২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

বরিশাল আওয়ামী লীগের ভেতরে অসন্তোষ!

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০১:৪৯ পূর্বাহ্ণ, ১৯ জুন ২০১৯

** বৃহত একটি অংশ চায় মেয়র সাদিকের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে।

** কিন্তু ভরসা পাচ্ছে না প্রতিমন্ত্রী শামীমের দুদুল্যমান ভূমিকায়

শাকিব বিপ্লব:: বরিশাল আওয়ামী লীগের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সিটি মেয়র সেরনিবাত সাদিক আবদুল্লাহ’র ওপর তিক্তবিরক্ত হয়ে উঠেছে দলের বৃহত একটি অংশ। নানাভাবে নিগৃহ-বঞ্চনা, অবহেলা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতাসহ বিতর্কিত একটি গোষ্ঠিকে প্রাধান্য দেয়ায় অনেক দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দসহ মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ক্ষোভে ফুঁসছে কিন্তু মুখ খুলছে না। এই অংশটি সিটি মেয়র সাদিকের অনুগত হলেও এখন সেই নেতার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে শুরু করেছে বলে জানা গেছে। আবার কেউ কেউ ভয়ে হাজিরা দেয়ার ন্যায় কালীবাড়িতে উপস্থিত হয়ে এখনো নেতার অনুগত আছে এমন ভাব প্রকাশ করে আত্মরক্ষায় কৌশল নিয়েছে। নীরবে ক্ষুব্ধ এই সকল নেতাকর্মীরা গোপনে অথবা কোনো মাধ্যম প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীমের সাথে যোগাযোগ রক্ষা শুরু করেছে। কিন্তু পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কতটা তাদের আগলে রাখতে পারবেন তা ভরসা পাচ্ছে না, এই নেতার দুুদুল্যমান ভূমিকায়। অনেকের ধারণা ছিলো, জাহিদ ফারুক শামীম মন্ত্রিত্ব লাভের পর প্রতিপক্ষ হিসেবে সাদিক আবদুল্লাহ’র সাথে ক্ষমতার ভারসাম্য গড়ে তুলবেন। দিন পার হলেও সেক্ষেত্রে এই নেতার নমনীয়তা, আবার কোনো কোনো কর্মকান্ডে সেরনিয়াবাত পরিবারের প্রতি তার দুর্বলতা স্পষ্ট ধরা পড়ায় নতুন মেরুকরণ সৃষ্টিতে অপেক্ষমান ক্ষুব্ধ নেতৃবৃন্দ তাদের অবস্থান পরিবর্তনে ভরসা পাচ্ছে না। তদুপরি ভেতরে ভেতরে জোরতর চেষ্টা চলছে প্রতিমন্ত্রীকে ক্রেজি করে তুলতে। শেষমেষ যদি তেমনটি ঘটে তবে অনেক সাদিক অনুসারিদের ঠিকানা পাল্টে যাওয়ার চিত্র দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।

আওয়ামী লীগের ভেতরে ক্রিয়াশীল বেশ কয়েকজন নেতা নাম প্রকাশে অস্বীকৃতির শর্তে জানান, প্রাপ্ত এতথ্য অমূলক নয়। তাদের ভাষায়, মেয়র হিসেবে নগর ভবনে দায়িত্ব নেয়ার পর বেশকিছু উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করায় সর্বমহল প্রশংসিত হলেও দুর্নীতিবাজ উতখাতের নামে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শাস্তিমূলক কর্মস্থল থেকে সরিয়ে ওএসডি করার পর সেই সকল চেয়ার তার অনুসারিরা দখল করায় বেশিমাত্রায় বিতর্কিত হয়েছেন। সেই সাথে নগর ভবনে অসন্তোষসহ কর্মচারীদের মধ্যেও বিভাজন সৃষ্টি মেয়রকে বিতর্কীত করেছে।

আবার কারও দাবি, তিনি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়া এবং টেলিফোনে সচারচার না পাওয়ায় একটি নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। এসব টপকে বিশেষ গ্রুপকে চারপাশে রাখাসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডে তাদের প্রাধান্য দেয়ায় উদীয়মান এই নেতার পূর্বেকার সেই ব্যক্তি ইমেজে ভাটা পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কারও দাবি, তার কালিবাড়ি বাড়িতে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষমান থাকা সত্ত্বেও সাক্ষাত না দেয়া, পাশাপাশি আত্মঅহংকারে ডুবে যাওয়ায় এই ক্ষোভ এখন বিস্ফোরন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

নিজেদের কোণঠাসা ভাবা অথবা অবহেলার শিকার হচ্ছে ভেবে অনেকেই বর্তমানে কালিবাড়িমুখি মেয়রের বাসভবনে যাতায়াত কমিয়ে দিয়েছে। ক্ষুব্ধ এই অংশের দাবি, দু:সময় যারা মেয়র সাদিকের বিরুদ্ধাচরণে নানা নির্যাতন সহ্য করে সোচ্চার ছিলো তারাই এখন বিশেষ কদর পেয়ে অতি আপন হয়ে মেয়রের চারপাশ ঘিরে রাখছে। তাদের মধ্যে বারবার নেতাবদলকারী হিসেবে চিহ্নিত গ্যাস্টিক বাবু নামে পরিচিত মহানগর নেতা ও সুমন সেরনিয়াবাত মেয়রকে পদভ্রষ্ট করছে বলে কথা উঠেছে।

সূত্রমতে, স্বার্থলোভীরাই প্রকৃত সাদিক প্রেমিদের কাছে ভিড়তে দিচ্ছে না। এই দুজন বিভিন্নভাবে মেয়রের কানভারি করায় কালিবাড়ি থেকে অনেক ত্যাগী নেতাকর্মীকে বেইজ্জতি হয়ে বিতাড়িত হওয়ার উদাহরণও রয়েছে।

আরেকটি সূত্র বলছে, নগরভবনে দুনীতি নিমূলের নামে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা- কর্মচারীকে কর্মস্থল সরিয়ে দিয়ে ওএসডি কারার পর সেই চেয়ারে মেয়র সাদিক অনুসারিদের বসিয়ে দেয়ার উদ্যোগে অনেক ভালো কাজ ঢাকা পড়ে গেছে, হচ্ছেন সমালোচিত। তদরুপ বরিশাল মিডিয়ার মধ্যেও বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে বলে কমবেশি প্রতিক্রিয়া শোনা যায়। বেশ কয়েকজন মিডিয়াকর্মীকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের বিভিন্ন স্বার্থ পূরণ করার বিপরীতে তার জন্য একসময় নিবেদিত সংবাদকর্মীদের অবহেলায় দূরে ঠেলে দেয়ায় এই বৈষম্যের বিষয়টিও ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সংবাদকর্মীরাও মেয়র সাদিক প্রশ্নে হয়ে পড়েছে দ্বিধাবিভক্ত। যারা এখন সাদিক বন্দনায় কাতর সেই মিডিয়াকর্মীদের অতীত ভূমিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- তারাই একসময় সেরনিয়াবাত পরিবারের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলো, রটিয়ে ছিলো নানা কেচ্ছা-কাহিনী।

অথচ অবহেলার শিকার মিডিয়াকর্মীরাই মেয়র সাদিকের উত্থান পর্বে ভূমিকা রেখেছিলো এমনটি শোনা গেছে, দেখাও গেছে। আবার সরকারি বিভিন্ন দপ্তরসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা মেয়র সাদিকের সাক্ষাতে তার কালিবাড়ি বাসভবনে সকাল-বিকেল অপেক্ষা করেও দেখা না দেয়া না পাওয়ার অভিযোগ শোনা যায়। এই সকল কর্মকর্তারা তিক্ত অভিজ্ঞতায় এখন নিজেদেরকে লজ্জিত ভাবছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে, শুধু মন্ত্রিত্বের কারণে নয়, মেয়র সাদিকের অবহেলায় প্রশাসনের অনেক শীর্ষ কর্মকর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাঠপযায়ের কর্মকর্তারা বর্তমান সময়কালে জাহিদ ফারুকের বাসভবনে নিয়মিত যাতায়াত বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই চিত্রে সাদিক আবদুল্লাহ’র প্রতি অভিমানী অনেক নেতাকর্মীকেও এখন এই প্রতিমন্ত্রীর পাশে ভিরতে দেখা যাচ্ছে। অবশ্য অপর একটি সূত্রের দাবি, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্য সুবিধাজনক স্থানে বদলী হতে মন্ত্রীর সহায়তা কামনায় তার অনুগত হয়ে কাজ করার কথা জানিয়ে সান্নিধ্য লাভে সহায়ক হয়েছে। জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তা ব্যক্তিদের মন্ত্রীর বাড়িতে গোপনে আবার প্রকাশ্যে অবস্থান নেয়া দেখে জাহিদ ফারুক শামীমকে এই মুহূর্তে বরিশাল ক্ষমতাসীনদলীয় রাজনীতিতে ক্ষমতাবান ব্যক্তি হিসেবে ভাবায় বঞ্চিত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা এখন একই পথে হাঁটতে চাইছে। ইতোমধ্যে অনেকে এই কূলে ভিড়েও গেছে, যারা কিনা একসময় সাদিক অনুসারি হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিলো পরিচিত মুখ। একথা অনস্বীকার্য যে, এক সময় কালীবাড়ি সড়কে মেয়র সাদিকের বাড়িতে যেখানে লোকেলোকারণ্য ছিলো সেখানে করিমকুটির সড়ক এলাকায় জাহিদ ফারুক শামীমের বাসভবনে গুটিকয়েক নেতাকর্মীদের পদচারণা দেখা যেতো। সেই চিত্রপটের এখন আমূল পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে, বরং বর্তমানে জাহিদ ফারুক শামীমের বাসভবন এখন সরগরম থাকে প্রায়শই। বিশেষ করে শুক্র ও শনিবার মন্ত্রী বরিশালে অবস্থানকালে তার বাসভবনে থাকে উপচে পড়া ভিড়।

সূত্রের দাবি অনুযায়ি, মেয়র প্রার্থীতা নিয়ে শামীম ও সাদিকের মধ্যে নেতৃত্বের দৌঁড়ে স্নায়ূযুদ্ধের বিষয়টি ছিলো সর্বমহল জ্ঞাত। সাদিক আবদুল্লাহ মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর অনেকেই ভেবেছিলো বরিশাল রাজনীতিতে জাহিদ ফারুক শামীমের অবস্থান টলে যাবে। কিন্তু সদর আসনের সাংসদ নির্বাচিত এবং মন্ত্রীত্ব পাওয়ার পর খোদ সাদিক আবদুল্লাহই তার সাথে ব্যালেন্স করে ঐক্যের রাজনীতির পথ চলতে এগিয়ে আসেন। স্বজ্জন ও কৌশলী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত জাহিদ ফারুক শামীমও অভিন্ন মত পোষণ করেছিলেন বলে জানা যায়। পরবর্তীতে প্রয়াত নেতা শওকত হোসেন হিরন অনুসারিসহ জাহিদ ফারুক শামীমের সহোচররাই অতীত তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করিয়ে নেতৃত্ব আর ক্ষমতার রাজনীতিতে ছাড় না দিতে নয়া এই মন্ত্রীকে চাপের মুখে রেখে চলেছে। এরূপ পরিস্থিতির মাঝে আওয়ামী লীগের জেলা ও মহানগর থেকে তুণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বিশেষ করে মেয়র সাদিকের অনুসারিরাই এখন মন্ত্রীকে আগামীর ভাবনায় ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরিতে তাগিদ দিয়ে চলেছে। মন্ত্রী কিছুটা সায় দিলেও তিনি সতর্ক পথে আরও একটু সময় নিতে চান।

যদিও প্রকাশ্যে বলছেন, তিনি এখন জাতীয় রাজনীতির নেতা, সুতারং নিজ এলাকায় নেতৃত্ব নিয়ে পুত্র সমতুল্য মেয়র সাদিকের সাথে বৈরিতা তৈরিতে বিশ্বাসী নন। এমন কথায় মেয়র সাদিকের বলয় থেকে বেড়িয়ে আসতে উন্মুখ নেতাকর্মিরা মন্ত্রীর ওপর ভরসা পাচ্ছেন না। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, ‘আক্রোশের শিকার হতে পারেন’- এমন আতঙ্কে তারাও কৌশল নিয়েছেন সুযোগ বুঝে ঝাঁপ দেয়ার অপেক্ষার।

এদিকে মন্ত্রী ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, জাহিদ ফারুক শামীম এতোদিন নমনীয় থাকলেও নেতাকর্মীদের চাপ, পাশাপাশি বিভিন্ন সেক্টরে মেয়র অনুসারীদের দাপটের বিষয়টি তিনি ভালোচোখে নিচ্ছেন না। আগামীর রাজনৈতির অস্তিত্বের স্বার্থে ক্ষমতা আর নেতৃত্বের জায়গায় ছাড় দিতে নারাজ মন্ত্রী বেঁকে বসলে বরিশাল আওয়ামী লীগে নতুন কিছু দেখা যেতে পারে।

সেক্ষেত্রে জাহিদ ফারুক শামীমের ‘শক্তিবারুদ’ হতে পারে সাদিকের বলয় থেকে বেড়িয়ে আসা বিদ্রোহীরা।

এ প্রসঙ্গে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ’র সাথে যোগাযোগ করা হলে তার ব্যক্তিগত সহকারী সুমন সেরনিয়াবাত সেলফোন রিসিভ করে গতানুগতিক ভাষায় বললেন- যা বলার আমাকেই বলুন’। যেনো তিনিই ছায়ামেয়র!’ ফলে সাধারণ মানুষকে মেয়র কিভাবে পাবে? এই প্রশ্নে অনেক উত্তর মিলে যায়।’

10 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন