১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

বাকলা চন্দ্রদ্বীপ থেকে আমাদের আজকের বরিশাল

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০১:০০ অপরাহ্ণ, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বাকলা চন্দ্রদ্বীপ থেকে আমাদের আজকের বরিশাল

হাসিবুল ইসলাম, বরিশাল >> ধান নদী খাল এবং রূপালি ইলিশে সমৃদ্ধশালী এক ঐতিহাসিক জনপদ বরিশাল। প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চল স্বতন্ত্র ঐতিহ্য বহন করে চলছে। খ্রীস্টের জন্মের তিন হাজার বছর পূর্ব থেকেই এখানকার ভূমিরূপ তৈরি হতে থাকে।

তবে এ অঞ্চলে মানব বসতির বয়স সর্বোচ্চ ১০ হাজার বছর হতে পারে। প্রাচীনকালে এ অঞ্চলে ‘বাঙ’ জাতির বসবাস ছিল। বঙ ছিল হযরত নূহ (আ:)-এর প্রপৌত্র। ধারণা করা হচ্ছে বঙ-এর বংশধররাই উত্তরকালে বাঙ জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

পরবর্তীতে প্রাচীন ভারতবর্ষের ভেড্রি, অস্ট্রিক, আলপাইন, মঙ্গোলীয়, দ্রাবিড় প্রভৃতি জনগোষ্ঠির সংমিশ্রণে এক নতুন জাতির উদ্ভব ঘটে। এদেরই উত্তর পুরুষ এ জাতি। এজন্যই আমাদের মিশ্র বা শঙ্কর জাতি বলা হয়। বাঙ জাতি ‘আল’ দিয়ে ভূমির সীমানা নির্ধারণ করত।

প্লাবন বা জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করতেও একই প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিত প্রাচীন অধিবাসীরা। তাছাড়া অন্য একটি মতও এখানে উল্লেখ করা যায়। তা হল সেমেটিক পরিভাষায় আল শব্দটি দ্বারা বংশ বা আওলাদ বুঝানো হয়। এজন্যই হযরত নূহ (আঃ) বংশধর হিসেবে তাদের বাঙাল বলা হত।

আবার আর্যরা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য অর্থেও বাঙাল শব্দ ব্যবহার করত। তবে সেটা হল অনেক পরের কথা। বাঙাল জাতিই প্রথম আবাদ করে এ উপকূল। তাদের নাম অনুসারেই এক সময় বরিশালের নাম হয় বাঙাল।

পরবর্তীতে বাংলাবাদ, বাকলা, চন্দ্রদ্বীপ, ইসমাইলপুর, বাখরগঞ্জ এবং সর্বশেষে বরিশাল নামে আধুনিক পরিচিতি লাভ করে। তবে ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা বাকলা চন্দ্রদ্বীপ নামটাই স্বমহিমায় উজ্জ্বল দেখতে পাই। ঈসায়ি দশম শতাব্দি থেকেই এ নামটির উল্লেখ পাওয়া যায়।

মুঘল ঐতিহাসিক আবুল ফজলের আইনী আকবরীতে বাকলার উল্লেখ আছে।

টোডরমলের রাজস্ব সংস্কারের সময় সরকারিভাবে বাকলাকে ইসমাইলপুর হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। আবুল ফজল লিখেছেন, বাকলা চন্দ্রদ্বীপ সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত। প্রাচীনকালে গঙ্গা নদী সপ্তশাখায় বিভক্ত ছিল।

এর একটি ছিল পাবণী পূর্বগামী শাখা। পূর্বগামী ত্রিধারার মিলিত স্থানকে সুগন্ধা বলা হত। ইহা পূর্ব সাগরে পতিত হয়। এই সুগন্ধা নদীর বুকে গঙ্গার পলিমাটি অসংখ্য দ্বীপ সৃষ্টি করে। এসবের মধ্যে ইন্দ্রদ্বীপ, সংখকোট, স্ত্রীর, জম্বু দ্বীপ প্রভৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়। কালের বিবর্তনে দ্বীপগুলোর সম্মিলিত নাম হয় চন্দ্রদ্বীপ। দ্বীপগুলোর আকৃতি চঁদের ন্যায় ছিল বলে এরূপ নামকরণ করা হয়।

আবার কেউ কেউ বলেন, চন্দ্রভন্ড্র জনগোষ্ঠির নামানুসারে চন্দ্রদ্বীপের নাম হয়েছে। ঈসায়ি তৃতীয় শতকের পূর্ব পর্যন্ত বাকলা চন্দ্রদ্বীপের রাজনৈতিক ইতিহাস অজ্ঞাত। ৪র্থ ও ৫ম শতকে ইহা মৌর্জ ও গুপ্ত শাসনাধীন ছিল। ৪র্থ শতকে বাকলার পুষকরণের মহারাজা চন্দ্রবর্মন কোটালীপাড়া দখল করে বাকলা চন্দ্রদ্বীপে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। কোটালীপাড়াকে কেন্দ্র করে চন্দ্রদ্বীপের প্রাচীন সভ্যতা বিকাশ লাভ করে।

উল্লেখ্য গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, বাখরগঞ্জ, পটুয়াখালী, খুলনা, বাগেরহাটসহ সমস্ত দক্ষিণাঞ্চল তখন বাকলা চন্দ্রদ্বীপের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। গুপ্ত রাজাদের পতনের পর বৌন্যগুপ্ত (৫০৫-৫২৫) দক্ষিণ পূর্ব বাংলা নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করেন। ৫২৫ থেকে ৬০০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত গোপালচন্দ্র, ধর্মাদিত্য, নরেন্দ্রাদিত্য সমাচারদেব বাকলা শাসন করেন। পরবর্তীতে সপ্তম শতাব্দিতে খড়গ বংশ, অষ্টম শতাব্দিতে দেববংশ, নবম ও দশম শতাব্দিতে চন্দ্রবংশ এবং এগার থেকে চৌদ্দ শতাব্দিতে সেন বংশের প্রতিনিধিরা উপকূলীয় অঞ্চল শাসন করেন। চন্দ্রদ্বীপে ইসলামের আগমন ঘটে পনের শতকের মধ্যভাগে।

ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতান বারবাক শাহ (১৪৫৯-৭৪) চন্দ্রদ্বীপে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন করেন। মির্জাগঞ্জের মসজিদবাড়িয়ার শাহী মসিজদ (৮৭০ হিজরী) তাঁর নির্মিত স্থাপত্যকীর্তি। চন্দ্রদ্বীপ স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে পনের শতকের সূচনাপর্বে। ধনুজমর্দন এর স্থপতি। কারো কারো মতে ধনুজমর্দন লক্ষণসেনের পৌত্র, আবার কেউ কেউ বলেন তিনি ছিলেন কিংমেকার গনেশ তনয় মহেন্দ্রদেবের পুত্র। সাতক্ষীরার বাসুদেবপুর প্রাপ্ত ধনুজমর্দনের মুদ্রায় দেখা যায় তিনি ১৪১৭ সালে চন্দ্রদ্বীপে রাজত্ব করেন।

তিনি প্রথমে হিজলার গোবিন্দপুরে, পরে বাউফলের কচুয়ায় রাজধানী স্থাপন করেন। বাকলা নগর এখানেই গড়ে ওঠে। ১৫৮৪ সালে বাকলা চন্দ্রদ্বীপে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এতে প্রায় দুই লাখ লোকের মৃত্যু হয়। রাজা জগদানন্দ বসুও এসময় পানিতে ডুবে মারা যায়। তারপূর্বে ধনুজমর্দন, রমাবল্লভ, কৃষ্ণবল্লভ, হরিবল্লভ, জয়দেব, কমলা রানী(বাকলার একমাত্র মহিলা রাজা) ও পরমানন্দ-এ সাত জন রাজা শাসনকার্য পরিচালনা করেন।

১৫৮৪ সালে বারভূঁইয়ার অন্যতম রাজা কন্দপনারায়ণ রাজত্ব গ্রহণ করেন। মগ পর্তুগীজ জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য তখন অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। এজন্য কন্দপনারায়ণ প্রথমে বাখরগঞ্জের বাসুরীকাঠি ও পরে বাবুগঞ্জের ক্ষুদ্রকাঠিতে রাজধানী স্থানান্তর করেন। ১৫৯৮ সালে পাঠানদের সাথে একযুদ্ধে তিনি নিহত হলে পুত্র রামচন্দ্র সিংহাসনে বসেন।

তিনি প্রথমে ঝালকাঠির হোসেনপুরে ও পরে বাবুগঞ্জের মাধবপাশায় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান বরিশাল শহরের ১১ কি.মি পশ্চিমে দুর্গাসাগরের অদূরে সে সময়ের ভবনাদির ভগ্নাবশেষ এখনো অবশিষ্ট আছে। ১৬১১ সালে মুঘলদের হাতে স্বাধীন রাজা রামচন্দ্রের পতন ঘটে। পরবর্তী সময়ে শাহ সুজা, বুজুর্গ উমেদ খান, কীর্তিনারায়ণ, উদয় নারায়ণ প্রমুখ বাকলার রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদান করেন।

শায়েস্তা খানের পুত্র উমেদ খান ১৬৬৬ সালে পর্তুগীজ দস্যুদের কঠোর হস্তে দমন করেন। আঠার শতকের প্রথমার্ধে বরিশালের ইতিহাসের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব আগা বাকেরের আবির্ভাব ঘটে। তিনি বুজুর্গ উমেদপুর ও সেলিমাবাদ পরাগণা করায়ত্ত করে এক বিশাল জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন।

১৭৪০ সালে নবাব আলীওয়ার্দী তাঁকে চন্দ্রদ্বীপ পরাগণার প্রশাসক নিযুক্ত করেন। বুজুর্গ উমেদপুরে তিনি একটি ব্যবসাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে যার নাম হয় বাখরগঞ্জ। ১৭৫৩ সালে ঢাকায় অবস্থানকালে প্রতিপক্ষের হাতে আগা বাকের নিহত হয়। তাঁর পুত্র আগা সাদেককে ১৭৫৯ সালে মীরন ও রাজবল্লভ নির্মমভাবে হত্যা করে। কারণ পিতা পুত্র দু’জনেই ছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলার একনিষ্ঠ ভক্ত।

আগা বাকেরের পর কর্তৃত্ব রাজবল্লভ ও তার বংশধরদের হাতে চলে যায়। পলাশি ট্রাজেডির পর এ অঞ্চলও একসময় বৃটিশদের অধীন হয়ে পড়ে। কিন্তু বাকলা চন্দ্রদ্বীপের সাহসী জনতা নানা ইস্যুতে বিদ্রোহের মাধ্যমে তাদের স্বাতন্ত্র্য স্বকীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা চালায়। বৃটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে লবণ চাষীদের বিদ্রোহ, বাল্কী শাহ’র স্বাধীনতা সংগ্রাম, ফরায়েজী আন্দোলনসহ বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বারবার ফুঁসে উঠেছে আগা বাকেরের উত্তরসূরীরা।

কোম্পানি শাসনের গোড়ার দিকে ইহা ঢাকার একটি অংশ হিসেবে শাসিত হয়। বাখরগঞ্জের শাসনকাজ নির্বাহের জন্য ১৭৮১ সালে প্রশাসনিক ক্ষমতা দিয়ে একজন সিভিল জজ নিযুক্ত করা হয়। তার সদর দফতর স্থাপিত হয় নলছিটির বারইকরণ। ১৭৮৪ সালে সুন্দরবনের কমিশনারের দফতরও এখানে নিয়ে আসা হয়। ১৭৯২ সালে ইহা বাখরগঞ্জে স্থানান্তরিত হয়। ১৭৯৭ সালে ঢাকা প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে বাখরগঞ্জ নামে নতুন জেলা গঠিত হয়।

১৮০১ সালে জেলা প্রশাসক মি. উইন্টাল বাখরগঞ্জ থেকে বর্তমান বরিশালে জেলা সদর দফতর স্থানান্তর করেন। বরিশাল বর্তমানে শুধু জেলা শহরই নয় ইহা বিভাগীয় শহর এবং সিটি কর্পোরেশন। ১৯৯৩ সালে বিভাগ এবং ২০০০ সালে সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত হয়। বরিশালের নামকরণের ব্যাপারে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও গবেষকরা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য প্রদান করেছেন। সুলতানি আমলে বরিশালকে গিরদে বন্দর বলা হত। ইউরোপিয়রা গিরদে বন্দরকে গ্রেট বন্দর বলে আখ্যায়িত করত। গ্রেট বন্দর পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল হয়েছে। অন্যদিকে বরিশাল নাম নিয়ে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। পর্তুগীজ ব্যবসায়ী মিঃ বেরি এক ললনার প্রেমাসক্ত হয়।

কিন্তু প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন। খবর শুনে প্রেমিকা শেলীও মৃত্যুকে বরণ করে নেয়। এই বেরি ও শেলীর নাম থেকে পরবর্তীতে বরিশাল নামকরণ হয়। আবার কেউ কেউ বলেন বরিশালে এক সময় বড় বড় শাল বৃক্ষ জন্মাত। তাই এর নামকরণ বরিশাল হয়েছে।

আবার কারো কারও মতে, প্রাচীন কাল থেকেই এখানকার খাল পুকুরে বড় বড় শোল মাছ পাওয়া যেত। সেখান থেকে বরিশাল নাম গৃহীত হয়েছে। তবে সবচেয়ে যে বিষয়টি প্রসিদ্ধ লাভ করেছে সেটা হল ‘বরিসল্ট’ থেকে বরিশাল নামের উৎপত্তি।

তখন এ অঞ্চলের জনগণের প্রধান অংশ লবণ ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলো। লবণ ব্যবসায়ীদের বড় কেন্দ্র ছিল গিরদে বন্দর। এখানে ছিল লবণের বড় বড় গোলা ও দক্ষিণ বাংলার লবণ শুল্ক আদায়ের প্রধান চৌকি।

বিদেশি বণিকরা গিরদে বন্দরকে ‘বরিসল্ট’ বলত। বরিসল্ট পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল নাম গৃহীত হয়। আস্তে আস্তে বাকলা চন্দ্রদ্বীপ ভৌগলিকভাবে বরিশাল নামে পরিচিতি লাভ করে।

সূত্র: ১) আগা বাকের সিরাজুদ্দীন আহমদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২) বাংলাদেশ জেলা গেজেটীয়ার বাখরগঞ্জ, ৩) বাঙালির ইতিহাস- ড. মোহাম্মদ হান্নান, অনুপম প্রকাশনী, ঢাকা।’’

29 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন