২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

বরিশাল যুবদলের সেই বিতর্কিত নেতা নান্নার পাসপোর্ট প্রতারণা, মামলা করায় উল্টো এ্যাকশন

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:৩৭ অপরাহ্ণ, ০৭ আগস্ট ২০২০

শাকিব বিপ্লব:: বরিশাল কীর্তনখোলা নদীর তীর জনপদের বহু অপকর্মের নায়ক মারুফ আহম্মেদ নান্না এবার নিজ বন্ধুর পাসপোর্ট নকল করায় তা ফাঁস হয়ে গেছে। পেশায় চাকুরিজীবী বন্ধু ফয়সাল আহমেদ এ বিষয়ে বরিশাল আদালতে একটি মামলা দায়ের করলে ধুরন্দর নান্না একটি ব্লাঙ্ক চেক সেই বন্ধুর বাসা থেকে কৌশলে নিয়ে এসে ২৪ লাখ টাকার অংক বসিয়ে ব্যাংক ডিজঅনার করে উল্টো একটি মামলা দায়ের করানোর প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয়েছে। এর পূর্বে ওই বন্ধুর পরিবারের সাথে প্রায় ৮ বছরকাল একত্রে বসবাস সূত্রে বিভিন্ন ব্যবসার নামে প্রায় ১২ লাখ টাকা আত্মসাত করে। চারিত্রিকগত কারণে ওই পরিবাররের সাথে সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটলে পাসপোর্ট প্রতারণার বিষয়টি ধরা পড়ে।

একাধিক সূত্র জানায়, বরিশাল রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপির ঘরোনার নেতা হিসেবে পরিচিত চল্লিশোর্ধ্ব বয়সী মারুফ আহমেদ নান্না টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি হলেও তিনি নিজ এলাকা অপেক্ষা শহরে অবস্থান করেন বেশি। ২০১০ সালে নিজ এক আত্মীয়র সাথে অনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকাবস্থায় এলাকাবাসীর হাতে-নাতে ধরা খাওয়ার পর তিনি বরিশাল শহরে আশ্রয় নেন। অন্যদিকে তার স্ত্রী জিন্নাত জাহান এলিচ ওই ঘটনায় অভিমানে এক কন্যা সন্তানসহ তার নিজ পিত্রালয় বরগুনার আমাতলীতে চলে যান।

পারিবারিক সূত্র জানায়, সেই থেকে দীর্ঘদিন ধরে নান্না ও এলিচের মধ্যকার দাম্পত্য সম্পর্ক দূরত্বের সৃষ্টি হয় এবং একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। স্ত্রী এলিচ এই প্রতিবেদকের কাছে এ তথ্য স্বীকার করে বলেন, তিনি নান্নার প্রতারণার শিকার। তার অভিযোগ, ওই অপ্রীতিকর ঘটনার পর থেকে তিনি ও তার একমাত্র কন্যার ভরনপোষন না দিয়ে নান্না ব্যবসায়ীক সূত্রে পরিচয় ফয়সাল আহমেদ নামক ওই বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নেয়। বরিশাল নগরীর বগুড়া রোডস্থ ফয়সাল আহম্মেদের বাসায় দীর্ঘ প্রায় ৬ থেকে ৭ বছর অবস্থানকালে ব্যবসায়ীক নানা অজুহাতে প্রায় ১২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।

ফয়সাল আহমেদের অভিযোগ, বন্ধুত্বের সরলতার সুযোগ নিয়ে বালু ব্যবসার কথা বলে অশিংদারিত্ব দেয়ার শর্তে বলগেট ক্রয়ের নামে প্রথম দফা ৭ লাখ টাকা নেয় নান্না। একপর্যায়ে আরও বাড়তি টাকার প্রয়োজনে ফয়সাল আহম্মেদের স্ত্রীর স্বর্ণালংকার বন্ধক রেখে আরও ৫ লাখ টাকা নেয়। ঘটনাচক্রে ফয়সালের খালাতো বোনের মেয়ে ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার ঝুরকাঠি ইউনিয়নের কৃষক সবুর হোসেন’র কন্যা সাথী আক্তার ওই বাসায় আসা-যাওয়ায় নান্নার নজরে পড়ে। একপর্যায় ওই তরুণীর সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে ঝুরকাঠি ইউনিয়নের যাতায়াত শুরু করে।

কিন্তু লোলুর্ধ্ব নান্নার চোখ পড়ে সাথী আক্তারের মা লাকী আক্তারের ওপর। ফয়সালের ভাষ্য, কোন একদিন তার বাসায় লাকী আক্তারের সাথে আপত্তিকর অবস্থায় থাকার মুহুর্তে নান্নার খালাতো ভাই সেখানে আসলে তিনি তা দেখে ফেললে সেই ঘটনা বহুদূর গড়ায়। একপর্যায়ে ২০১৮ সালের শেষের দিকে নান্না সেই বন্ধু ফয়সালের বাসা থেকে বিতারিত হয়। ফয়সালের অনুমান, কোন এক কারণে প্রতারণার কৌশল নিতে গিয়ে নান্না ঢাকার তেজগাঁও থেকে একটি পাসপোর্ট তৈরি করেন। সেই পাসপোর্টে নান্না নিজের ছবি দেওয়া হলেও নাম ঠিকানার স্থলে বন্ধু ফয়সালের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। ফলে পাসপোর্টটি যে নকল তা প্রমানিত হয়। কিন্তু কেউ এতোদিন তা আঁচ করতে পারেনি। ফয়সালের দাবি, একটি চাকুরি দেয়ার কথা বলে তার জাতীয় পরিচয়পত্রসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও বেশ কয়েক কপি ছবি নান্না নিয়েছিলো। এখন দেখা গেছে সেই নকল পাসপোর্টটি তৈরির ক্ষেত্রে সেই কাগজপত্র ব্যবহার করা হয়েছে।

নিজের ছবি কিন্তু অন্যের নাম-ঠিকানায় তৈরি নকল পাসপোর্ট তৈরির বিষয়টি কোনো মাধ্যম নিশ্চিত হয়ে বন্ধু ফয়সাল আহম্মেদ বরিশাল কোতয়ালী মডেল থানায় এ বিষয়টি অবহিত করেন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, পাসপোর্ট সংক্রান্ত মামলা থানায় গ্রহণ সম্ভব নয়। তিনি পরামর্শ দেন ঢাকা তেজগাঁও পাসপোর্ট অফিসে এ ঘটনা অবহিত করে সংশ্লিষ্ট এলাকার থানায় মামলা দায়েরের জন্য।

তেজগাঁও পাসপোর্ট অফিসে ফয়সাল আহম্মেদ যোগাযোগ করলে সেখান থেকে পরামর্শক্রমে গত ২৩ জুলাই বরিশাল আদালতে এ বিষয়ে একটি প্রতারণার মামলা দায়ের করা হয়। মামলা দায়েরের বিষয়টি নান্না জানার পর ক্ষুব্ধ হয়ে ফয়সালকে কয়েকদফা হুমকি-ধামকি দিয়ে দেখে নেয়ার সতর্কবার্তা দিয়েছে বলে তিনি এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে নান্না পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ফয়সাল আহম্মেদের আল-আরাফাহ ব্যাংক অ্যাকাউন্টের একটি চেক বই তার আয়ত্ত্বে নিয়ে একটি ব্লাঙ্ক চেকে ২৪ লাখ টাকার অংক বসিয়ে তা উত্তোলনের চেষ্টা করে। কিন্তু অ্যাকাউন্টে সেই পরিমাণ টাকা না থাকায় গত ২৭ জুলাই চেকটি ডিজনার করে একটি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ফয়সালের পরিবারের ভাষ্য, তাদের বাসায় দীর্ঘ অবস্থানকালীন সময়ে সবকিছু দেখভাল করে ওই পরিবারকে নান্নার প্রতি মানসিকভাবে দুর্বল ও নির্ভরশীল করে তুলেছিলো। সেই সুযোগে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের চেক বই নান্নার কাছে রক্ষিত ছিল। অবশ্য চেক বই হারিয়ে যাওয়ার কারণে বরিশাল কোতয়ালী মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী (জিডি) করা রয়েছে।

কেন এই পরিবারের সাথে নান্নার বিরোধ তুঙ্গে উঠলো এনিয়ে অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে আরেকটি তথ্য। সূত্র জানায়, ফয়সালের খালাতো বোনের মেয়ে সাথী আক্তারকে সম্প্রতি নান্না গোপনে বিবাহ করে। যেখানে নান্নার সাথে বিরোধ, সেখানে তারই নিকটাত্মীয়কে বিয়ে করায় ফয়সাল বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। তিনি এ বিষয়ে বিরোধিতা করে খালাতো বোনকে নান্নার অতীত-বর্তমান ইতিহাস তুলে ধরে সম্পর্ক বিচ্ছেদের পরামর্শ দেন। ফয়সালের খালাতো বোন লাকী আক্তার ও তার স্বামী সবুর হোসেন বিষয়টি আমলে না নিয়ে বরং হবু জামাই নান্নার প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ করে। এমনকি নববধূ সাথী আক্তারও স্বামী নান্নার পক্ষে অবস্থান নেয়। খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে, দ্বিতীয় বিবাহের ক্ষেত্রেও নান্না প্রতারণার আশ্রয় নেয় এবং প্রথমা স্ত্রীর কোন অনুমতি নেয়া হয়নি। প্রথমা স্ত্রী এলিচ এই প্রতিবেদকের কাছে এ তথ্য স্বীকার করে নান্নার কাছে তার রক্ষিত স্বর্ণালংকার ফেরত পাওয়াসহ আইনগত আশ্রয় চান।

অনুসন্ধানের পাওয়া যায়, গত ২ এপ্রিল সাথী আক্তারকে বিবাহ করলেও কাবিন অর্থাৎ রেজিষ্ট্রী করা হয়নি। যদিও বিষয়টি নিশ্চিত নয়। তবে একাধিক সূত্র এমনটি দাবি করে বলছে, বরিশাল চকবাজার এলাকার একটি মসজিদে একজন ইমামের উপস্থিতিতে এই বিবাহ সম্পন্ন হয়। অন্যদিকে নান্নার প্রথম স্ত্রী এলিচের কাছে এ খবর পৌঁছে যাওয়ার পেছনে ফয়সাল পরিবারের হাত রয়েছে, এমনটি ভেবে নান্না ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এরপরই শুরু হয় প্রতারক নান্নার হুম্ভিতম্ভি-হুংকার। ফয়সালের অভিযোগ, এখন তাকে নানাভাবে ফাঁসাতে নান্না ফন্দিফিকির আটছে। কে এই নান্না? তার পরিচয় খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেছে কীর্তনখোলার নদীর তীরাংশ সাহেবেরহাট এলাকার মান্নান হওলাদারের তিন পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের মধ্যে নান্না মেঝো পুত্র। বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও বর্তমান আওয়ামী লীগের ক্ষমতার এই যুগে কৌশলে স্থানীয় ক্ষমতাসীন মহলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। অথচ তিনি টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি হিসেবে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সক্রিয় বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। নান্নার রাজনৈতিক গুরু বরিশাল নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আনারুল হক তারিন এই প্রতিবেদকের নান্নার রাজনৈতিক সক্রিয়তার কথা স্বীকার করে বলেন তিনি তার অপরাধ দল বহন করবে না। এটি তার ব্যক্তিগত বিষয়। তার দ্বারা কেউ প্রতারিত হলে তিনি আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। তার চারিত্রিক বিষয় সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করতে নারাজ।

তবে তার অতীত ইতিহাস ভালো নয় সে বিষয়টি আনারুল হক তারিনের কন্ঠে কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। ২০০৪ সালে সাহেবেরহাট বাজারে চাঁদাবাজির প্রাক্কালে বরিশাল র‌্যাব-৮ এর সদস্যদের হাতে আটক হয়েছিলো। এলাকায় তাকে নারীলোভী এবং প্রতারক হিসেবেই কমবেশি স্থানীয়রা তার কাহিনী সম্পর্কে অবগত। টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বাহাউদ্দিন আহম্মেদ মিয়ার সাথে এই প্রতিবেদকের আলাপকালে তিনিও নান্না সম্পর্কে ভালো ধারণা দিতে পারেননি। তার অভিমত, নান্না প্রতারক কিনা সে সম্পর্কে তার কাছে তথ্য-উপাত্ত না থাকলেও একাধিক নারী সম্পর্কিত অপকর্মের খবর তিনি অবগত বলে জানিয়েছেন। এসব কারণেই ইতিপূর্বে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নান্নার কুকীর্তি শিরোনাম হয়েছিল। সম্প্রতি আবারও সোশ্যাল মিডিয়ায় তার অপকর্ম নিয়ে লেখালেখি অব্যাহত রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে অভিব্যক্তি জানার চেষ্টায় মারুফ আহম্মেদ নান্নার সাথে যোগাযোগ করা হলে এই প্রতিবেদককে থোড়ায় কেয়ার না করে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকদের সাথে তার সু-সম্পর্ক থাকার কথা জানিয়ে তার শক্তিমাত্রা এবং সু-বিস্তৃত নেটওয়ার্ক জাহির করায় তিনি যে প্রতারক তার ষোলকলা আঁচ করা গেছে।

6 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন