২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

ববি’র বাংলা বিভাগে অচলাবস্থা, চেয়ারম্যানের প্রতি শিক্ষকদের অনাস্থা

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১১:০৭ অপরাহ্ণ, ২৬ মে ২০১৯

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান মোহসিনা হোসাইনের প্রতি লাইভ অনাস্থা প্রকাশ করেছে বিভাগের সকল শিক্ষক। গত ২২ শে মে একাডেমিক কমিটির বিশেষ সভায় সবার মতামতের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

চেয়ারম্যান মোহসিনা হোসাইনের অদক্ষতা, ব্যর্থতা ও অসৌজন্যমূলক আচরনের জন্য এই আনাস্থা জ্ঞাপন করেন শিক্ষকরা।বাংলা বিভাগের একাডেমিক সভা দীর্ঘদিন না হওয়ায় বিভাগের একাডেমিক কার্যক্রম ও অন্যান্য সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম সমূহ ব্যাহত হচ্ছে।

এমনকি অনেক কার্যক্রম ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সভাপতি হিসেবে তিনি অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে বারবার সমন্বয়হীনতা তৈরি করেছেন। ফলে বিভাগের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। বিভাগের শিক্ষার্থীরা শুধু সভাপতির সমন্বয়হীন ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে দীর্ঘ সেশনজটের মুখোমুখি হয়েছে বলে এসব অভিযোগ করেন শিক্ষক- শিক্ষার্থীরা। সবমিলিয়ে বাংলা বিভাগে এখন অচলাবস্থা বিরাজ করছে।

বিভাগের সভাপতি মোহসিনা হোসাইন ৩ মাস ধরে কোনো সভা আহ্বান না করে তার পরিবর্তে শিক্ষকদের ফোনে এসএমএস করেন। যা শিক্ষকদের কাছে অফিসিয়াল আচরণ বলে মনে হয়নি।

উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতে মোহসিনা হোসাইনকে একাডেমিক সভা ডাকার আহবান করেন বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার সরকার।এবং ২১ মে লিখিতভাবে সভাপতিকে এ ব্যাপারে জানানো হয়। সভাপতি মোহসিনা হোসাইনকে ২২ মে সভা আহ্বানের লিখিত অনুরোধ করলেও তিনি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নাই। তাই বিভাগের সচলাবস্থা ফিরিয়ে আনতে স্বপ্রণোদিত হয়ে ২২ মে একাডেমিক কমিটির বিশেষ সভা আহবান করেন সঞ্জয় কুমার সরকার। এবং সেই সভায় বাংলা বিভাগের সকল শিক্ষক উপস্থিত হন এবং চেয়ারম্যান মোহসিনা হোসাইনের দায়িত্বহীনতা ও সমন্বয়হীনতার কারনে তার প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেন।উল্লেখ্য, এই সভায়ও চেয়ারম্যান অনুপস্থিত ছিলেন।

গত ২২ মে কলা ও মানবিক অনুষদের ডিনের মধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য প্রফেসর ড.একে এম মাহবুব হাসানের কাছে চেয়ারম্যান মোহসিনা হোসাইনের বিরুদ্ধে লিখিতভাবে অনাস্থা পেশ করেন। এতে সাক্ষর করেন বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শারমিন আক্তার, সহকারী অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার সরকার,সহকারী অধ্যাপক সানজীদা মাসুদ,প্রভাষক উন্মেষ রায়,প্রভাষক সুলতানা নাজনীন,প্রভাষক মোহাম্মাদ সাকিবুল হাসান ও প্রভাষক পম্পা রানী মজুমদার।

চেয়ারম্যান মোহসিনা হোসাইনের প্রতি যেসব অভিযোগ একাডেমিক সভায় আলোচিত হয়েছে তার মধ্য অন্যতম নির্দিষ্ট সময়ের বহু পরেও ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের ৫ম সেমিস্টারের রেজাল্ট না হওয়া।টেবুলেটরগণকে ইচ্ছাকৃতভাবে নম্বরপত্র হস্তান্তর করেন নাই বলে অভিযোগ করেন টেবুলেটর শিক্ষকগন। এবং এক মাস আগে (১০ ই এপ্রিল ‘১৯) ৩০৫ কোর্সের দ্বিতীয় পরীক্ষকের নম্বরপত্র ডাকযোগে আসলেও তিনি তা অস্বীকার করেছেন। সকল নম্বরপত্র নিজের কাছে ফাইল বন্দী করে রেখেছিলেন।
শিক্ষকদের অভিযোগ তার কারণে ফলাফলে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হয়েছে। তারা আরও জানান, মার্চের ২য় সপ্তাহে ফাইনাল পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু দীর্ঘসূত্রিতার কারণে রেজাল্ট প্রকাশ হয়েছে ২২ মে।এমন দায়িত্বহীনতার কারণে ৩ মাসের সেশনজটে পড়েছে শিক্ষার্থীরা।

চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর বিভাগের পিকনিক, ট্যুর, রবীন্দ্র জয়ন্তী, জীবনানন্দ জন্ম উৎসব,পিঠা উৎসব, বিভিন্ন প্রকাশনা সহ সকল সহশিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বিভাগের সকল শিক্ষক বারবার এসব বিষয় বলার পরও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।

অন্যদিকে বিভাগের খেলোয়াড় হিসেবে সুনাম অর্জনকারী শিক্ষার্থী মনোজিৎ বাইন খেলায় আহত হয়ে পায়ে লিগামেন্ট ছিড়ে গেলে ২ লক্ষ টাকার বেশি চিকিৎসা খরচ হয়। তখন তাকে বিভাগ থেকে আর্থিক সাহায্যের সুপারিশ করেন অন্যান্য শিক্ষকরা। মোহসিনা হোসাইন সাহায্য করতে চাইলেও অন্য শিক্ষকরা কোনো মতামত দান করেননি বলে ছাত্রদের মাঝে শিক্ষকদের নামে গুজব ছাড়ানোর অভিযোগও উঠেছে।

এছাড়াও ২০১৬-১৭ স্নাতকোত্তর শ্রেণির থিসিস গ্রুপের দুজন শিক্ষার্থী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে থিসিস জমাদানে ব্যর্থ হলে সুপারভাইজার মোহসিনা হোসাইনের সুপারিশে সময় বর্ধিত করা হয়। বর্ধিত সময়েও সেই শিক্ষার্থী দুজন থিসিস জমাদানে ব্যর্থ হয় এবং পুনরায় সুপারভাইজার সময় বাড়ানোর সুপারিশ করেন। সভার সকলে এই বিষয়টিকে দায়িত্বে অবহেলা বলেই মনে করেন।

বাংলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক শারমিন আক্তার বলেন,শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়েছে, পরীক্ষা অর্গানাইজ হচ্ছে না, নম্বরপত্র মোহসিনা হোসাইন নিজের কাছে রেখে আমাদের দেয়নি।সবসময় কাছে অসহযোগিতা করেন।আমি মার্তৃত্বকালীন ছুটি শেষে ফিরে আসার পর দুই মাস আমার চেয়ারম্যানসীপের বাকি ছিল।তখন তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন।কিন্তু চেয়ারম্যানেরর দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়নি। এমনকি প্রথম কয়েকদিন বসার জন্য চেয়ার টেবিলও পাইনি।তার দায়িত্বহীনতার কারনে অচালবস্থা তৈরি হয়েছে তাই একান্ত বাধ্য হয়ে তার প্রতি অনাস্থা দিয়েছি। ডিপার্টমেন্ট ঠিকঠাকভাবে চললে সবাই তার বিরোধী হয় কিভাবে? ”

এদিকে চেয়ারম্যান মোহসিনা হোসাইন বলেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, গত ৫ মে একটা মিটিং করেছি। ৩ মাস ধরে মিটিং হয় না বলা হয় কিভাবে? ২১ তারিখ চিঠি দিয়ে ২২ তারিখ তো মিটিং করতে পারেনা। অন্তত ৩ দিন আগে জানাতে হবে। খুব জরুরি হলে ১ দিন আগে জানাতে পারে।বিভাগের সভাপতি মিটিং ডাকে। এখন এমন কোন জরুরি অবস্থা তৈরি হয়নি যে স্বপ্রণোদিত হয়ে অন্য কাউকে মিটিং ডাকতে হবে। ছাত্রদের রেজাল্ট বিলম্ব হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, রেজাল্ট আটকে রেখে আমার লাভ কি? রেজাল্ট হাতে আসছে দেরিতে তাই প্রকাশ করতে বিলম্ব হয়েছে।তিনি বলেন ট্যুর, টিকনিক ছাত্র উপদেষ্টারা আয়োজন করে, চেয়ারম্যান পরামর্শ দেয়। সাবেক চেয়ারম্যান মার্তৃত্বকালীন ছুটি থেকে ফিরে আসার পর অবশিষ্ট দু’ মাসের দায়িত্ব হস্তান্তর না করার ব্যাপারে বলেন, আমি চেয়ারম্যান হতে চাইনি আমাকে জোর করে দেয়া হইছে।প্রশাসনের কাছে বারবার বলেছি দায়িত্ব হস্তান্তর করার জন্য কিন্তু তারা হস্তান্তর করেনি।

বাংলা বিভাগে এমন কি অবস্থা তৈরি হলে যে সবাই আপনার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করেছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। চেয়ারম্যান হওয়ার পর সহকর্মীরা আমাকে কোন সহযোগিতা করেনি।

বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার সরকার বলেন, “বিভাগে চেয়ারম্যান কোনো কাজেই দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি।পরীক্ষা কমিটি, রেজাল্ট, কোর্স বন্টন সব আটকে আছে মিটিং এর অভাবে।কিন্তু সেগুলো সমাধানে কোন একাডেমিক মিটিং ডাকা হয় না।গত ৫ তারিখ অসুস্থতা শিক্ষার্থীকে টাকা দেয়ার জন্য জরুরি সিদ্ধান্ত নেয়া হয় কিন্তু সেটা কোন একাডেমিক মিটিং ছিল না।সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের সাথে ক্রমেই দূরত্ব তৈরির পাশাপাশি প্রশাসনের সাথে সুবিধাজনক সম্পর্ক তৈরি করেছেন। ফলে একক ব্যক্তির কারণে বিভাগের সকল কার্যক্রম থমকে গিয়েছে। তিনি শিক্ষা ছুটিতে যাবেন এই কথা বলে বলে বিভাগের নাম সর্বস্ব সভাপতি হিসেবে পদ আগলে রেখেছেন। এসকল কাজ তিনি পূর্ববর্তী উপাচার্যের আনুকূল্যে করেছেন। ফলে আমরা সকল শিক্ষক তার প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেছি।”

২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী রাজু গাজী বলেন, ” প্রতিটি ব্যাচে প্রায় ২/৩ মাস করে সেশনজট।আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় খেলায় গুরুতর আহত মনোজিতকে পর্যাপ্ত সাহায্য করা হয়নি।স্টাডি ট্রুর সহ প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত। যার কারনে বর্তমান চেয়ারম্যানের প্রতি ছাত্র শিক্ষক সবার চাপা ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।”

আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় খেলায় পায়ের লিগামেন্ট ছিড়ে যাওয়া ফুটবলার মনোজিৎ বলেন,আমাদের বিভাগের অবস্থা আগের চেয়ে অনেক খারাপ হইছে। বিভাগের হয়ে খেলতে গিয়ে অসুস্থতায় ২ লক্ষ টাকার বেশি খরচ হইছে।চিকিৎসা ব্যায় বহন করার কথা বিভাগের কিন্তু চেয়ারম্যান ম্যাম তেমন কোন সহযোগিতা করেন নাই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থী বলেন, একবার ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের সবাই মিলে বিভাগ উন্নয়ন ফি কমাতে চেয়ারম্যানেরর কাছে গেলে তিনি এক শিক্ষার্থীকে বলেন, তুমি কি ভাল ছাত্র বা সিআর? তুমি কেন কথা বলো? শিক্ষার্থীদের অভিযোগ এরকম একজন দায়িত্বশীল জায়গায় থেকে ছাত্রদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ কাম্য নয়।খারাপ ছাত্র হলে কি কেউ কথাও বলতে পারবে না?

5 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন