২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বঘোষিত ছাত্রলীগ নেতাদের দাপট

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৩:০০ পূর্বাহ্ণ, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

পুলক চ্যাটার্জি,  অতিথি প্রতিবেদক:: বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি নেই। তবে গত ৩-৪ বছর ধরে চারটি গ্রুপে বিভক্ত স্বঘোষিত ছাত্রলীগ নেতাদের আধিপত্যের দ্বন্দ্বে অস্থির হয়ে উঠেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। মহিউদ্দিন শিফাত, ইমন-জিসান, জাহিদ-রক্তিম ও আল-আমিন গ্রুপ হিসেবে পরিচিত এসব গ্রুপের নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে বিব্রত হতে হচ্ছে স্থানীয় শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতাদের। শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন পুলক চ্যাটার্জি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিশেষ করে বরিশালের বিএনপি নেতার ছেলে মহিউদ্দিন আহম্মেদ শিফাতের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের গ্রুপটির বিতর্কিত ভূমিকা সংগঠনের স্থানীয় নেতাদের বিপত্তিতে ফেলে দিচ্ছে। অভিযোগ, শিফাতের ইন্ধনেই গত বুধবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ক্যাম্পাসসংলগ্ন বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করেন তার অনুসারীরা। এ সময় সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। এতে দুর্ভোগ পোহাতে হয় হাজার হাজার মানুষকে। একই দিন শিফাতের অনুসারীরা রূপাতলী বাস টার্মিনালে একটি কাউন্টার ও শ্রমিক ইউনিয়ন নেতার কার্যালয় ভাংচুর করেন।

বরিশাল নগরীর আমানতগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা মহিউদ্দিন আহম্মেদ শিফাত বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের ৩০০৫ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র। নগরীর বাসিন্দা হলেও প্রভাব খাটিয়ে তিনি হলের সিটটি বরাদ্দ নিয়েছেন। বুধবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কাছে রূপাতলি বাস টার্মিনালে শিফাতের সঙ্গে বিরোধ হয় বাসশ্রমিকদের। এর জের ধরে সেদিন সন্ধ্যাতেই শিফাতের অনুসারিরা রূপাতলি বাস টার্মিনালে গিয়ে বাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সুলতান মাহমুদের কার্যালয় ও বাকেরগঞ্জের বাস কাউন্টার ভাংচুর করে।

বরিশাল-পটুয়াখালী বাস মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিন উদ্দিন জানান, হামলার সময় মালিক সমিতির তিন কর্মচারী শাহিন, আল মামুন ও ছালাম আকনকে প্রচণ্ড মারধর করা হয়। খবর পেয়ে কোতয়ালী মডেল থানা পুলিশ সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।

তবে মহিউদ্দিন শিফাত অভিযোগ করেন, বুধবার বিকেলে তিনি ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য একটি মাহিন্দ্রায় (থ্রি-হুইলার) বসেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্রীও ছিল ওই মাহিন্দ্রায়। তখন এক বাসশ্রমিক লাঠি দিয়ে মাহিন্দ্রাটির পিছনে জোরে আঘাত করলে ছাত্রীরা ভয়ে চিৎকার করে ওঠেন। শিফাত এ ঘটনার প্রতিবাদ জানালে শ্রমিকরা চরম দুর্ব্যবহার করে। এ নিয়ে বাসশ্রমিকদের সঙ্গে তার বিতর্ক হয়। এক পর্যায়ে তাকে বাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সুলতান মাহমুদ নিজের কার্যালয়ে নিয়ে যান। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ওই কার্যালয়ে হামলা চালায়। পরে ভাড়া নিয়ে এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে দ্বন্দ্বের আরেক ঘটনায় শিফাতের অনুসারীরা বাকেরগঞ্জ রুটের বাস কাউন্টার ভাংচুর করে।

কাউন্টার ভাংচুরের সত্যতা স্বীকার করে মহিউদ্দিন শিফাত বলেন, হাফ ভাড়া দিতে চাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কাউন্টারের লোকজন দুর্ব্যবহার করলে ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। তবে ইউনিয়ন নেতার কার্যালয় হামলার অভিযোগ অসত্য বলে দাবি করেছেন শিফাত। কিন্তু শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সুলতান মাহমুদ বলেছেন, শিফাতকে শ্রমিকদের কাছ থেকে নিয়ে তিনি তার কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তার কার্যালয় ও পরে একটি কাউন্টারও ভাঙচুর করে।

মহাসড়ক অবরোধ সম্পর্কে শিফাত বলছেন, সাধারণ শিক্ষার্থীরা বাস শ্রমিকদের দুর্ব্যবহার ও জুলুমের প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ করেছিল। বাস মালিক সমিতি সূত্র জানায়, বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতার হস্তক্ষেপে শিফাত অনুসারিরা রাত ১০ টায় অবরোধ তুলে নেন।

মহিউদ্দিন আহম্মেদ শিফাত ছাত্রলীগের নামে রূপাতলি বাস টার্মিনাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য ১৫টি মাহিন্দ্রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো লাগিয়ে গিয়েছেন বলে অভিযোগ করে। প্রায় তিন মাস ধরে নির্ধারিত এ মাহিন্দ্রাগুলো রূপাতলি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের আনা নেয়া করছে। অভিযোগ আছে, এসব মাহিন্দ্রা থেকে শিফাত মাসোহারা পান। তবে শিফাতের দাবি, শিক্ষার্থীদের যাতায়াত সুবিধার জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে তিনি নির্ধারিত মাহিন্দ্রা চলাচলের উদ্যোগ নিয়েছেন। মাসোহারা নেয়ার অভিযোগ অসত্য।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের চারটি গ্রুপ সক্রিয় থাকলেও সেগুলোর মধ্যে শিফাত গ্রুপের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ে গত মার্চ মাসের শেষে শুরু হওয়া ভিসি বিরোধী আন্দোলনের পর থেকে মহিউদ্দিন আধিপত্য বিস্তারে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সে সময় ভিসি বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব এবং গণমাধ্যমে বক্তব্য দেয়ায় ক্যাম্পাসভিত্তিক সংগঠন ‘একাত্তরের চেতনা’র সভাপতি লোকমান হোসেনের ওপর হামলা চালায় এই গ্রুপ। যা নিয়ে তখন ব্যাপক তোলপাড় হয়। লোকমানের ওপর হামলার ঘটনায় শিফাতের কোনো শাস্তি না হওয়ায় সে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।

অভিযোগ, আবাসিক ও অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের দলে ভেড়াতে তাদের ওপর জোরজবরদস্তি করে শিফাতের অনুসারীরা। এজন্য হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে মারধরও করা হয়। শিফাত তার অনুসারীদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের শিক্ষার্থী মেসের মালিকদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলেন। শেরেবাংলা হলের একটি কক্ষে (১০০১ নং কক্ষ) তার সহযোগীরা নিয়মিত মাদকের আসর বসায় বলেও অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি আরাফাত নামের এক শিক্ষার্থীকে পুলিশ মাদকসহ ক্যাম্পাস থেকে গ্রেফতার করে। তখন আরাফাত নিজেকে শিফাতের অনুসারী বলে জানায় পুলিশকে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রলীগের ওপর ৩ গ্রুপের একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, মহানগর আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতার প্রশ্রয়ে মহিউদ্দিন আহম্মেদ শিফাত দিনে দিনে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। তার কর্মকান্ডে ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন ও মনগড়া দাবি করে মহিউদ্দিন শিফাত বলেছেন, ঈর্ষাণ্বিত হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিরা তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছেন। তিনি (শিফাত) চাঁদাবাজি বা মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন। শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধা দেখতে এবং ক্যাম্পাসে যাতে কোনো সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ড না হয় সেজন্য তিনি হলে থাকেন।

মহিউদ্দিন শিফাতের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলাল। তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, ছাত্রলীগের নামে হামলা-ভাংচুর ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টির এমন কর্মকাণ্ড গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তিনি বলেন, যাদের সাংগঠনিক পরিচয় নেই, তারা অন্যায়-অপরাধ করলে আইন শৃঙ্ক্ষলা বাহিনীর উচিত যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া।

গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলাল বলেন, তুচ্ছ ঘটনায় বাস টার্মিনালে হামলা ভাংচুর ও সড়ক অবরোধ দলের জন্য বিব্রতকর। ছাত্রলীগের নামে এ ধরনের কর্মকাণ্ড নিন্দনীয়। আইন-শৃঙ্ক্ষলা বাহিনী অবশ্যই এ ধরনের বেআইনী কর্মকাণ্ডে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন বলে আশা করেন তিনি।

1 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন