১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

বরগুনা জেলা কমিটি: কোটি টাকার পদবাণিজ্যের তদন্তে বিএনপি

বরিশালটাইমস, ডেস্ক

প্রকাশিত: ০১:২৭ অপরাহ্ণ, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বরগুনা জেলা কমিটি: কোটি টাকার পদবাণিজ্যের তদন্তে বিএনপি

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল: বরগুনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির বিরুদ্ধে কোটি টাকার পদবাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। একটি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে পদ দেওয়ার বিনিময়ে টাকা নিয়েছেন কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবসহ চার নেতা। এখানেই শেষ নয়।

বিকাশের মাধ্যমেও নেওয়া হয় টাকা। এমনকি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়েও বিরূপ মন্তব্য করেছেন জেলার শীর্ষ নেতারা। এ নিয়ে বিএনপিতে তোলপাড় চলছে।

ব্যাংক থেকে টাকা তোলার চেকের কপি, বিকাশে লেনদেন ও হাইকমান্ডকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্যের বেশকিছু ফোনালাপের অডিও ক্লিপ এবং সঙ্গে আরও কিছু অনিয়মের তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। পরে অনুসন্ধানে উত্থাপিত অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ বিষয়ে তথ্যপ্রমাণ সংবলিত ১১৩ পৃষ্ঠার অভিযোগ দলটির মহাসচিবসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের কাছে দাখিল করেন জেলার তৃণমূল নেতারা।

এর ভিত্তিতে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটির প্রাথমিক তদন্তেও এ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে।

পরে বিষয়টি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকেও অবহিত করেছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। এর ভিত্তিতে যে কোনো সময়ে কমিটি ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা আসতে পারে বলে বিএনপি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বরিশাল বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘বরগুনা জেলা কমিটি নিয়ে অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। প্রমাণ পেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আর বরিশাল বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান বলেন, ‘বরগুনার বিষয়টি নিয়ে আমরা সবাই বিব্রত। বিষয়টি আমরা দেখছি। দেখা যাক।’

বিএনপির কেন্দ্রের কাছে জমা দেওয়া তথ্যপ্রমাণও হাতে এসেছে। এতে বলা হয়, জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি এবং পৌর ও উপজেলা ইউনিটে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়ার কথা বলে এ টাকা নেওয়া হয়।

এরমধ্যে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তার অনুসারীদের জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি ও ইউনিট শাখায় গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়ার কথা বলে দশ লাখ টাকা নেওয়া হয়।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেডের ঢাকার দক্ষিণখানের আশকোনা ব্রাঞ্চ থেকে ২০২২ সালের ৩ জুলাই চার নেতার নামে টাকা দেওয়া হয়।

যা একই বছরের ৪ জুলাই ২৯১৬৫৯৩ নম্বর চেকের মাধ্যমে পাঁচ লাখ টাকা তুলে নেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মাহবুব আলম ফারুক মোল্লা। ২৯১৬৫৯৫ নম্বর চেকের মাধ্যমে দুই লাখ টাকা তোলেন সদস্য সচিব তারিকুজ্জামান টিটু।

২৯১৬৫৯৬ নম্বর চেকের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা নেন সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সালেহ ফারুক এবং ২৯১৬৫৯৪ নম্বর চেকের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা নেন যুগ্ম আহ্বায়ক তালিমুল ইসলাম পলাশ।

এছাড়াও এসব নেতাদের অন্তত ২৪টি ফোনালাপের অডিও কেন্দ্রে দেওয়া হয়। যেখানে বিকাশের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা নেওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। এক ফোনালাপে শোনা যায়, ‘তারেক রহমানের চাকরি আমি করি না, দায়িত্ব দিয়েছে তা পালন করি।

আমাকে ফোন না দিয়ে ফারুক মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে হবে। তখন অপর পাশ থেকে শোনা যায়, কমিটিতে তার লোকজনকে রাখতে টাকা তো দিয়েছে, মোবাইল সেটও দিয়েছি।’

আরেক অডিওতে শোনা যায়, ‘আমার সঙ্গে ও ফারুক মোল্লার সঙ্গে সম্পর্ক রাখলেই হবে। আর পলাশ আমাদের নিজস্ব লোক তো, তারে ছোটখাটো সব সময় দিয়ে রাখবি। তখন অপর প্রান্ত থেকে বলা হয় ফারুক মোল্লাকে প্রায় সময়ই ১৫-২০ হাজার দেই গাড়ি ভাড়া।

অপর প্রান্ত থেকে তখন বলা হয়, তুই বলে দিস একজন ঠিক রাখলে কাজ হবে না, দুজনকেই ঠিক রাখতে হবে।’ আরেক ফোনালাপে শোনা যায়, ‘একটা নম্বর দিতে পারেন বিকাশ, অন্য প্রান্ত থেকে বলতে শোনা যায়, বিকাশ না, সরাসরি তুলে নিয়ে আসো।

খুচরা-মুচরা নিয়ে এলে বাদ। ভালো পাইলে ভালো মতো পাও।’ আরেক ফোনালাপে শোনা যায়, ‘তার সব লোকজন কিন্তু কমিটিতে রাখতে হবে। বাসায় আছেন? চেকটা ভাঙাইতে হবে। নইলে আবার ভাই চীন যাবে। অন্য প্রান্ত থেকে বলা হয়, আসো, আসো।’

এ বিষয়ে বরগুনা জেলা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মো. শাজাহান কবির বলেন, ‘টাকা নিয়েই জেলার ইউনিট কমিটিগুলো করা হয়েছে।

যাদের স্বাক্ষরে কমিটি হয়েছে তারা নিয়েছেন, এর সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিলেন। এটা এখন ওপেন সিক্রেট। কোটি টাকার ওপরে হবে। উপজেলার কমিটি থেকে এক কোটির ওপরে টাকা নিয়েছে। কেন্দ্রকে তথ্যপ্রমাণসহ জানানো হয়েছে।’

একই কথা বলেছেন আহ্বায়ক কমিটির আরও দুই সদস্য। তারা বলেন, ‘কমিটি গঠনের পর থেকে জেলায় পদবাণিজ্য ছাড়া দলের কোনো সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি। সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্যপ্রমাণ কেন্দ্রে দেওয়া হয়েছে।

এর বাইরেও অনেক টাকার লেনদেন হয়েছে যা অভিযোগে দেওয়া যায়নি। ইউনিট কমিটিতে রাখা অধিকাংশ নেতা আওয়ামী লীগ থেকে সুবিধাভোগী ও অযোগ্য।’

এ প্রসঙ্গে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও বরগুনা জেলার সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মোল্লা যুগান্তরকে বলেন, ‘চেকের মাধ্যমে টাকা নিয়ে উপজেলাগুলোতে কমিটি করেছে।

মোবাইলও গিফট হিসাবে নিয়েছেন। যা ফোনালাপের অডিওতে সবই আছে। টাকার বিনিময়ে কমিটি দেওয়ার কারনে ভালো নেতৃত্ব আসেনি। বিভাজন আছে, ত্যাগী নেতাকর্মীদের বাদ দেওয়া হয়েছে।

এসব উপজেলায় ঝাড়ু মিছিলও হয়েছে। বিকাশের মাধ্যমে টাকা নেওয়ার প্রমাণ হিসাবে অডিও রেকর্ড, চেকের মাধ্যমে টাকা নেওয়ার কপিসহ আরও তথ্যপ্রমাণ কেন্দ্রে দেওয়া হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এতে বিএনপির কেন্দ্রীয় শ্রমবিয়ষক সহ-সম্পাদক ফিরোজ-উজ-জামান মামুন মোল্লাও (জেলার আহ্বায়কের আপন বড় ভাইয়ের ছেলে) জড়িত।

সে আগে ছাত্রলীগ করতেন। কোনো দিনও বিএনপির কোনো কমিটিতে সদস্যও ছিলেন না। কিন্তু হঠাৎ করে প্রথম পদ হিসাবে তাকে বিএনপির মতো একটি বড় দলের কেন্দ্রীয় কমিটির শ্রমবিষয়ক সহ-সম্পাদক করা হয়।

অডিওতে তার ব্যাপারে আছে, টাকা তাকেও দিতে হবে। এসব বলেও নেতাকর্মীদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন।’ বরগুনার সাবেক এই সভাপতি আরও বলেন, ‘ভালো নেতারা আসুক, যারা দলের জন্য নিবেদিত ও পরীক্ষিত। যারা দলকে ভালোবেসে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করবেন।’

জেলা যুবদলের সভাপতি জাহিদ হোসেন মোল্লা বলেন, ‘কোনো কর্মসূচিতে গেলেই বিএনপির কমিটির বিষয় নানা প্রশ্ন শুনতে হয়। এ আসলে লজ্জাজনক বিষয়।’

বরগুনা জেলা বিএনপির সদস্য সচিব তারিকুজ্জামান টিটু ৮ জানুয়ারি ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। চেকের মাধ্যমে টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মাহবুবুল আলম ফারুক মোল্লা বলেন, ‘মাদ্রাসার জন্য নিয়েছিলাম।

পদ দেওয়ার কথা বলে কোনো টাকা নেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। এসব মিথ্যা ও বানোয়াট। ফোনালাপের অডিওকেও তিনি বানোয়াট বলে দাবি করেন। তার দাবি, ১০ ইউনিটের মধ্যে নয়টির কমিটি দেওয়া হয়েছে। যেখানে যোগ্যদের রাখা হয়েছে।’

চেকের মাধ্যমে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেন সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এজেডএম সালেহ ফারুকও। তিনি দাবি করেন, তার বাড়ির পাশে একটি মাদ্রাসার জন্য এ টাকা নেওয়া হয়েছে। এছাড়া অডিওসহ পদবাণিজ্যের অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট বলে দাবি করেন।

তবে চেকের মাধ্যমে টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন জেলার যুগ্ম আহ্বায়ক তালিমুল ইসলাম পলাশ। তিনি বলেন, ‘হলফ করে বলতে পারি, এর সঙ্গে কোনোভাবেই আমি সম্পৃক্ত নই। ভিত্তিহীন ও মিথ্যা একটা অপবাদ রটানো হচ্ছে।’

দলের শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্যের বিষয়ে কেন্দ্রের কাছে অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি আমরা যারা দল করি এটা চাকরি না।

জিয়ার আদর্শের সৈনিক হিসাবে দল করি। এটা যদি বলেও থাকি সেটিরও যুক্তি আছে। কারণ আমরা তো আদর্শের রাজনীতি করি। তবে শীর্ষ নেতা সম্পর্কে ধৃষ্টতাপূর্ণ কথা বলার সাহস আমরা যারা প্রকৃত দল করি তাদের নেই। আমিও বলিনি।’

আর অভিযোগের বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় শ্রম বিষয়ক সহ-সম্পাদক ফিরোজ-উজ-জামান মামুন মোল্লাকে গত দু’দিন ধরে একাধিকবার হোয়াটস অ্যাপে ফোন দিলেও তা রিসিভ করেননি।

সূত্র জানায়, টাকার বিনিময়ে পদবাণিজ্যের সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে এই কমিটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত যত অভিযোগ তাও সঙ্গে দেওয়া হয়।

দায়িত্বপ্রাপ্তরা তদন্ত শুরু করেছেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত এক নেতা বলেন, ‘তাদের বিষয়ে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। শিগগিরই রিপোর্ট দেওয়া হবে। সেখানে কমিটি ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ করা হবে।’

এদিকে নতুন কমিটি করার ক্ষেত্রে কেন্দ্র থেকে নেতাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। সভাপতি বা আহ্বায়ক হিসাবে জেলার সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মোল্লা, সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি গোলাম ছগির মজনু এবং সাধারণ সম্পাদক বা সদস্য সচিব হিসাবে বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও সাবেক দুবারের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম হুমায়ুন হাসান শাহীনের নাম শোনা যাচ্ছে।

জানা গেছে, এসব নেতা জেলায় ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা হিসাবে পরিচিত। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে অসংখ্য মামলা। কয়েকবার জেল খেটেছেন, বিভিন্ন সময় নির্যাতনের স্বীকারও হয়েছেন।

গত বছরের জুনে বরগুনা জেলা বিএনপির ৩১ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে আহ্বায়ক করা হয় মাহবুব আলম ফারুক মোল্লাকে, যুগ্ম আহ্বায়ক এজেডএম সালেহ ফারুক, অ্যাডভোকেট নুরুল আমিন, তালিমুল ইসলাম পলাশ ও ফজলুল হক মাস্টার এবং সদস্য সচিব করা হয় তারিকুজ্জামান টিটুকে।

 

4 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন