২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার

‘বাচ্চারা সব ছবি আঁকতে নেই!

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৫:১২ অপরাহ্ণ, ২৩ জুলাই ২০১৭

সব ছবি আঁকতে নেই। আঁকার ক্ষেত্রেও বোধ করি সীমারেখা থাকতে হয়। গায়ক কবীর সুমনের একটা গানের শিরোনাম হচ্ছে- ‘বসে আঁকো’। এই গানের কথা এমন-আঁকো ফুল পাখি আর প্রজাপতি/আঁকো মিকি মাউস ধীরগতি/এঁকোনা কখনও স্বদেশের মুখ/তোবড়ানো গাল ভেঙে যাওয়া বুক! এঁকোনা তোমার চেনা রাস্তায়/ কাগজ কুঁড়িয়ে ভরে বস্তায়/ যে ছেলেটা রোজ একা চলে যায়, তার মুখ কদাকার!
কাগজ টোকানো ওই ছেলেটারও স্বপ্ন আছে। তারও ছবি আঁকতে ইচ্ছে করে। শিশুরা কখনও কদাকার ছবি আঁকে না। তারা কুমির আঁকতে গেলে হয়তো সেটা টিকটিকির মতো দেখায়! তারা ফুল আঁকতে গেলে হয়তো সেটা কলি হয়ে যায়। কিন্তু সেই কলিই একদিন সুন্দরতম ফুল হয়ে ফোটে!
শিশুরা হয়তো অনেক কিছু ঠিকঠাক বোঝাতে পারে না। যেমন একটা শিশু কখনও সাপ দেখেনি। সে সাপ দেখে দৌড়ে গিয়ে তার বাবাকে ডেকে এনে বললো- বাবা দেখো দেখো একটা কুকুরের লেজ নড়াচড়া করছে কিন্তু কুকুরটাই নেই! শিশুরা ভয় পায়। তারা লাঠি বা বেতের বাড়ি খেতে চায় না।
মার খাওয়া থেকে বাঁচতে তারা কখনও কখনও মিথ্যাও হয়তো বলে! যেমন স্কুলের সবচেয়ে রাগী শিক্ষকটা যদি তার ছাত্রকে আদর করে বলে- বাবু তোমাদের বাড়ি যেন কোথায়? ছাত্র তখন সত্যি উত্তর দেয়- স্যার ব্রাহ্মণবাড়িয়া। স্যার এরপর যখন রাগী ভঙ্গি নিয়ে বলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়া বানান করে ঠিকঠাক লিখে দেখাও। তখন ছাত্রটা হয়তো কাঁদো কাঁদো গলায় বলে-স্যার ভুল বলেছিলাম। আমাদের বাড়ি আসলে ঢাকা!

শিশুরা খানিকটা বড় হলে কখনও কখনও কিশোর বয়সে হয়তো ইচড়েপাকাও হয়! এই পাকামো তারা স্কুলের ক্লাসে করতেই ভালোবাসে। যেমন-

-এই রাজু তুমি কি আইনস্টাইনের নাম শুনেছ?

-না স্যার।

-আইজ্যাক নিউটনের নাম শুনেছ?

-না স্যার। উনি আবার কে?

-স্টিফেন্স হকিন্স?

-স্যার আপনার কী স্বদেশ প্রেম নেই? আপনি কী বাঙালি কারো নাম জিজ্ঞাসা করতে পারতেন না? আপনি কি কালা জাহাঙ্গীরকে চেনেন?

-(হতভম্ব হয়ে গেলেন স্যার। কোনোক্রমে বললেন)অবান্তর প্রশ্ন।

-তাহলে স্যার আপনি কি মুরগী মিলনকে চেনেন? কিংবা সুইডেন আসলাম?

-(স্যার রেগে গিয়ে বললেন) মাস্তানি করো?এদেরকে চিনতে হবে কেন?

-তাইলে সমান সমান স্যার। আপনি যেমন আমাগো পাড়ার বড় ভাইদের চেনেন না আমিও তেমনে আপনার পাড়ার বিদেশি মাস্তানগো চিনি না। হামলা, মামলা কিংবা মারামারি কইরা কোনও লাভ আছে স্যার?

শিশুরা হয়তো বোঝাতে পারে না, হয়তো তারা ভয় পায়, হয়তো বেতের বাড়ি থেকে বাঁচতে সামান্য মিথ্যেও বলে, কখনও কখনও ইচড়ে পাকাও হয় কিন্তু তাদের স্বপ্নটা কখনও উল্টাপাল্টা হয় না। কেউ যদি মুক্তিযুদ্ধের ছবি আঁকে তবে ওই বয়সের সব স্বপ্ন দিয়েই শিশুরা সেটা আঁকে। ছবিটা যেমনই হোক, ওই আঁকার ভেতর দিয়েই তারা তাদের স্বপ্নের সমান বাংলাদেশটাকে নিজের মনে করে। শিশুরা যখন বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকে তখন এই মানুষটাকেও তাদের নিজের মনে হয়। নিজেকেও সে বঙ্গবন্ধু ভাবতেই ভালোবাসে। ১৯৭১ এর সাতই মার্চের ভাষণের সেই অমর প্রেরণা-এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম শব্দগুলোকে তার সবচাইতে প্রিয় মনে হয়। শিশুরা তখন বিশ্বাস করতে শেখে – মনে রাখবা বাঙালিদের কেউ দাবায়ে রাখবার পারবে না!

তবু শিশুদের দাবায়ে রাখার ঘটনা ঘটে। আর যারা শিশুদের স্বপ্ন বিকশিত করতে চান তারা পড়ে যান বিপদে। বিপদে পড়া সর্বশেষ ব্যক্তির নাম (গাজী)তারিক সালমন। ২০১৬ সালে চৈতন্য প্রকাশনী থেকে ছেলেটার একটা কবিতার বই বেরিয়েছিল। কবিতার বইয়ের নাম সহজ প্রেমের কবিতা। সালমনের একটা কবিতা এমন- নিরুপায় হাঁটছিলে তুমি/ তোমার সাথে হাটছিল চাপা ফুল/ অল্প দূরে কাঁদছিল এক টুকরো অন্ধকার/ বাতাসে ছিল শেষ বসন্তের সুঘ্রাণ!

অবশ্য বসন্তের সুঘ্রাণ আর চাপা ফুল গত এপ্রিল থেকে সালমনের সাথে হাঁটছিল না। কারণ ছেলেটা মনে হয় শিশুদের মতো সরল আর কবিতার মতো ভয়ঙ্কর সুন্দর পথ ধরে হাঁটার চেষ্টা করতো! আর তাই গৌরনদীর আগৈলঝড়ার এক আওয়ামী লীগ নেতার ছেলেকে সে নকল করতে দেয়নি। পরীক্ষার হল থেকে তাকে বহিষ্কার করেছিল। যারা ওই ছেলেকে নকল সাপ্লাই দিয়েছিল (স্কুলের দফতরি এবং একজন শিক্ষক!) তাদেরকেও শাস্তি দিয়েছিলেন সালমন। সোলার বিদ্যুতের জন্য বরাদ্দের টাকা ফেরত পাঠিয়েছিলেন। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে যারা কাজ ঠিকমতো করেনি তাদের সালমন বিল দেননি। যারা উন্নয়ন কাজ অর্ধেক করে ফেলে রেখেছে তাদেরকেও বিল দেননি সালমন। পরিণাম বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করা এবং পাঁচকোটি টাকার মানহানির মামলায় সালমনকে ফাঁসিয়ে দেওয়া! যিনি তারিক সালমনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তিনি একজন আইনজীবী এবং বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক! এই ভদ্রলোকের নাম সৈয়দ (হূমায়ুন আহমেদের নাটকে দেখেছিলাম সৈয়দ বংশের ছেলের ভাবই আলাদা!) ওবায়েদুল্লাহ সাজু। একটি বিশেষ প্রাণীর সঙ্গে এই ভদ্রলোকের মিল রয়েছে। ছবি আঁকা প্রতিযোগিতার প্রথম ও দ্বিতীয় বিজয়ীর আঁকা ছবি দিয়ে সালমন কার্ড ছাপিয়েছিলেন ২০১৭ সালের ২৬ মার্চের আগেই। অথচ ভদ্রলোক সালমনের বিরুদ্ধে মামলা করেন ঘটনার আড়াই মাস পরে! ছাপানো কার্ড দেখে নাকি তার বুক ধড়পড় করছিল আড়াই মাস ধরে! তারপর তিনি মামলা করেন। তাও মাত্র পাঁচকোটি টাকার মানহানির মামলা! কার মান যে পাঁচকোটি টাকার সমান সেটাই বোঝা গেলো না!

সালমন যেদিন আদালতে যান সেদিন সাজুর সহমর্মী(?)চল্লিশের বেশি আইনজীবী সাজুর পক্ষে দাঁড়ান! তারিক সালমন একজন খুঁজে পাননি যে তার হয়ে মামলাটা লড়বে! শুধু তাই নয়। প্রশাসন কিংবা পুলিশও সালমনের পক্ষে দাঁড়ায়নি। বরিশালের জেলা প্রশাসক গাজী সাইফুজ্জামান ২০১৭ সালের ৩ এপ্রিল সালমনকে কারণ দর্শাও নোটিশ দিয়েছিলেন। সালমন জবাব পাঠিয়েছিলেন বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার মো. গাউসের কাছে। সালমনের জবাব তার মনপুতঃ হয়নি! শেষমেষ ছবি বিকৃতি ও মানহানি মামলার কারণে আওয়ামী লীগ থেকে সাময়িক বহিষ্কার হলেন সৈয়দ সাহেব! দুর্ভাগ্য তার। তিনি সাময়িক শাস্তি পেয়েছেন। সাময়িক সময়টা পার হয়ে গেলে তিনি হয়তো দলে ফিরবেন। কিন্তু যে পুলিশ সালমনের সাথে খারাপ ব্যবহার করলো, যে জেলা প্রশাসক তাকে কারণ দর্শাতে বললো, যে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে সালমনের জবাব মনপুত হয়নি তারা ‘সাময়িক’ কিছুও পেলেন না!

সাময়িক কিংবা চিরস্থায়ী যা কিছু পেয়েছেন তা একান্তই তারেক সালমনের! পুলিশ তাকে আসামীর মতো ধরে নিয়ে গিয়েছিল। প্রথম দফা তার জামিনও নামঞ্জুর হয়েছিল। যে দুই তিন ঘণ্টা সালমন হেফাজতে ছিলেন সেটাও ছিল তার একান্তই কান্নাকাতর সময়। স্ত্রীকে সেসময়ে টেলিফোন করে বলেছিলেন কিছু বই পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। আর বলেছিলেন চাকরিটা তিনি ছেড়ে দেবেন! প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের কারণে সালমনের চাকরিটা ছাড়তে হয়নি। আগৈলঝড়া থেকে বরগুনাতে যাওয়া ছিল তার জন্য পানিশমেন্ট পোস্টিং। সেখানে থাকতে পারাটাই হয়তো সালমনের জন্য এখন অনেক কিছু!

পানিশমেন্ট পোস্টিংয়ে থেকে বাচ্চাদের নিয়ে আরও কিছু করুক সালমন। শিশুরা যেন তার পিতার মুখটা কখনও ভুলে না যায়। মনের মাধুরী মিশিয়ে যেন তারা সেটা আঁকতে পারে। কোনও ইনডিমিনিটি যেন শিশুদের এই স্বপ্ন বা ইচ্ছেটা ধ্বংস করতে না পারে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত এই চব্বিশ বছরের অর্ধেকের বেশি সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন জেলে। এসময়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রায়ই বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে যেতেন। শিশু শেখ রাসেল সেসময়ে একদিন শেখ হাসিনাকে বলেছিল- আপা আমাকে একবার তোমার বাবাকে বাবা বলে ডাকতে দেবে?

শিশুদের চেয়ে রঙিন করে আর কে পারে পিতাকে ডাকতে? আর কে পারে পিতার মুখ আঁকতে?

লেখক: রম্যলেখক

7 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন