২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

বরিশালের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল মুস্তাফা কামাল

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৬:২৮ অপরাহ্ণ, ২৭ মার্চ ২০২০

রোমেনা লেইস:: বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুস্তাফা কামালের জন্ম বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন মুস্তাফা কামাল। বরিশাল জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও বরিশাল বি এম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করে ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে (বর্তমানে বুয়েট) ভর্তি হন ১৯৬৫ সালে। ১৯৬৯ সালে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পাস করে বের হন মুস্তাফা কামাল। অত্যন্ত ভালো রেজাল্ট ছিল তাঁর।

কয়েকটি স্থানে আবেদন করে সুযোগ পাওয়ার পরও সংবাদপত্রে প্রকাশিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে তাঁরা একই প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২৫/৩০ জন বন্ধু আবেদন করেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষা, স্পেশাল সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) ইত্যাদি শেষে টিকেছিলেন মাত্র নয়জন। তাঁরা হলেন, লেফটেন্যান্ট এ এফ এম খালেদ, লেফটেন্যান্ট জহির, লেফটেন্যান্ট সালাউদ্দিন, লেফটেন্যান্ট গোলাম নবী, লেফটেন্যান্ট শাহ্‌ খালেদ রেজা, লেফটেন্যান্ট বোরহান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এ মালেক ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুস্তাফা কামাল।

১৯৭০ সালের ২৩ মে পাকিস্তানের কোয়েটায় ইএমই কলেজে শর্ট সার্ভিস কমিশনে লেফটেন্যান্ট ব্যাজ নিয়ে চাকরিজীবন শুরু। কমিশন পাওয়া নয়জনের মধ্যে তিনজনেরই পোস্টিং হয় রাওয়ালপিণ্ডিতে। তাঁরা হলেন শাহ্‌ আলম রেজা, এম এ মালেক ও মুস্তাফা কামাল। এর মধ্যে এম এ মালেকের বাড়ি হচ্ছে মুস্তাফা কামালের বাড়ির পাশে বরিশালের গৌরনদীতে। দুজনই একই স্কুলে পড়ালেখা করেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও তাঁরা ছিলেন রুমমেট। পুরো ব্যাপারটা ছিল কাকতালীয়। তা ছাড়া পাকিস্তানেও পোস্টিংয়ের পর দুই বন্ধু একসঙ্গে চলাফেরা করতেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুস্তাফা কামালের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রায় ৩৭ বছর এই সম্পর্ক অটুট ছিল দুজনের।

মহান মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘ নয় মাস স্থায়ী হয়। অনেক মানুষের আত্মত্যাগে আমাদের এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়। এই আত্মত্যাগী মানুষগুলোর কজনকেই বা আমরা চিনি, জানি বা তাদের খোঁজ-খবর নিয়ে এই প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে চেষ্টা করি। এতে ইতিহাসের পাতা থেকে সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদের নাম এবং তাঁদের দুঃসাহসিক অবদান ও ত্যাগের স্মৃতি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছে, যা একটি জাতির জন্য খুবই দুঃখজনক। এদিকে কিছু কিছু পরিবার আছে, যারা প্রচণ্ডভাবে প্রচারবিমুখ। ঠিক এমনই এক অজানা মানুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুস্তাফা কামাল। তিনি সম্পর্কে আমার খালু। এই অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিতে খালা জাহানারা কামালকে অনুরোধ করলাম মুস্তাফা কামালের ওপর কিছু লিখতে চাই এবং সে জন্য আমাকে তথ্য উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করতে। তাঁর কাছ থেকে জানা তথ্যই এখন ভরসা। কারণ, খালু মুস্তাফা কামাল ১৯৯৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি চাকরিতে থাকাকালেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে শতাব্দীর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর দুর্গত এলাকায় কর্তব্যরত কর্মকর্তা হিসেবে এম এ মালেক ও মুস্তাফা কামাল ছুটি পেয়ে একসঙ্গে গৌরনদীতে নিজ বাড়ি আসেন ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ। আসার একদিন পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে তাঁদের কাছে চিঠি আসে। চিঠিতে বলা হয়, যেসব অফিসার ছুটিতে আছে, তারা যেন ৫ মার্চের মধ্যে পাকিস্তান ফিরে গিয়ে রিপোর্ট করে।

যেখানে মার্চের ৫ তারিখ রিপোর্ট করারে কথা, সেখানে এম এ মালেক ও মুস্তাফা কামাল দুই বন্ধু ৫ তারিখ ঢাকা এসে পৌঁছান। যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কর্মস্থলে যাওয়া হচ্ছে না, তাই কোর্সমেট ও বন্ধু শাহ আলম রেজার পরামর্শে তাঁরা নিরাপত্তার কথা ভেবে ঢাকায় স্থানীয় স্টেশন হেড কোয়ার্টারে রিপোর্ট করেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে দেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন নিবিড়ভাবে।

এদিকে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে উল্লেখিত দিকনির্দেশনা মোতাবেক অসহযোগ আন্দোলনের ফলে দেশের পরিস্থিতি পাল্টাতে লাগল খুবই দ্রুততার সঙ্গে। এই অবস্থায় তিনি ৮ মার্চ চলে গেলেন নিজের গ্রামের বাড়ি গৌরনদীতে। ২৫ মার্চের গণহত্যার কয়েক দিন পর রাতের অন্ধকারে জীবন বাজী রেখে বাবার পরামর্শে ছেঁড়া পাঞ্জাবি পরে পুরো শরীরে ছাই মেখে চেহারা পরিবর্তন করে বিভিন্ন পথ ঘুরে কুমিল্লার সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যান সেনাবাহিনীর ইএমই কোরের সাহসী কর্মকর্তা মুস্তাফা কামাল। দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে এবং আগরতলার মেলাঘর ক্যাম্পে গিয়ে ২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ কাছে রিপোর্ট করেন তিনি পরবর্তী নির্দেশের জন্য। খালেদ মোশাররফের অধীনে এপ্রিল থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এবং মেজর এ টি এম হায়দারের অধীনে ২ নম্বর সেক্টরে ২২ সেপ্টেম্বর থেকে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত যুদ্ধ করেন। ১৬ ডিসেম্বরের পর অস্ত্র জমা দিয়ে গৌরনদীর বাড়ি গেলে তাঁর মা তাঁকে চিনতে পারেননি। জানতে চান, ‘কে ওখানে?’ ‘মা আমি’, বলার পর পর জড়িয়ে ধরেন যুদ্ধফেরত চুল-দাড়ি ঢাকা, ছেঁড়া জামা-কাপড় পরা ছেলেকে।

তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এ মালেক (অব.) তাঁর লেখা ‘স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ’ বইতে উল্লেখ করেছেন, ‘লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুস্তাফা কামাল বেশ সংস্কৃতিমনা, গানবাজনা পছন্দ করতেন। আমরা যে নয়জন বাঙালি অফিসার পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে গিয়েছিলাম, তাঁদের মধ্যে মুস্তাফা কামাল সবচেয়ে প্রাণবন্ত ও উচ্ছল ছিল। আমাদের প্রশিক্ষণের শেষের দিকে মুস্তাফা কামালের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বাংলার ঐতিহ্য নিয়ে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি করা হয়েছিল, তা উপস্থিত সবার প্রশংসা অর্জন করে।’

অনেক গুনের অধিকারী ছিলেন মুস্তাফা কামাল। আমার জীবনে আমি খালুর মতো এমন গোছানো স্বভাবের মানুষ কম দেখেছি। অফিস যাওয়া, সময়মতো ফোন করে খালা ও বাচ্চাদের খোঁজ নেওয়া, আবার সংসার যে কত সুন্দর কাব্যময় করে তোলা যায়, তাঁর কাছে দেখেছি। ১৯৭৪ সালে তাঁদের বিয়ে হয়। তাঁদের সংসারে প্রাচুর্য না থাকলেও দাম্পত্য জীবনে ছিল কবিতা-গান ও শিল্পবোধসম্পন্ন। বড় বেশি শিল্পমনা ছিলেন খালু। গানের আসর বসত। সেখানে নানা রকম বাদ্যযন্ত্রসহ বাংলাদেশ টেলিভিশনের নামকরা শিল্পীরা আসতেন। ব্যক্তিগত জীবনে দুই মেয়ের বাবা।

স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে পরম শ্রদ্ধা জানাই এই অসাধারণ মানুষটিকে। প্রার্থনা করি এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে মহান আল্লাহ যেন বেহেশতে নসিব করেন।

5 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন