রয়েছে। ফেসবুকের কারণে আমরা যেমন সহজেই বন্ধু কিংবা পরিচিতজনদের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারছি, খুব সহজেই তাদের খবরাখবর নিতে পারছি, তাদের সর্বশেষ অবস্থা জানতে পারছি। যাদের সাথে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয় না, সময়ের অভাবে ফোন করাও হয় না, ফেসবুকের কল্যাণে তাদের সাথেও নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। ফেসবুকের কারণে মানুষ অনেক ইনফরমেশন সহজেই জানতে পারছে। এর কল্যাণে ব্যবসা-বাণিজ্য ও তথ্য-প্রযুক্তির প্রসার ঘটছে।

তাই আমি ফেসবুক ব্যবহারের বিরুদ্ধে নই। তবে আমার ভাবনা এর অপব্যবহার নিয়ে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, কিছু সুফলের পাশাপাশি ফেসবুকের মাধ্যমে দেশে সাইবার অপরাধ বাড়ছে। যুব সমাজের মধ্যে এই ফেসবুকের মাধ্যমে অস্থিরতা ও হতাশা ছড়িয়ে পড়ছে। ফেসবুকের কুফলের সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। তারা লেখাপড়া এবং খেলাধুলার আকর্ষণ হারাচ্ছে। রাতভর ফেসবুক নিয়ে পড়ে থাকায় দিনের বেলা অসময়ে ঘুমাচ্ছে কিংবা সকালে অনেক দেরিতে ঘুম থেকে উঠছে। এতে তারা পড়াশোনার জন্য সময় এবং মনোযোগ দুটোই হারাচ্ছে।

প্রযুক্তির উৎকর্ষ এবং সহজলভ্যতার কল্যাণে এখন আমরা শিশু-কিশোরদের হাতেও স্মার্টফোন তুলে দিচ্ছি। মোবাইল ফোনের শক্তিশালী ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশনের কারণে ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধির ঝুঁকিতে ফেলছি তাদের। স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা নাহয় বাদই দিলাম। স্মার্টফোন হাতে পেয়ে ক্লাস সিক্স, সেভেন বা এইটে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও আজ ফেসবুকে একাউন্ট খুলছে। ভালোমন্দ কিছু বোঝার বয়স হওয়ার আগেই তারা বিপথগামী হচ্ছে। ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে রাতভর চ্যাটিং করে বিভিন্ন অসৎ সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।এছাড়াও অপরিণত বয়সে প্রেম কিংবা অবৈধ-অনৈতিক সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছে তারা। মেয়েরা প্রেম বা বিয়ের প্রলোভনে পড়ে সহজেই পথভ্রষ্ট হচ্ছে। একপর্যায়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তারা।

স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা স্মার্টফোন এবং ফেসবুক ব্যবহার করে কতটা উপকৃত হচ্ছে সেটা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারবো না। এটা হয়তো তারা নিজেরা অথবা তাদের অভিভাবকরা ভালো বলতে পারবেন। তবে আমি এটা হলফ করে বলতে পারি- ‘অল্পবয়সে স্মার্টফোন এবং ফেসবুক ব্যবহারের মাধ্যমে আপনার সন্তানটি বিপথগামী হচ্ছে এবং পড়াশোনা গোল্লায় যাবার শতভাগ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

পরিনত বয়সেও আজ অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক কলহ এবং অশান্তির জন্য দায়ী এই স্মার্টফোন আর ফেসবুক। এসবের কারণেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস বাড়ছে। অনেকে বিবাহবহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। এতে করে ভাঙছে মধুর সম্পর্ক। ভাঙছে পারিবারিক বন্ধন। পারিবারিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য নষ্ট করছে এই স্মার্টফোন এবং ফেসবুক! হয়তো এসব দেখেই কিছুদিন আগে খোদ ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ নিজেই এক অনুষ্ঠানে আক্ষেপ করে বলেছিলেন- ফেসবুক উদ্ভাবন ছিল নাকি তার একটি ভুল সিদ্ধান্ত। কারণ, এর উপযুক্ত ব্যবহারের তুলনায় অপব্যবহারই হচ্ছে বেশি।

আমি অবশ্য মনে করি- মাথা থাকলে ব্যথা হতেই পারে। মাথাব্যথার ভয়ে মাথা কেটে ফেলা যেমন যুক্তিযুক্ত নয়, তেমনি অপব্যবহারের ভয়ে কোনো যন্ত্র কিংবা মাধ্যম বন্ধ করে দেয়াটাও যুক্তিযুক্ত নয়। সব ভালো জিনিসের মাঝেই কিছু মন্দ দিক থাকে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধের মাঝেও কিছু সাইড এফেক্ট আছে। তাই ফেসবুকের অপব্যবহার রোধ করাই হলো সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। এজন্য প্রত্যেক ব্যবহারকারীর সচেতনতা একান্ত আবশ্যক। মোবাইল ফোন ও ফেসবুক কেন্দ্রিক বিভিন্ন অপরাধ প্রতিরোধ করতে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক প্রচারণার পাশাপাশি সরকারি কিছু নীতিমালা প্রয়োজন।

যেমন- কত বছর বয়স থেকে স্মার্টফোন এবং ফেসবুক ব্যবহার করা যাবে? কারা, কখন, কীভাবে এর ব্যবহার করতে পারবে? ফেইক আইডি অথবা মিথ্যা তথ্য দিয়ে কারো সঙ্গে প্রতারণা করলে কিংবা মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট করলে এর শাস্তি কী হবে? এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা থাকা প্রয়োজন বলে মনে করি। যদিও গুজব, ধর্মীয় উস্কানি, মানহানি কিংবা মিথ্যা খবর ফেসবুকে শেয়ার করলে সাইবার নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে সম্প্রতি শাস্তির বিধান চালু করা হয়েছে তবে তা প্রতিদিনের চলমান অপরাধের তুলনায় পর্যাপ্ত নয়।

তাই আমার মতে, এই আইনকে আরো যুগোপযোগী করার পাশাপাশি সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে স্মার্টফোন এবং ফেসবুক সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কিছু সরকারি নীতিমালা ও বিধিবিধান থাকা একান্ত আবশ্যক। স্মার্টফোন ও ফেসবুকের অপব্যবহারসহ দেশের সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে প্রত্যেকের ব্যক্তি সচেতনতা যেমন অপরিহার্য তেমনি রাষ্ট্র কর্তৃক যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন এবং মাঠপর্যায়ে তা বাস্তবায়ন করাটাও জরুরি। #

সম্পাদনাঃ আরিফ আহমেদ মুন্না
লেখাঃ ইকবাল হোসেন তাপস
যুগ্ম-মহাসচিব, জাতীয় পার্টি,
কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি।
পরিচালক, সাউথ এ্যাপোলো গ্রুপ।
চেয়ারম্যান, গভর্নিং বডি,
চাঁদপাশা হাইস্কুল ও কলেজ।

5 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন